২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মন্ত্রীদের পিএস-এপিএস নিয়োগে গোয়েন্দা ছাড়পত্র

- প্রতীকী ছবি

ছাত্র-ছাত্রীরা যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করছিলেন, তখন রাস্তায় যানজট দেখা দেয়ায় ব্যানারে লেখা থাকত, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।’ এটি জুলাই-আগস্টের ছাত্র-আন্দোলনে বহুল ব্যবহৃত বাক্য। এর রেশ ধরে আমরা সংস্কার শব্দের অর্থ জানার চেষ্টা করতে পারি। সংস্কার শব্দের বাংলা অর্থ- মেরামত করা, সংশোধন করা। আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে ‘সংস্কার’ পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন শব্দ বলে মনে হয়। এই শব্দটির সামনে যখন রাষ্ট্র শব্দটি বসিয়ে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ বলা হয় তখন তা আরো কঠিন হয়ে ওঠে।

আমরা একটি উচ্চপর্যায়ের ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় বাস করছি। যেখানে দিনশেষে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যই ভোগ। আমাদের সামাজবাস্তবতায় মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড অর্থের মাপকাঠিতে নির্ধারিত। এখানে সততা, ত্যাগ মূল্যহীন। ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রম ভোগবাদী জীবন নিশ্চিতকরণে পরিচালিত। বাংলাদেশে শিক্ষা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, চাকরি, রাজনীতি সব কিছু ভোগের জন্য হয়ে থাকে। যার কারণে গড়ে উঠেছে একটি নীতিবিবর্জিত অমানবিক সমাজ।
২.
রাষ্ট্রকে যদি একটি জাহাজের সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন বা চালক সরকার অর্থাৎ রাজনীতিবিদরা। ইঞ্জিনসহ আমলারা হচ্ছে জাহাজের ক্রু (সরকারি মেশিনারিজ)। জাহাজের যাত্রী দেশের জনগণ। জাহাজযাত্রীদের নিরাপদে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হলে যেমন প্রয়োজন সৎ, নৈতিক, দক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ চালক, একইভাবে জরুরি ব্যক্তি বা একক কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নৈতিক গুণাসম্পন্ন ও আদর্শে উন্নত দক্ষ ক্রুসহ, মজবুত সিস্টেমে তৈরি ইঞ্জিন।

গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের চালক পাঁচ বছর পরপর বদলান। কিন্তু ক্রু ও ইঞ্জিন সহজে পরিবর্তন হয় না। তাই পুরো সিস্টেম এমনভাবে সংস্কার করতে হবে; যাতে যিনিই রাষ্ট্র চালনায় দায়িত্বে আসুন না কেন; চালক এবং ক্রু ও ইঞ্জিনের মধ্যে আনুগত্য এবং সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠলেও তা যেন দাসত্ব কিংবা একক কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা না করে। সঙ্গত কারণে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে; যাতে এটি নিশ্চিত করা যায় যে, সরকারের প্রতি আমলাতন্ত্র ততক্ষণ পর্যন্ত অনুগত থাকতে বাধ্য, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা দেশ ও নাগরিক স্বার্থে কাজ করবেন।
৩.
বাংলাদেশে বেশির ভাগ দুর্নীতি হয়েছে ক্ষমতায় আসা প্রতিটি সরকারের এমপি, মন্ত্রীদের পিএস, এপিএস অথবা পিএ’র মাধ্যমে। কিছু ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত সচিব- মন্ত্রী বা মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এটি দুঃখজনক বাস্তবতা যে, অনেক প্রাইভেট সেক্রেটারি ক্ষমতার ফাঁদে পড়ে, মন্ত্রীর চেম্বারসংলগ্ন একটি কক্ষে তাদের অবস্থানের সুবাদে প্রলুব্ধ হন। এমনকি যদি ধরে নেয় হয়, সব প্রাইভেট সেক্রেটারি সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, তবু দুই-তিন বছর পরে তাদের পরিবর্তন করা উচিত। একটা কথা এখনে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, দায়িত্ব পালনের সময় আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি যে, একজন এপিএসের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদন থাকার পরও তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেয়ায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে গুরুতর অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মন্ত্রীকে পোর্টফোলিও থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল।
৪.
আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে শুধু মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরাই বিপুল সম্পদের মালিক হননি, তাদের পিএস, এপিএসরাও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এক সংবাদ সম্মেলনে তার পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম ৪০০ কোটি টাকার মালিক এবং হেলিকপ্টার ছাড়া সে যাতায়াত করে না বলে অকপটে স্বীকার করেন।

সাবেক আইনমন্ত্রীর দুই পিএ আলাউদ্দিন বাবু ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ চাকরি ও বদলিবাণিজ্য, মাদকচক্র পরিচালনা, পাহাড় কাটা, মামলা দিয়ে হয়রানি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করেননি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ঘুষ হিসেবে বস্তা বস্তা টাকা নিতেন। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এ টাকা আদায় করা হতো এবং তার পিএস অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে এ দুষ্টচক্র গড়ে তোলেন।
৫.
সুশাসন নিশ্চিত করতে ২০১৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের পিএস/এপিএস ঠিক করে দিলেও এপিএস নিয়োগপ্রক্রিয়া আটকে আছে এবং এখনো এপিএস নিয়োগ দেয়া হয় মন্ত্রীদের নিজের পছন্দমতো। মন্ত্রী নিজে যে সব কাজ ভাবমর্যাদার খাতিরে সশরীরে করতে পারতেন না, সেসব ছাই ফেলতে ভাঙা কুলার কাজ করতেন এসব এপিএসের দল। তারা হয় মন্ত্রীর আত্মীয় অথবা দলের ছাত্র শাখার প্রাক্তন নেতা। মন্ত্রী নিজে ঘুষের বখরা নিতে অধস্তন চোর আমলার কাছে যেতে পারেন না, তাই তার হয়ে সেখানে যান তার এপিএস। এপিএস মূলত মন্ত্রীর ‘পাপেট’।

গত কয়েক দশক থেকে দেখে আসছি, এদেশে যারা জনসেবার দায়িত্ব পান, দেখা যায়, দায়িত্ব পাওয়ার পর তাদের ব্যক্তিগত জীবন ভোগবিলাস, চাকচিক্যে ভরে ওঠে। বাংলাদেশে রাজনীতি মানে পুঁজিবিহীন দ্রুত মুনাফা আহরণের ব্যবসা। আর উন্নয়ন মানে- সেবক নামধারী নেতাদের মুনাফা আহরণের ক্ষেত্র। তাই এখনই সময় এ পুরো পদ্ধতি ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলার, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রকে স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার বানাতে পারবেন না।
৬.
আগে এনএসআই থেকে মন্ত্রী-এমপিদের পিএস এবং এপিএসের ব্যাপারে ছাড়পত্র নেয়া হতো। কিন্তু পরে ব্যবস্থাটি লুপ্ত হয়ে যায়। যদিও এটি সিস্টেমের ক্ষতি করছে, কারণ আমরা ইতোমধ্যে সুস্পষ্টভাবে দেখেছি যে- বেশির ভাগ দুর্নীতি হয় মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মীর মাধ্যমে। সুতরাং, এসব পদে নিযুক্ত যেকোনো ব্যক্তির জন্য অবশ্যই এনএসআই ও পুলিশ (এসবি) উভয়ের ছাড়পত্র থাকতে হবে। একজন ব্যক্তিগত সচিবের জন্য রাষ্ট্রীয় গোপনীয় তথ্য অ্যাক্সেস করতে বা এমন একটি অবস্থানে কাজ করতে নিরাপত্তা ছাড়পত্রের প্রয়োজন হতে পারে; যার জন্য জনআস্থার প্রয়োজন।

সরকার একজন মন্ত্রীর নিয়োগ করা ব্যক্তিগত কর্মীর চরিত্র এবং পূর্বসূরি যাচাই করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে পারে। এনএসআইয়ের যাচাই-বাছাই সম্পূর্ণ হওয়ার আগে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মীর মধ্যে একজন বেসরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ করা যাবে না। এ সময়ের মধ্যে সরকারের ডিএস থেকে কেউ একজন তার পিএস হিসেবে কাজ করতে পারেন।

আমাদের দেশে দুর্নীতির প্রধানতম কারণ, বল্গাহীন লোভ এবং ভয় থেকে মুক্ত থাকা। আইনের শাসন না থাকা ও দুর্নীতিবাজদের দ্রুত সময়ে বিচার না হওয়া। এ ছাড়া নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাব ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জবাবদিহির অভাব দুর্নীতির উল্লেখযোগ্য কারণ। তাই এসব দুর্নীতি রোধে মন্ত্রীদের পিএস, এপিএস, পিএ নিয়োগে গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স চালু করা দরকার, পাশাপাশি আমলাতন্ত্রের সাথে সরকার এবং এমপি-মন্ত্রীদের দাসত্বের সম্পর্ক রোধে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ তৈরি এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামো প্রণয়নে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সাথে সবসময় কঠোর গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সিস্টেমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অন্তর্নিহিত প্রতিরোধ। দুর্নীতি আমাদের সব প্রতিষ্ঠান অকার্যকর করে তুলেছে। দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি দিয়েছে। এর মূলে গোয়েন্দা বিভাগগুলোর ব্যর্থতাও দায়ী। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের দুর্বল পারফরমেন্সের কারণ খুঁজে বের করা খুব কঠিন নয়। শুধু প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

অন্তর্বর্তী সরকার এখনই এ ধরনের ব্যবস্থা চালু করতে পারে। এটি এখনই বাস্তবায়ন করা না হলে পরে নির্বাচিত সরকারের পক্ষে সংস্কার বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও প্রোভিসি, বিইউপি


আরো সংবাদ



premium cement