২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের জন্য সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি

- প্রতীকী ছবি

ওষুধ প্রয়োগের আগে রোগ নির্ণয় জরুরি। তবেই সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব। তেমনি কোন দেশের সঙ্কট সমাধানের জন্য প্রথমে সঙ্কটের কারণ নির্ণয় করতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কট লুকিয়ে আছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে। কোনো রাজনৈতিক দল একবার ক্ষমতায় গেলে আর ছাড়তে চায় না। স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনাও হয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্ব›দ্ব থেকেই। আর সত্যি এই যে, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী সময় পরও সেই দ্বন্দ্বের সুরাহা হয়নি।

নব্বইয়ের গণ আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পরপর তিনটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে রাজপথে প্রকাশ্যে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট দেশে ওয়ান-ইলেভেনের পথ ধরে ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের সূচনা করার সুযোগ পায়। সেই থেকে দেড় দশক দেশবাসী ফ্যাসিবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে।

আবার যেন ফ্যাসিবাদ জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসার সুযোগ না পায়, রাষ্ট্রকাঠামোয় তেমন সংস্কারের দায়িত্ব পালন করছে ড. ইউনূসের সরকার। মূলধারার গণতান্ত্রিক প্রতিটি রাজনৈতিক দলই তাকে সহযোগিতা করছে। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের কাজ চলছে। জামায়াতে ইসলামী গত ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে সরকার ও দেশবাসীর সামনে তাদের ১০ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে। তাদের অন্যতম প্রধান দাবি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতি। বিষয়টি জনগণের জন্য নতুন সন্দেহ নেই। নতুনকে বরণ করা রক্ষণশীলদের জন্য কষ্টকর। তারা অতি পরিচিত পুরোনো ব্যবস্থা সহজে ভাঙতে চান না। কিন্তু যারা ভাঙতে পারেন তারাই পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।

প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে কেয়ারটেকার সরকারের মতো সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতিও গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াতে ইসলামীর কেয়ারটেকার সরকারের প্রস্তাবেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রথম দিকে তীব্র বিরোধিতা করেছিল। পরে তারাই ইতিহাসে স্মরণীয় হওয়ার মতো ঐতিহাসিক কাজটি করেছে। একটি অন্তর্বর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সংসদে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করেছিল।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কিছু আসন শরিকদের ছেড়ে দিয়ে ২৬৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তারা ২৩০টি আসন পেয়েছিল। তাদের প্রাপ্ত মোট ভোট ৩,৩৬,৩৪,৬২৯, যা মোট ভোটের ৪৮.০৪ শতাংশ। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতি অনুসারে এ হিসাবে তারা পেত মাত্র ১৪৪টি আসন।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) শরিকদের ছেড়ে দেয়ার পর ২৬০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তাদের প্রাপ্ত মোট ভোট ২,২৭,৫৭,১০১ যা মোট ভোটের ৩২.৫০ শতাংশ। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতিতে এ হিসাবে তারা পেত ৯৭টি আসন। অথচ তারা লাভ করেছিল মাত্র ৩০টি।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মোট ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তাদের প্রাপ্ত ভোট ৩২,৮৯,৯৬৭। মোট ভোটের ৪.৭০ শতাংশ। তারা আসন পেয়েছিল মাত্র দু’টি। অথচ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে তারা পেত ১৪টি আসন।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন হলে জাতীয় সংসদে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তিশালী অবস্থান থাকত। জনগণের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগ কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার সুযোগ ও সাহস পেত না। ছোট-বড় যত রাজনৈতিক দল মাঠে আছে, সবার প্রতিনিধিত্বে জাতীয় সংসদ সত্যিকারে জনগণের সংসদে পরিণত হতো। জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে আওয়ামী লীগ সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সুযোগ পেত না।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতির সুফলের কথা চিন্তা না করে যারা এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারা মনে করছেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে এখনই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে পারবেন। তারা হয়তো ভুলে গেছেন, দিন বদলের পালায় অবস্থার পরিবর্তন হতে সময় লাগে না।
তাই স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার পথ বন্ধ করতে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতি একটি উপায় । আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশ পায় তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবে।

এ পদ্ধতিতে ভোট হলে ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল কেমন হতো, বিশ্লেষণ করলেই প্রমাণ হবে। সংখ্যানুপতিক নির্বাচন হলে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার সুযোগ পেত না। পাল্টা যুক্তিও অবশ্য আছে। তা হলো তখন তারা ব্যালট বাক্স ভরে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বাড়াতো। এ জন্যই বলা হচ্ছে, আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও ফিরিয়ে আনতে হবে। এর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে।

প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থার সমালোচনা করে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেন, এটি হলো সংখ্যালঘিষ্ঠের শাসনব্যবস্থা। কারণ বর্তমান বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচনব্যবস্থায় ৩০০টি আসনে আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলোয় যারা নির্বাচিত হন, তারা আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠের না সংখ্যালঘু ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ধরা যাক, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল থেকে নির্বাচন করছেন। এ নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ করে ভোট পেলেন। আর চতুর্থ প্রার্থী পেলেন ২৫ শতাংশ ভোট। বর্তমান পদ্ধতিতে চতুর্থ প্রার্থীই এ আসন থেকে নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট কোনো কাজেই আসছে না। একইভাবে সারা দেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করে, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য করবে। অথচ বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকল না সংসদে।

স¤প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচনব্যবস্থা চালু রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি দেশ, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।

শক্তিশালী সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। পতিত হাসিনা সরকার তার বড় প্রমাণ। তাই শক্তিশালী নয়, জনগণের সরকার বেশি দরকার। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রভাববলয় গড়ে তুলতে অনেক ক্ষেত্রে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তারা এলাকার উন্নয়নের নামে স্থানীয় সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করেন। দলাদলি ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেন। এভাবে এমন নেতিবাচক কাজের বিস্তার তাদের হাতে ঘটতে থাকে, যার ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থা জনকল্যাণমূলক চরিত্র হারিয়ে মাফিয়াদের বাণিজ্যিক ক্লাবে পরিণত হয়।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সংসদ কোনো সিদ্ধান্ত জাতির জন্য ইতিবাচক ও কল্যাণকর মনে করলে অবশ্যই পাস করবে। দেশপ্রেমিক কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য আপত্তি করবে না।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement