দূর হোক রাজনীতিতে নৃশংসতা
- মোবারক হোসেন
- ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৫৭
বিশ্বজিৎ থেকে আবরার। এ ধরনের যত সহিংসতা ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে- সবই আদর্শিক মতপার্থক্যের কারণে, ক্ষমতা আর অর্থবিত্ত অর্জনের জঘন্য লিপ্সা থেকে। রাজনীতিতে হিংস্রতা, নৃশংসতা, হত্যা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা কিংবা গুম-অপহরণ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের যা দেখা গেছে, তা পাকিস্তানি শাসন আমল কিংবা ব্রিটিশ শাসনকালেও দেখা যায়নি। তাই তো এই বাংলাকে বারবার দখলদারমুক্ত, হানাদারমুক্ত করার পাশাপাশি ভয়াবহ স্বৈরাচারের কবল থেকেও মুক্ত করতে হয়েছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিক কোনো দ্বন্দ্ব-বিরোধ নয়- দেশে সুশাসনের জন্য, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভোটাধিকারের জন্য শত শত মানুষকে হত্যা, জেল-জুলুম, পুলিশি নির্যাতন- সর্বোপরি গুম অপহরণের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি প্রহসনের বিচারের নামে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিচারিক কায়দায় হত্যা চরম প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়েছে। সবই এ দেশের মাটিতে সংঘটিত হয়েছে মানুষের চোখের সামনে। যেহেতু ভোটাধিকার প্রক্রিয়া বা গণতন্ত্র হরণ করে ক্ষমতার প্রতিটি স্তর কুক্ষিগত করা হয়েছিল, সেহেতু গণমানুষের দর্শক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। এসবই বাংলার ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে সূচিত হয়ে আছে।
ফ্যাসিবাদের পতনের পর জামায়াত প্রসঙ্গ বেশ আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এমনই একটি রাজনৈতিক দল, যাদের নেতাকর্মীরা সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। তাদের এই পরিচালনা-পদ্ধতি দলটিকে অন্য দল থেকে আলাদা করে দিয়েছে। এই দলের মধ্যে নেই কোনো হানাহানি। পদ পাওয়ার জন্য কোনো তদবির করতে হয় না। দল চালাতে কোনো ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিতে হয় না। নিজেরা নিজেদের দলকে টিকিয়ে রাখতে শ্রম দেয়, অর্থ দেয়। এমনই একটি সুশৃঙ্খল দলকে স্বৈরাচার হাসিনা ও তার বিদেশী দোসররা নানা প্রশাসনিক কায়দা ব্যবহার করে বিপর্যস্ত করেছে; কিন্তু কিছুতেই রুখে দিতে পারেনি।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের একটি কথা রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় তুলেছিল। তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনের সব প্রতিপক্ষকে দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা করার কথা বলেছিলেন। অনেকের অভিমত- এত নৃশংসতা, এত হত্যার পর কী করে ক্ষমা করে দিলেন তিনি। আর তিনি ক্ষমা করারই বা কে? সহজ প্রশ্নকে জটিল করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই। উত্তরটা হলো- জামায়াতে ইসলামী কোনো ছাত্র-জনতা হত্যাকারীকে ক্ষমা করেনি। এই হত্যাকারীদের ক্ষমা করারও কেউ নয়। যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিচার দেশের আইনি প্রক্রিয়ায় হবে- এটিই স্বাভাবিক। জামায়াত দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত রাজনৈতিক দল, বেশি জেল-জুলুমের শিকার। রাস্তাঘাট সর্বত্রই এই দলের নেতাকর্মীরা প্রতিপক্ষের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না বিধায় প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে কাউকে আক্রমণ করবে না। কারণ, তারা ইসলামী অনুশাসন মান্য করে চলার চেষ্টা করে। ইসলামে ক্ষমা মহৎ গুণ। তারই আলোকে দলের নেতা সবাইকে ক্ষমা করার কথা বলে দৃষ্টান্ত এনেছেন। দেশে আর হানাহানি চান না বলেই। কিন্তু ছিদ্র অন্বেষণকারী নিন্দুকেরা নেতিবাচক ব্যাখ্যা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে।
জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় উদার হতে হবে, এটিই তো জাতীয় রাজনীতির বাস্তবিক ধারা। এই বাংলা আমাদের সবার। দল মত ধর্ম নির্বিশেষে সবাই যে যার মতো রাজনীতি করবে, সাংবাদিকতা করবে, মতপ্রকাশ করবে, কিন্তু কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হবে না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি থাকবে না, ক্ষমতার অপব্যবহার হবে না, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো আপন গতিতে নিরপেক্ষভাবে চলবে, কোনো ধরনের ক্ষমতার হস্তক্ষেপ হবে না; সব দল, সব মতের মানুষ নিজ নিজ আদর্শ দেশের মানুষের মধ্যে প্রচার করবে। আবার দিনশেষে এক টেবিলে বসে সব পক্ষ হেসে হেসে কথা বলবে- এটিই তো দেশের রাজনৈতিক চিত্র হওয়ার কথা ছিল। বিগত সময়ে রাজনীতির নামে আমরা কী দেখেছি? এমন বীভৎস ঘটনা বাংলার জমিনে ঘটেছে, যা বিশ্বের সভ্য দেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে।
রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগের হাতে নৃশংসভাবে আক্রান্ত হতে দেখেছে এদেশের মানুষ। তখন বিশ্বজিৎ বলেছিলেন, ‘আমি হিন্দু, শিবির না’-তাতেও রক্ষা পায়নি বিশ্বজিৎ। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের চাপাতির উপর্যুপরি কোপে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাকে। বিশ্বজিতের আর্তচিৎকারে প্রমাণিত হয়েছে, হিন্দু বলতে কেউ শিবির করে না। শিবির করে এ দেশের ৮৮ শতাংশ মানুষের অংশ মুসলিম যুবকরা। আর এই শিবির এই দেশে আদর্শিকভাবে জনসমর্থন আদায়ে সচেষ্ট। ক্ষমতাসীন সরকার ও তাদের দোসরা আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে সন্ত্রাসী কায়দায় আক্রমণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছিল। যার ফলে জামায়াত-শিবিরের ইসলামিক আদর্শ নির্মূলে নীলনকশার অংশ হিসেবে সৃষ্টি করা হত্যাকাণ্ডকে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে বেছে নিয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে ঘটে যায় শিবির সন্দেহে বিশ্বজিতের ওপর চাপাতির হামলা। এসব ঘটনায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস করতে গিয়ে, রাজনৈতিক ফাঁদে পড়ে এখন ধরা খেয়েছে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড ছাত্রলীগের ত্রাস সৃষ্টির আরেকটি উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে চিরদিন লেখা থাকবে। আবরার ফাহাদ আদর্শিক কারণে মতপ্রকাশের জন্য ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের রাতভর বেদম প্রহারে নিহত হয়েছিলেন। তাকেও শিবির সন্দেহে ভারতে ইলিশ মাছ প্রেরণের বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে মতপ্রকাশ করার দায়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এমন অনেক ঘটনা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে ঘটেছে, যেসব ঘটনায় বেশির ভাগই ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে পেটানো হয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ছাত্রলীগ কর্মীরা কেন বারবার শিবিরকর্মীদের হত্যা বা পিটিয়ে মারাত্মক জখম করেছিল? উত্তর একটাই, সেটি হচ্ছে, স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি সেজে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছে মাঠপর্যায়ে অন্যতম প্রতিপক্ষ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রশিবিরকে প্রতিহত করার জন্য। তারা সবরকমের নৃশংস অপকৌশল বেছে নেয়। হোক সেটি রাতের আঁধারে কিংবা দিনের আলোতে।
শত্রুদের মধ্যে জীবনবাজি রেখে লুকিয়ে থেকে কাজ করে যাওয়া- এটিই তো বড় সাহসিকতা। এটিই তো বড় বীরের লড়াই। এই লড়াই না করলে ২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লব সফল হতো না। ছাত্রশিবির দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগের শক্তিধর ক্ষমতাসীনদের দেখিয়ে দিয়েছে, তাদের সাহসিকতা।
আজ জাতির ক্রান্তিলগ্নে ছাত্রশিবির ও জামায়াত যে ভ‚মিকা রেখেছে, তা জাতির ইতিহাসের অংশ। আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়তে হলে সবাইকে নিয়ে গড়তে হবে। আমরা যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে, জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করি, তাহলে ভেদাভেদ ভুলে প্রকৃত সত্য আড়াল না করে সবাইকে সাথে নিয়ে এগোতে হবে। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে হবে। পারস্পরিক হিংসা-বিভেদ ভুলে জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি অর্থ উপার্জনের উপায় নয়। এটি হবে দেশ ও মানুষের সেবার একটি উপায় এবং সর্বোত্তম উপায়।
লেখক : সাংবাদিক
mubarokhosen83@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা