১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এক নারী নেত্রীর খোঁজে আওয়ামী লীগ

- ছবি : নয়া দিগন্ত

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার দল আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। আসলে চলে গেছেন না বলে বলা যেতে পারে, তারা তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার্থে মানুষের সামনে আসতে ভয় পাচ্ছেন। তাদের ধারণা, তারা মানুষের সামনে এলে গণপিটুনির শিকার হবেন। তাদের ধারণা একেবারে অমূলক নয়। কারণ গত ১৭ বছর তারা সাধারণ মানুষের সাথে যে আচরণ করেছেন অর্থাৎ গুম-খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সম্পত্তি দখল, অর্থ আত্মসাৎ ইত্যাদি সব ধরনের অপকর্মের জন্য মানুষ তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।

অতীতে যখনই আওয়ামী লীগ সঙ্কটে পড়েছে তখনই তারা একজন নারীকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে তার আঁচলের পেছনে মুখ লুকিয়েছে। এবারো তারা সম্ভবত একজন নারীকে সামনে নিয়ে আসতে চাচ্ছে যে কারণে নারায়ণগঞ্জের সাবেক নির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর নাম আলোচনায় এসেছিল। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করার পর পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতাদের ধরপাকড় শুরু করে। সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান, দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদসহ দলের কেন্দ্রীয় অনেক নেতাকে গ্রেফতার করার পর দলের কার্যক্রম চালানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠলে দলের মহিলা সম্পাদক আমেনা বেগমকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়।

ভারতীয় গবেষক শ্যামলি ঘোষ তার ‘আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-১৯৭১’ বইয়ে আমেনা বেগম সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমেনা বেগম ১৯৫৩ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি সমাজকর্মের জন্যই মূলত রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৬০ সালের মার্চে কাউন্সিল সভায় তাকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার সম্পাদক করা হয়, আর সেই সুবাদে পদাধিকার বলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও ছিলেন। দলে একজন মহিলা সম্পাদক নেয়ার মূলে স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে নারীর অংশগ্রহণ আরো জোরদার করে তোলা। ঘটনাচক্রে তাকে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের দায়িত্বভার নিতে হয়। বাস্তবিকপক্ষে তাকেই স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় পরিচালনা করতে হয়। তার অনভিজ্ঞতা সত্তে¡ও এই স্তরে জনগণকে সুসংগঠিত করার অভিযান ক্ষুণœ হয়নি; বরং এ আন্দোলন অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলে, আর সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানিদেরকে আরো আগামী ঘটনাবলি যেমন- ১৯৬৮-৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী বিক্ষোভের জন্য তৈরি করে। ইতোমধ্যে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে আরো এক গুরুতর সাংগঠনিক সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের মর্যাদার প্রশ্নটিকে রীতিমতো হুমকির মুখে ফেলে। আমেনা বেগমও সঙ্কটসঙ্কুুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দেন। (পৃষ্ঠা-১৪২)

কিন্তু দুঃখের বিষয়, শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে এসে আমেনা বেগমকে দলের মধ্যে কোণঠাসা করে ফেলেন। যার ফলে আমেনা বেগম দল থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খানের দল জাতীয় লীগে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের সাথেও একই রকম আচরণ করা হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদও শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব দিয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সাফল্যের সাথে এগিয়ে নিয়েছিলেন।

এরপর ১৯৭৫ সালে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ আবারো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে। দলের প্রধান পাঁচজন নেতা নিহত হওয়ার পর মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দীন আহমদের বিধবা স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আহ্বায়িকা হিসেবে দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা শারমিন আহমদ ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইয়ে লিখেছেন ...১৯৭৫ সালে জাতীয় নেতৃবৃন্দের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর এই জাতির চরম দুর্র্দিনে, নেতৃত্বের মহা সঙ্কটপূর্ণ সময়ে আহ্বায়িকা হিসেবে তার জীবনসাথীর প্রাণপ্রিয় দলটির হাল ধরেন। ত্যাগ ও সাহসিকতার সাথে মৃত আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানে অনন্য ভ‚মিকা পালন করেন। এমনকি যে সময় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনকালে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে মানুষ ভয় পেত, সেই দুঃসময়ে আম্মার নিঃস্বার্থ ও নির্ভয় নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে আর্মি পুলিশের বাধা সত্তে¡ও ৩২ নম্বর রোডের সামনে প্রকাশ্য সভা করে ১৫ আগস্ট ১৯৭৭, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিনটি শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়। (পৃষ্ঠা-৩৫)

জোহরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘর গুছিয়ে নেয়ার পর ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সাবেক স্পিকার আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি ও আবদুর রজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন একটি কমিটি গঠিত হয়। নতুন কমিটি হওয়ার পর দলের ভেতর কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের আগস্টে মিজানুর রহমান চৌধুরী আরেকটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। ফলে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই বিভক্তি সামাল দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দিল্লিতে অবস্থানরত মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। ড. কামাল হোসেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সম্মতি আদায় করতে সক্ষম হন। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার কয়েক দিনের মধ্যে জিয়াউর রহমান নিহত হন। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। আর জিয়াউর রহমান ৩০ মে এক ব্যর্থ সেনাঅভ্যুত্থানে চট্টগ্রামের একটি সার্কিট হাউজে নিহত হন।

দলের নেতৃত্ব গ্রহণের পর শেখ হাসিনা যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে দল পরিচালনা করেন এবং গণধিকৃত অবস্থা থেকে দলকে বের করে এনে বিএনপির বিকল্প রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করাতে সক্ষম হন। ফলে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার সরকার গঠন করে। তিনি দলের ভেতর আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে সংঘটিত বিদ্রোহ দমন করেন এবং ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে আব্দুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাও বানচাল করে দলের ভেতর শেখ পরিবারের আধিপত্যের দৃঢ় ভিত্তি দান করেন। লক্ষ্যণীয় শেখ হাসিনাও দল পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে রাষ্ট্রের মর্যাদাবান পদে অধিষ্ঠিত করেননি।

এখন দেখা যাক, আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের জন্য দলের নেতারা কাকে খুঁজে বের করেন? এবার অবশ্য বিষয়টি বেশ কঠিন। কারণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গত ৪৭ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে মেনে নিতে রাজি হবে কি না, আবার শেখ হাসিনাও দলের নেতৃত্ব অন্য কারো হাতে ছেড়ে দিতে সম্মত হবেন কি না, সেই প্রশ্ন আছে।


আরো সংবাদ



premium cement
অনুশোচনা নেই আওয়ামী লীগে, যে অপেক্ষায় তারা রাতে মাঠে নামছে চিরচেনা ব্রাজিল, ভোরে বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা কাঁঠালিয়ায় মোটরসাইকেলচাপায় গৃহবধূ নিহত, আহত ২ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এখনো শেষ হয়নি : মাহমুদুর রহমান সাবেক এমপি টিপুকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করল জনতা বিএলআরআইয়ের ভূমিকা হওয়া উচিত দেশীয় জাত সংরক্ষণ : ফরিদা আখতার কেউ যাতে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে না পারে : আসিফ নজরুল প্রশাসক নিয়োগ করে পোশাক কারখানায় সমস্যা সমাধান সম্ভব? খুলনায় পাটের বস্তার গোডাউনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট ৯টি ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি গঠন তিন দিনের মধ্যে এনআইডিকে ক্যাটাগরি করার নির্দেশ ইসির

সকল