১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

’৪৮-এর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এম এ গণি

মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি - ছবি : সংগৃহীত

১. আমাদের সেনাবাহিনীর সূচনাকারীদের অন্যতম ছিলেন মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি। বাংলা ও আসামের মুসলমানদের অধিকার আদায়ে ও সামরিক বাহিনীতে নিজেদের অংশীদারিত্ব বাড়াতে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু বাঙালি মুসলমান অফিসার নানা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তাদেরই অন্যতম মেজর আবদুল গণি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি ‘বঙ্গ-শার্দুল’ ও ‘টাইগার গণি’ নামেই বেশি পরিচিত।

২. ব্রিটিশ-ভারতের সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোকদের নিয়ে সামরিক রেজিমেন্ট ছিল; কিন্তু ছিল না কেবল অবহেলিত বাঙালির কোনো রেজিমেন্ট। বিশ্বযুদ্ধের প্রয়োজনে বাঙালি মুসলমানদেরকে নিয়ে কিছু বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করা হলেও যুদ্ধ শেষে সেগুলো ভেঙে দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙালি কমিশনড অফিসারদের মধ্যে মেজর আব্দুল গণি (১৯১৫-৫৭) ছিলেন অন্যতম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নেই প্রতিষ্ঠিত হয় তার স্বপ্নের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ ইস্ট বেঙ্গল।

৩. ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আব্দুল গণি। চট্টগ্রামের ইসলামিয়া হাই মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। খেলাধুলায়ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন। মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সবুজ কোর্তা’ নামে সমাজসেবামূলক সমিতি। ‘সবুজ কোর্তা’ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অল্প সময়ের ব্যবধানে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

৪. গণির ছাত্রজীবন কেটেছে আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্যে। এ সময় এগিয়ে আসেন চট্টগ্রামের অবাঙালি মহকুমা প্রশাসক হামিদ হাসান নোমানী। গণিকে তিনি তার ছেলের সাথে চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলে এবং পরে খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি করেন। ১৯৩৬ সালে এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে বিএ পাস করার পর কলকাতা ফায়ার ব্রিগেডে অফিসার পদে যোগ দেন।

৫. ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এম এ গণি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশনড অফিসার পদে যোগদানের আবেদন করেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় পাইওনিয়ার কোরে কমিশন লাভ করেন। গণি ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, নির্ভীক, বিনয়ী, কৌশলী ও কর্মতৎপর অফিসার, যা সিনিয়র ব্রিটিশ অফিসারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রিয়ভাজনে পরিণত হন। ১৯৪২ সালের শেষ দিকে তিনি লেফটেন্যান্ট এবং ১৯৪৩ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। এ সময় বার্মার আরাকানে জাপানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করেন। এ সময় আটকে পড়া এক হাজার ২০০ ব্রিটিশ সৈন্যের বিরাট বাহিনীকে পাথরসঙ্কুল পর্বতের ভেতর সুড়ঙ্গ কেটে উদ্ধার করেন ক্যাপ্টেন আবদুল গণি। এ বিপজ্জনক সময়ে বাঙালি মুসলমান সৈনিকদের সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখে ক্যাপ্টেন গণি দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হন এদেরকে নিয়ে একটি বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করতে।

৬. মহাযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৪৬ সালে ক্যাপ্টেন গণিকে ভারতের ঝালনায় কোর সেন্টারে বদলি করা হয়। এ সময় থেকে তার চিন্তাচেতনা কাজ করতে থাকে কিভাবে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠন করা যায়। এ সময়ে তিনি দাক্ষিণাত্যের বিশাখাপত্তম, হায়দরাবাদ, সেকান্দারাবাদ ও মুম্বাইতে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির দায়িত্ব পালন করেন, যা তার জীবনে বড় ধরনের একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজে লাগে। এখানে তিনি ১২৫৬ ও ১৪০৭ দু’টি পাইওনিয়ার কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ব্রিটিশ জেনারেল মেসারভি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। আগে থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন গণিকে চিনতেন মহাযুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ ভ‚মিকার জন্য। সে সুবাদে তিনি জেনারেল স্যার মেসারভিকে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেন। এর সাথে সব তথ্য ও যুক্তি পেশ করে ২০ পৃষ্ঠার স্মারকলিপিও পেশ করেন। মেসারভি এ প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে চিঠির উত্তরে জানান, ‘আমি আশা করি বিশ্বকে তোমরা দেখাতে পারবে বাঙালি মুসলমান সৈনিকরা অন্যদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’

৭. ১৯৪৭ সালে ঢাকায় আসার পর বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করার জন্য ক্যাপ্টেন গণি জোর তৎপরতা শুরু করেন। সরকার ক্যাপ্টেন গণি ও আরো অনেকের ইচ্ছানুযায়ী বাঙালি মুসলমানদের জন্য একটি রেজিমেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। যার নাম হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। ক্যাপ্টেন গণি ও অন্যান্য অফিসারদের চেষ্টায় মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ ইস্ট বেঙ্গল।

৮. অনুষ্ঠানের চা-চক্রে এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার অবতারণা হয়। ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান সবার উদ্দেশে বলেন, ‘From now on-words Bengali Soldiers will speak in Urdu, not in Bengali.’ এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করে ক্যাপ্টেন গণি সবার সামনে আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, ‘Excuse me Sir, We Bengali soldiers will never speak in Urdu, but in our mother tongue Bengali.’ এর জবাবে আইয়ুব খান ‘Shut up. Sit down.’ বলে ক্যাপ্টেন গণিকে থামিয়ে দেন। এ দুঃসাহসী ভূমিকার জন্য এ সময় থেকেই তাকে ‘টাইগার গণি’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এ ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালেই প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় এবং মেজর গণি হলেন এ অদৃশ্য আন্দোলনের মহানায়ক। এ ঘটনার পর থেকে সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন গণির অবস্থান নড়বড়ে হতে থাকে। তার পদোন্নতি হচ্ছিল না। ইস্ট বেঙ্গল থেকে তাকে বদলি করা হয়। যথাযথ মূল্যায়ন ও পদোন্নতি না হওয়ায় ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে তিনি রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। পদত্যাগ গৃহীত হয় এবং তাকে অবসর দেয়া হয়। অবসরকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন গণিকে তার অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অবসরোত্তর (retrospective) ‘মেজর’ পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

৯. রাজনৈতিক জীবন : মেজর গণির নতুন জীবন শুরু হয়। অযথা সময়ক্ষেপণ না করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নিজেকে কাজে লাগানোর জন্য তিনি রাজনীতিতে নেমে পড়েন। আরবি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে সক্ষম মেজর গণি রাজনৈতিক অঙ্গনে উদীয়মান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৫৪ সালের ২২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। তিনি সরকারের কাছে দেশ ও জাতির কল্যাণে বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেন। যেমন- দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের যুবকদের কমিশন অফিসার হিসেবে যোগদানের জন্য ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। সারা দেশের যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তিনি একটি প্রকৃত ইসলামী দল গঠনের উদ্যোগও নিয়েছিলেন, যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘ইসলাম লীগ’। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে অতি অল্প সময়ে তিনি জনগণের জন্য যা করেছেন তার তুলনা হয়তো ইতিহাসে বিরল।

লেখক : সামরিক ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement