১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নির্বাচনই কি গণ-অভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা

- ছবি : সংগৃহীত

ঝড়ে অনেকেই আম কুড়ায়। জাতীয় জীবনেও এমনটি ঘটতে পারে, ঘটছে। ছাত্র-জনতার ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের অংশীদারত্ব দাবি করছে বিভিন্ন মহল। করছে পৃথকভাবে সহি শুমারি। হাজারো দাবি-দাওয়ার হিড়িকে অনেকটাই বেসামাল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এসব দাবিদারদের কাতারে শামিল হয়েছে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলও। অতি দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে তারা সোচ্চার। গণ-অভ্যুত্থানের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই এসব রাজনৈতিক দল ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আওয়াজ তোলে। মাঝে কিছুটা সময় দম নিয়ে এখন এসেছে প্রকাশ্যে। সবশেষ রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অপসারণ নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছে সাংবিধানিক সঙ্কটের। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি না হলে চুপ্পুর অপসারণে কেন তা হবে এ প্রশ্ন থেকেই যায়। গণ-অভ্যুত্থানের তিন মাস অতিক্রান্ত না হতেই অন্তর্র্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী নেতাদের সাথে রাজনীতিকদের এমন মতানৈক্য বহন করছে ভিন্ন বার্তা। প্রকারান্তে যা শক্তি ও সাহস জোগাবে পতিত স্বৈরাচারকে।

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দানা বাঁধেনি। কোটাবিরোধী থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায় অভ্যুত্থান। দেশজুড়ে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে শামিল করে জনগণকে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল তাতে। ৩৬ দিনের আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ নতুন মাত্রার। ভিন্ন ছিল ¯েøাগানের সুর। দেয়ালের লিখনগুলো সমৃদ্ধ ছিল নতুন চিন্তা-চেতনায়। ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনের মূল আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার। রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি সামনে রেখে তারা প্রস্তাব করেছে নতুন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের। রাষ্ট্রের কিছু মৌলিক বিষয়ে সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে কয়েকটি কমিটি।

নানা প্রতিক‚লতার মধ্যেও থেমে নেই সরকারের প্রচেষ্টা। ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া জঞ্জাল পরিষ্কার করতে সংস্কারের জন্য প্রয়োজন অনেকটা সময়ের। রাজনৈতিক দলগুলো এ জন্য সরকারকে আশ্বাসও দেয় যৌক্তিক সময় দেয়ার। জনগণ বিষয়টি মেনে নিয়েই ‘আগে রাষ্ট্র সংস্কার পরে নির্বাচন’ নীতিতে দেশ পরিচালনায় সম্মতি দেয় সরকারকে। কিন্তু হঠাৎ করেই অতি দ্রুত নির্বাচনের দাবি ওঠায় আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে জনমনে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দীর্ঘ দেড় দশকের দুঃশাসনে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা নজিরবিহীন নিপীড়ন-নির্যাতন, জেল-জুলুম গুম ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে। এসব কারণে নির্বাচনের দাবি উঠতেই পারে। তবে এবারের গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে সবাইকে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও মিছিলে যেমন নির্বাচনের দাবিতে উচ্চারিত হয়নি কোনো শব্দ, তেমনই কোনো দেয়াল লিখনে স্থান পায়নি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ। রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হবে রাজনীতির মাঠে ‘এ’ টিম ও ‘বি’ টিমের জার্সি বদলের খেলা। রাজনীতির প্রচলিত এ খেলা থেকে বেরিয়ে এসে ফ্যাসিবাদ সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করতেই প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।

রাজনীতিকদেরকে বুঝতে হবে দীর্ঘ দু’দশকে তারা যা করতে পারেননি নতুন প্রজন্ম জীবন দিয়ে তা করেছে। বাংলাদেশে নবজাগরণের সৃষ্টি করে তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্বৈরশাসক যত শক্তিশালীই হোক না কেন, গুঁড়িয়ে দেয়া যায় তার ভিত। ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আত্মোৎসর্গ করে প্রমাণ করেছে তাদের দেশপ্রেম। নতুন প্রজন্মকে নিয়ে যারা এতদিন ছিলেন হতাশায় এবং অন্ধকারে, শিক্ষার্থীরা বাতিঘরের সন্ধান দিয়েছে তাদেরকে। সুদূরপ্রসারী একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভীতি অনেক দিন ধরেই কুরে কুরে খাচ্ছিল তাদের আকাশসম স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা, কথা বলা, চিন্তার বিকাশ ঘটানোর সব কপাট রুদ্ধ করে দিয়ে জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা তারা সময়মতো আঁচ করতে পারে। বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দিয়ে শহীদ হয়েছে তারা। শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি। তাদের ত্যাগ, চিন্তা, চেতনাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

কোটি টাকার প্রশ্ন নির্বাচনই কি গণতন্ত্রের শেষ কথা? নির্বাচন হলেই কী দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়? কায়েম হয় আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা? নিশ্চিত হয় বাক-ব্যক্তি ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা? দেশে জাতীয় সংসদের ১২টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও কাক্সিক্ষত গণতন্ত্রের দেখা মেলেনি দেশটিতে। বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয় স্বাধীনতার পরপরই। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা গণতন্ত্রের কবর রচনা করে কায়েম করা হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা। অর্ধ শতাব্দী পরও অব্যাহত রয়েছে এর ধারাবাহিকতা। ফলে রাষ্ট্রের চেয়ে দল, দলের চেয়ে বড় হয়ে উঠে ব্যক্তি বিশেষ। প্রতিহিংসা, ব্যক্তি পূজার রাজনীতির ব্যাপকতা হয়েছে দুর্দমনীয়। বড় দলগুলোতে নেতৃত্ব বিকাশের পথ রুদ্ধ।

কার্যত ব্যবসায়িক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে দলগুলো। মনোনয়ন ও কমিটি বাণিজ্যের কারণে অনেক রাজনৈতিক দলে বিগত ১৮ বছরে বেরিয়ে আসেনি নতুন কোনো নেতা। যেসব দলে গণতন্ত্রের চর্চা নেই, শীর্ষ নেতৃত্বের জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই, সেসব দল রাষ্ট্রে কিভাবে গণতন্ত্র কায়েম করবে? আগামীতে নির্বাচন আয়োজন করা হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে? শীর্ষ নেতারে সহায় সম্পত্তি বাড়াবে অবাধ মনোনয়ন বাণিজ্য। একদল ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, প্রাক্তন আমলা, মাস্তান দিয়ে আবারো শোভিত হবে জাতীয় সংসদ। সরকারি প্লট, ফ্ল্যাট, শুল্কমুক্ত গাড়ি, ব্যাংকঋণ, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়তে নতুন উদ্যমে হামলে পড়বে তারা। নবনির্বাচিতরা মুণ্ডুপাত করবে গণতন্ত্রের। এভাবেই গড়ে উঠবে নব্য আরেকটি ধনিক-বণিক ফ্যাসিবাদী শ্রেণী। নির্বাচনে সরকার বদলেছে বারবার কিন্তু মৌলিক গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি রাজনীতিতে।

রাষ্ট্রের অবহেলিত নাগরিকরা চান সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও বৈষম্যের অবসান। এ জন্যই নির্বাচনের আগে দাবি উঠেছে রাজনৈতিক সংস্কারের। নির্বাচন দু’বছর পরে হোক অসুবিধা নেই। যেসব কারণে সরকার ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠে রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে সেসব রাস্তা। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে আনতে হবে সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর আওতায়। গণভোটে এই কাঠামোর পক্ষে রায় নিতে হবে জনগণের। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ও শোধন প্রয়োজন। সংস্কারের কাজে অবশ্যই সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। স্থায়ী এবং টেকসই গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক সংস্কার ও সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, নির্বাচনই গণ-অভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা নয়।

লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক


আরো সংবাদ



premium cement
অনুশোচনা নেই আওয়ামী লীগে, যে অপেক্ষায় তারা রাতে মাঠে নামছে চিরচেনা ব্রাজিল, ভোরে বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা কাঁঠালিয়ায় মোটরসাইকেলচাপায় গৃহবধূ নিহত, আহত ২ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এখনো শেষ হয়নি : মাহমুদুর রহমান সাবেক এমপি টিপুকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করল জনতা বিএলআরআইয়ের ভূমিকা হওয়া উচিত দেশীয় জাত সংরক্ষণ : ফরিদা আখতার কেউ যাতে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে না পারে : আসিফ নজরুল প্রশাসক নিয়োগ করে পোশাক কারখানায় সমস্যা সমাধান সম্ভব? খুলনায় পাটের বস্তার গোডাউনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট ৯টি ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি গঠন তিন দিনের মধ্যে এনআইডিকে ক্যাটাগরি করার নির্দেশ ইসির

সকল