১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাংলাদেশের সংবিধান : দ্বিতীয় জনতন্ত্র গড়ার প্রত্যাশা

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ একটি দুঃস্বপ্নের যুগ পেরিয়ে এসে নতুন যুগের স্বপ্ন দেখছে। একে বলে ক্রান্তিকাল। এখন দরকার নতুন ও ‘সময়োপযোগী’ এবং সম্ভব হলে ‘কালোত্তীর্ণ’ একটি গঠনতন্ত্র বা জাতি গঠনের দলিল। বিদ্যমান সংবিধানটি, বাংলাদেশের স্বপ্নের নতুন যুগের উপযুক্ত নয় এবং তা সংস্কারের অযোগ্য, বলেছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। এ বাস্তবতায় একটি নতুন গঠনতন্ত্র তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে।

সংবিধান (গঠনতন্ত্র) : সারকথা
‘রাষ্ট্র বা সংগঠন পরিচালনার মূলনীতি বা প্রতিষ্ঠিত পূর্ব নজিরগুলোর মিলিত রূপই সংবিধান বা গঠনতন্ত্র।’ এরিস্টটলের মতে, ‘নিজেদের শাসন/পরিচালনার জন্য জনগণের বাছাই করা জীবনবিধানই সংবিধান।’
বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে তিন ভাগে বিষয়টি আলোচিত হবে :
ক. বিদ্যমান আলোচিত বিষয়াদি;
খ. নতুন আলোচিত বিষয়াদি;
গ. আমাদের প্রস্তাবনা।

‘বিদ্যমান বিষয়াদি’ বলতে ০৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান-পূর্ববর্তী বিষয়াদি বোঝানো হবে।
ক. সংবিধানে বিদ্যমান বিষয়াদির মধ্যে সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ স্থাপন ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ উল্লেখযোগ্য। নতুন সংবিধানে এগুলো রাখতে সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতি রয়েছে বলে দাবি করা হয়। দাবিটি ঠিক হলে মানা উচিত।

খ. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে (১০ এপ্রিল ১৯৭১) ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’-এই তিন রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ঘোষণা ছিল। এ বিষয়ে কোনো ভিন্নমত উঠেনি। পরে মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) চলাকালে, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীচুক্তি সূত্রে নতুন চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আবির্ভাব ঘটে : গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষতা (সেকুলারিজমের বাংলা হিসেবে) ও সমাজতন্ত্র বিষয়ে জাতীয়পর্যায়ে ব্যাপক ভিন্নমত ও অসন্তোষ ছিল। আর ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ চাইতে ‘ভালো ও কার্যকর’ ‘জাতীয়তাবাদ’-এর দাবি ছিল। জিয়াউর রহমানের শাসনকালে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থলে, যথাক্রমেÑ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এবং ‘সামাজিক সুবিচার অর্থে সমাজতন্ত্র’ প্রতিস্থাপন করা হয়। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এ পরিবর্তন সংবিধানের অংশ হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিষয়ে ফের ভিন্নতা আনা হয়। নতুন কাক্সিক্ষত সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী অনুসরণের দাবি রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের।

গ. ৫ আগস্টের আগেই দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি ‘রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা’ উপস্থাপন করে। সেখানে সরকারের নির্বাহী ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রস্তাব করা হয়। আরো বেশ কিছু দল তাতে সম্মতি দিয়েছে। এখন বিবেচ্য, ‘ক্ষমতার ভাগাভাগি কিভাবে হবে’। এ ক্ষেত্রে ফরাসি মডেলসহ কিছু অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যাবে।

ঘ. বিএনপির প্রস্তাবিত ৩১ দফার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ‘একাদিক্রমে’ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না করার প্রস্তাব আছে। আর প্রেসিডেন্টের একাদিক্রমে দুইবারের বেশি নির্বাচিত না হওয়ার বিধান বিদ্যমান রয়েছে। নতুন দাবি আসছেÑ ‘দলীয় প্রধান’-এর ক্ষেত্রেও এ নীতির প্রয়োগের। এ দাবির মূলকথা, কেউ যেন আবার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার সুযোগ না পান।

ঙ. বিদ্যমান সাংবিধানিক বিতর্কের একটি হলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বা ‘দলীয় সিদ্ধান্তের কাছে ব্যক্তি আইন প্রণেতার বিবেক বিসর্জন’ দেয়ার বিষয়টি। ‘দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেয়া’ বা ভোটদানে বিরত থাকাকে একজন ব্যক্তি আইন প্রণেতার ‘সংশ্লিষ্ট দলটি ত্যাগ করার’ সমতুল্য বিবেচনা করা হয়েছে এই অনুচ্ছেদে। আর দল ত্যাগের শাস্তি হচ্ছে আইন প্রণেতার সদস্যপদ বাতিল হওয়া। এ বিষয়ে প্রস্তাব হলোÑ সংবিধান সংশোধন ও অর্থবিল বা বাজেটের মতো বিষয়কেই কেবল ‘দলীয় সদস্য পদ ত্যাগের’ সমতুল্য বিবেচনা করা যাবে। অন্য যাবতীয় বিষয়-ইস্যুতে আইন প্রণেতা ভোট প্রদানে স্বাধীন থাকবেন। এ প্রস্তাবের আলোকে ‘৭০ অনুচ্ছেদ পুনর্গঠন’ করতে হবে।

চ. বিদ্যমান ৭৭ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগের বিধান আছে। ১৯৮০ সালে এ বিষয়ে ‘কিছু মনোযোগ’ দেয়া হলেও কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রায় সবগুলো মন্ত্রণালয় বিষয়ে পৃথক অথবা আপাতত কয়েকজন ন্যায়পাল নিয়োগ সময়ের দাবি।

ছ. ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ও বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি ‘সংবিধান অনুমোদিত অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী বিভাগ’ গঠিত হয়েছিলÑ সেটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’।

২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করা হয়নি। জনগণের সম্মতিও নেয়া হয়নি। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক নির্বাহী বিভাগ প্রতিষ্ঠা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবি।

জ. নির্বাচন, বিশেষত জাতীয় নির্বাচন, স্বচ্ছতার কৌশল বিষয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। একটি সক্ষম নির্বাচন কমিশন গঠন ও উপযুক্ত আইনি-প্রশাসনিক সহায়তার মাধ্যমে স্বচ্ছ নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। নতুন সংবিধানে এ বিষয়ে উপযুক্ত বিধানাবলি থাকা চাই।

ঝ. গণভোটের বিধান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে সেটি বাতিল করা হয়। দ্বিতীয় রিপাবলিকে ‘পাবলিক’-এর এই রাজনৈতিক স্বীকৃতি থাকতে হবে।

ঞ. বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথকীকরণের অনিবার্য দাবি হিসেবে নিম্নআদালতের নিয়ন্ত্রণ-পরিচালনার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করতে হবে।

সংবিধানের নতুন আলোচিত বিষয়াদি হলো ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরে তোলা ধারণাসমূহ :
ক. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ধারণাটি অবশ্য বিএনপির স্বীকৃত ৩১ দফারও অংশ। তবে ৫ আগস্টের পর এটি আবারো গুরুত্ব পেয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের ধারণা, একটি পূর্ণরূপের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা না করেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যপানে এগোনো সম্ভব। একটি ‘পুরোদস্তুর’ উচ্চকক্ষ স্থাপনের সাথে অনেক দায় ও বহুমাত্রিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মেনে নিতে হবে রাষ্ট্রকে। যেমনÑ উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার সাথে বিপুল রাজস্ব ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত। এর সদস্যদের জন্য বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের সাথে নির্দিষ্ট সংখ্যক স্থায়ী জনবলের সংস্থান করতে হবে, যা ব্যয়সাপেক্ষ। আইনসভার দুই কক্ষের পারস্পরিক বোঝাপড়ার নতুন অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে হবে কিছু সময়। তবে এ বিষয়ে অন্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যাবে।

সমাজ-রাষ্ট্রের অরাজনৈতিক, নির্দলীয় বা ধ্রæপদী ‘দলীয় ব্যস্ততায়’ অনাগ্রহী-অনভ্যস্ত পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞদের ‘আইনসভা সংশ্লিষ্ট সেবা-অবদান’ বাংলাদেশ অন্যভাবেও নিতে পারে। বাংলাদেশ বর্তমানে জনগণের নির্বাচিত ৩০০ সদস্য ও সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত ৫০ জন সংরক্ষিত নারী সদস্য ‘আইন প্রণেতার’ দায়িত্ব পালন করেন।

সংরক্ষিত নারী সদস্যের বিষয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে। বাংলাদেশে নারীরা আর ‘পিছিয়ে থাকা’ জনগোষ্ঠী নয়। তারা রাজনীতিতে সক্রিয়তার মাধ্যমে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতে পারেন। এর পরিবর্তে আনুপাতিক হারে (পিআর প্রক্রিয়ায়) ৭৫ জন পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত করা যেতে পারে। সরাসরি নির্বাচিত ৩০০ আসনের অনুপাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে এই ৭৫ জন পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হবেন। তাতে প্রস্তাবিত উচ্চ বা দ্বিতীয় কক্ষ সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য সব সমস্যা ও জটিলতার আপাতত সুরাহা হবে।

খ. ৫ আগস্টের পর নির্বাচন বিষয়ে যে দাবিটি বেশি আলোচিত তা হলোÑ সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব।

একটি দল সারা দেশের মোট ভোটের প্রাপ্ত শতাংশের সমানুপাতে জাতীয় সংসদে আসন পাবে, এটিই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর)।

বড় দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী বেশ আগে থেকেই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি করে এসেছে। এবারো তারা এ দাবি তুলেছে। আরো কিছু দল তা সমর্থন করেছে।

কিন্তু বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি এই পদ্ধতি সমর্থন করছে না বলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে সামাজিক মাধ্যম ও দেশের গণমাধ্যমে কিছু রিপোর্টে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতি পলাতক রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনে সহায়ক হবে বলে দাবি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পিআর পদ্ধতির দাবিটি আপাতত জনসমর্থন পাচ্ছে না বলেই মনে হয়।

গ. ‘নানামাত্রিক জবাবদিহি’ নতুন আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম। নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন অঙ্গ এবং আইনসভার জবাবদিহির বিষয়গুলো সংবিধানে সন্নিবেশ করার দায় রয়েছে।

ঘ. সেবা ও পণ্যের সম্ভাব্য বিকেন্দ্রীকরণের দাবি উঠেছে ইতোমধ্যে। বিচার, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো সেবা আর প্রয়োজনীয় পণ্য রাজধানী ঢাকা ও প্রধান শহর চট্টগ্রাম-রাজশাহীভিত্তিক না রেখে, অন্তত বৃহত্তর জেলাপর্যায়ে নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার। নিম্ন আদালতের কার্যক্রমের বৃহৎ অংশ উপজেলা পর্যায়ে সম্পন্ন করা গেলে নাগরিকদের হয়রানি কমবে। এর মানে হলো, সেবা ও পণ্যের সুবিধা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় দালিলিক অঙ্গীকার দাবি করা হচ্ছে।

ঙ. আইনপ্রণেতা ও বিচারকের জন্য ‘বর্ধিত যোগ্যতা’র দালিলিক অঙ্গীকার চাওয়া হচ্ছে। আইনসভার সদস্যের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত বিষয়ে সাংবিধানিক নির্দেশনা থাকা দরকার। সেই সাথে মাত্র ১০ বছরের আইনজীবীত্বের যোগ্যতায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হওয়ার শর্ত নেহায়েত অপর্যাপ্ত। এই শর্ত বাড়ানো দরকার।

দ্বিতীয় রিপাবলিকের জন্য প্রস্তাবনা
দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য আমাদের প্রস্তাবনার মূল সুর হলোÑ যে গঠনতন্ত্রটি তৈরি হবে, তাতে জাতি ‘গড়ে তোলার’ নির্দেশনা থাকতে হবে।

১. ইতোমধ্যে আলোচিত আরেকটি বিষয় হলো : যেকোনো নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার জন্য সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার (সিম্পল মেজরিটি) নীতি অব্যাহত থাকবে, নাকি ৫০ শতাংশ+ ভোটের শর্তযুক্ত প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হবে। দ্বিতীয় বিকল্পের বেলায়, কোনো প্রার্থীর ৫০ শতাংশ+ ভোট না পাওয়ার ক্ষেত্রে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী ও নির্ধারিত-ঘোষিত তারিখে, ‘প্রথম রাউন্ডের’ সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত, দুই প্রার্থীর মধ্যে ‘দ্বিতীয় রাউন্ডের’ নির্বাচনী প্রতিদ্ব›িদ্বতা হবে।
২. জ্ঞান ও মানবীয় গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি গড়তে উদ্যোগী হবে রাষ্ট্র।
৩. জনকল্যাণমুখী বিশেষজ্ঞতাকে সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসন উৎসাহিত ও পুরস্কৃত করবে।
৪. ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষা ও নিশ্চিত করা সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের দায়িত্ব।

মুজিব, জিয়া, খালেদা ও হাসিনার অভিজ্ঞতা
‘বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা’ বলে প্রচারিত শেখ মুজিব জনগণের মালিকানা ‘গণভোটের’ তোয়াক্কা করেননি। কথিত ‘মিলিটারি শাসক’ ও ‘ক্যান্টনমেন্টে দলের প্রতিষ্ঠাতা’ জিয়াউর রহমান জনগণের মালিকানাÑ গণভোট পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ফিরিয়ে দেন।

কথিত ‘উত্তরাধিকারের নেতা’ খালেদা জিয়া দ্বাদশ সংশোধনীতে সেই গণভোটের চর্চা করেছেন। তবে তিনি জনগণের সেই মালিকানা ‘গণভোট’কে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বেলায় পাশ কাটিয়েছেন। কথিত ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়’ গড়ে ওঠা নেতা শেখ হাসিনা গণভোটের অধিকার কেড়ে নেন।

কয়েকটি পরিভাষার প্রশ্ন :

ক. রিপাবলিক
ইংলিশ শব্দ ‘রিপাবলিক’। জনগণের হাতে যে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা থাকে, প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণ তাদের সার্বভৌমত্বের চর্চা করে, তা-ই রিপাবলিক। শব্দটি নিকট অতীতে আধুনিক অর্থে ও মর্মে ব্যবহার করে ফরাসি জনগণ ১৭৮৯ সালের বিপ্লব প্রক্রিয়ায়।

বাংলাদেশের সরকারি নাম রাখা হয় ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’। ইংলিশ নামে সমস্যা তেমন নেই। সমস্যা ‘বাংলাকরণে’। বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটিতে আছে ‘প্রজা’ এবং ‘তন্ত্র’। বাংলা শব্দ ‘প্রজা’ ‘ভাব’-এ এবং ‘মূর্তি’তে নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে। ‘প্রজা’ মানে এক ‘অধীন-অস্বাধীন’ অস্তিত্ব। প্রজার সাথে রাজার অস্তিত্ব অনিবার্য। ‘রাজা’ না থাকলে কেউ ‘প্রজা’ হয় না। তাই ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটি ‘রিপাবলিক’-এর মর্ম-ভাব শুদ্ধভাবে প্রকাশ করে না। ফরাসিরা রাজাকে অস্তিত্বহীন করতে চেয়েছিল। তাই নাম ‘নিয়েছিল’ ‘রিপাবলিক’। আমাদের প্রস্তাব, ‘রিপাবলিক’-এর বাংলা করা হোক ‘জনতন্ত্র’। ‘জন’ এক স্বাধীন অস্তিত্ব।

খ. জাতীয় সংসদ
ব্যাকরণের সাধারণ নিয়ম হলো বিশেষ্য পদের ‘অনুবাদ’ হয় না। আরবি ভাষার কোনো ‘নাম’ বাংলায় ‘অনুবাদ’ করে’ প্রয়োগ করা যায় না। এমনি নীতি অন্যভাষার বেলায়ও। বাংলাদেশের আইনসভার একটি নাম আছে, ‘জাতীয় সংসদ’। বাংলাদেশের চলতি সংবিধানে আইনসভার নাম ‘জাতীয় সংসদ’। কিন্তু এ সংবিধানের ‘ইংলিশ পাঠ’-এ এর নাম লেখা হয়েছে ‘পার্লামেন্ট’। এটি ‘ব্যাকরণগত বিবেচনায়’ গ্রহণযোগ্য নয়। ইংলিশেও লিখতে হবে ঔধঃরুড় ঝধহমংধফ।

গ. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন
ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের নির্বাহী বিভাগের সব বিভাগ-দফতর-অধিদফতরের সদর দফতর বিদ্যমান। এসব বিভাগ-দফতর-অধিদফতরের বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা সদরে অফিস রয়েছে। উপজেলা, জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে অবস্থিত দফতর-অধিদফতরের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে স্বায়ত্তশাসন পান না। উপজেলা-জেলা-বিভাগ পর্যায়ে থাকে ‘কেন্দ্রের’ ‘স্থানীয় শাসন’ কর্তৃপক্ষ। ইংলিশে বলে ‘লোকাল গভর্নমেন্ট’। বিপরীতে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে গ্রামীণ ও শহর-নগরভিত্তিক স্থানীয় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে স্থানীয় জনগণের পছন্দ-ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এসব কর্তৃপক্ষের নাম ‘স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কর্তৃপক্ষ’। বাংলাদেশের সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০) ‘স্থানীয় শাসন নাম দিয়ে ‘স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কর্তৃপক্ষ’ বোঝানো হয়েছে। এ নামকরণ বদলাতে হবে।

শেষ কথা
বাংলাদেশকে একটি নতুন জনতন্ত্র বা রিপাবলিক হিসেবে গড়ে তোলার কাজটি পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেয়া আজ দেশের কল্যাণকামী অগ্রসর নাগরিকদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

লেখক : প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement
অনুশোচনা নেই আওয়ামী লীগে, যে অপেক্ষায় তারা রাতে মাঠে নামছে চিরচেনা ব্রাজিল, ভোরে বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা কাঁঠালিয়ায় মোটরসাইকেলচাপায় গৃহবধূ নিহত, আহত ২ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এখনো শেষ হয়নি : মাহমুদুর রহমান সাবেক এমপি টিপুকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করল জনতা বিএলআরআইয়ের ভূমিকা হওয়া উচিত দেশীয় জাত সংরক্ষণ : ফরিদা আখতার কেউ যাতে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে না পারে : আসিফ নজরুল প্রশাসক নিয়োগ করে পোশাক কারখানায় সমস্যা সমাধান সম্ভব? খুলনায় পাটের বস্তার গোডাউনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট ৯টি ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি গঠন তিন দিনের মধ্যে এনআইডিকে ক্যাটাগরি করার নির্দেশ ইসির

সকল