বাংলাদেশে বাম রাজনীতির গতি-প্রকৃতি
- ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব
- ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৩২, আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৯
(দ্বিতীয় কিস্তি)
মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার অব্যবহিত পরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন লেখক জগলুল আলম। তিনি বলেন, ‘গোড়া থেকেই আন্দোলন পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সবসময় পাকিস্তান কাঠামো বজায় রেখে আন্দোলনের গণতান্ত্রিক ধারার ওপর শ্রদ্ধাশীল ছিল। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের লেশমাত্র প্রস্তুতিও ছিল না। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানালেও তাতে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন, এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে, পূর্বপকিল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়া ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ পরিচালনার মতো সাংগঠনিক ও কৌশলগত দক্ষতা আওয়ামী লীগের ছিল না। সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয় একটি উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া এবং সংগ্রামের পক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য আদর্শগত একটি ভিত্তি, যা থেকে আওয়ামী লীগ ছিল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। ফলে নিঃশর্তে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সামনে খোলা ছিল না। সে কারণেই ২৫ মার্চের পরবর্তী দিনগুলোতে বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন অবধি আওয়ামী লীগ সুপরিকল্পিত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি... ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে এগিয়ে গেছে সে দিকেই ছুটে যেতে হয়েছে।’
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘এই পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের কার্যকলাপ থেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা যথেষ্ট পরিমাণে আঁচ করে নেয়া যায়। আওয়ামী লীগের টিকিটে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী অধিকাংশ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ছিলেন সমাজের মধ্যবিত্ত পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত মূলত সামন্তবাদী ধ্যানধারণাপুষ্ট এবং সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানও আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে যাননি।’
এ প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘একজন আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যও দেশের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নেননি। বরং তারা সেখানে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে। পরবর্তীকালে দেখা গেছে, একজন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাও পাকিস্তান বাহিনীর সাথে সরাসরি মোকাবেলা করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেননি এবং যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করেননি। কমপক্ষে ৭০ শতাংশ নেতা তাদের আবাস গড়েন কলকাতা কিংবা তৎসন্নিহিত এলাকায়, ১৫ শতাংশ আশ্রয় নেন ভারতের বিভিন্ন শহরে। বাকি ১৫ শতাংশ ভারতের বিভিন্ন এলাকায় শরণার্থী শিবির ও যুবশিবির খোলা হলে সেখানে আশ্রয় নিয়ে শরণার্থীদের সাহায্য প্রদান ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।’
জগলুল আলমের মতে, ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের এই শ্রেণিচরিত্র ও মানসিকতা একই শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী ও মানসিকতার অধিকারী ভারতীয় ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের নেতাদের অগোচর ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ছিল নেতৃত্ববিহীন এবং ভারত সরকার এই পরিস্থিতির সুযোগ নেয় পুরোপুরিভাবেই। আওয়ামী লীগ তার মস্কোপন্থী ও চীনবিরোধী নীতি অনুসারে ভারতের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং প্রায় প্রতিটি বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সংগ্রহ হয়ে দাঁড়ায় একটি সাধারণ নিয়ম। বিপ্লব ও সংগ্রামের অভিজ্ঞতাবর্জিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পুরোপুরিভাবে চাচ্ছিলেন যে, মুক্তিযুদ্ধ একটি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ানোর পরে ভারত নিজেই যুদ্ধ করে বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করে দেবে। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাধীনতা অর্জনের চাইতে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতার পুনর্বহালই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। এটি তাদের জন্য যতটা ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম, তার চাইতে বেশি ছিল হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম।’
জগলুল আলম আরো বলেন, ‘ভারত সরকার একই সঙ্গে বস্তুগত ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের আনুগত্য আদায় করে নেয় এবং তদনুযায়ী আওয়ামী লীগও হয়ে পড়ে পুরোপুরিভাবে ভারতের আজ্ঞাধীন। সঙ্গতকারণেই ভারত সরকার আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ওপর আস্থা স্থাপন করেনি। ...অন্য দিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আনুগত্য অব্যাহত রাখার জন্য তাদের মাস প্রতি ৫০০ টাকা করে বেতন, বাসগৃহ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। প্রবাসী অস্থায়ী সরকারে যারা মন্ত্রী পর্যায়ে নিযুক্তি পেলেন, তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলো তুলনামূলকভাবে বেশি।’
জগলুল আলমের মতে, ‘এই অবস্থায় মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী উভয় ধরনের অন্যান্য বাম দলগুলোর নেতাকর্মীরা অসুবিধায় পড়ে যান। প্রথম দিকে তারা ছিলেন যথেষ্ট সহিঞ্চু ও পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মে মাস নাগাদ বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা শরণার্থীর হার উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বেড়ে গেলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। দেখা গেল, ভারত সরকার শরণার্থীদের মধ্যে সাহায্য বিতরণ করতে গিয়ে কেবলমাত্র প্রবাসী বাংলাদেশী সরকারের মতামতকেই প্রাধান্য দিচ্ছে এবং প্রবাসী সরকারও সাহায্য বিতরণে কেবল আওয়ামী লীগের সমর্থকদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে। এমনও দেখা গেছে যে, শরণার্থীরা ভারতে আসার পর তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য জানার জন্য জেরা করা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক না হলে তাদের জন্য খাদ্য ও আশ্রয়ের যথাবিহিত ব্যবস্থা করা হয়নি।’
তিনি মন্তব্য করেন যে, এমতাবস্থায় বামপন্থী দলগুলো সহসাই আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় যে, স্বাধীনতা অর্জনের একক লক্ষ্যে সংগ্রাম পরিচালনার জন্য সবাই সাময়িকভাবে ভারতে আশ্রয় নিলেও ভারতে এসে বামপন্থী ও অন্যান্য দলের ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়েছে এবং সংগ্রামের গোটা নেতৃত্ব রেখে দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। বিশেষ করে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন দানকারী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ও মস্কোপন্থী ন্যাপ কোথাও স্থান না পেয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। ভারত সরকারের সাহায্যে ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক বাংলাদেশী যুবকদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠনের সময়ও একই দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। পাছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব বামপন্থীদের হাতে চলে যায়, সে আশঙ্কায় আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাড়া অন্যান্য দলের কর্মীদের মুক্তিবাহিনীতে ট্রেনিং প্রদানের ওপর বিশেষ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ফলে মস্কো ও পিকিংপন্থী অন্যান্য বাম দলগুলো দু’টো বিকল্প চিন্তা করতে থাকে। প্রথমত আওয়ামী লীগের প্রাধান্য মেনে নিয়ে প্রয়োজনবোধে পরিচয় লুকিয়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া এবং দ্বিতীয়ত, ভারতীয় সাহায্যপুষ্ট মুক্তিবাহিনীতে যোগ না দিয়ে পৃথকভাবে ক্যাডারদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। মস্কোপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মোজাফফর) প্রথমোক্ত পথ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেয়।’
জগলুল আলমের ‘বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে আরো জানা যায়, ‘এই সময়ে (চীনপন্থী কমিউনিস্ট) পার্টির নেতারা পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতিকে যেভাবে মূল্যায়ন করেন তা হলো এই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো ও তাদের সমর্থকরা হলেন পশ্চিম পাকিস্তানি বৃহৎ জায়গিরদার, একচেটিয়া পুঁজিবাদী এবং শিল্পপতিদের প্রতিনিধি এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অর্থ ও অস্ত্র সাহায্যে তারা পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থাপিত বাজারব্যবস্থা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে। অন্য দিকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে সেই একই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় নিজেদের প্রাধান্য নিশ্চিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে।’ এমতাবস্থায় চীনপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সুখেন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে ভারতে না গিয়ে দেশের ভেতরেই এক বিপ্লবী পার্টি (লাল ফৌজ) গঠন করে পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই ১৬টি জেলায় যুদ্ধ করে বেশ কিছু অঞ্চল মুক্ত করে। অবশ্য ভারতীয় বাহিনীর অগ্রাভিযানের মুখে তারা অনেকেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাকিরা আত্মগোপন করে। কমরেড দেবেন সিকদার দাবি করে যে, মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি ভারতীয় বাহিনীর হাতে চরম মার খেয়ে একপর্যায়ে পাকবাহিনীর সাথে হাত মেলায় এবং পাকিস্তানিদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার বাইরে গিয়ে তারা এক সময়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
চীনপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির আরেকটি গ্রুপ কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ভারতে গিয়ে পৃথকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভারতে গিয়ে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখে। তিনি অন্যান্য আটটি বামপন্থী দল নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করেন যাকে ‘অষ্টবাম’ বলা হয়।
১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক ‘সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন করে। ভাসানীকে তার চেয়ারম্যান করা হয়। তবে ওই কমিটি বাস্তবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ কমিউনিস্টদের সাথে সদ্ভাব রাখার পক্ষপাতি ছিলেন; কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ভারত সরকারের চাপে তাদেরকে প্রশ্রয় দেননি। প্রবাসী সরকার বিশেষ করে চীনপন্থীদের সর্বদাই দূরে ঠেলে রেখেছে।
অন্য দিকে বাম দলগুলো আওয়ামী লীগ ও ভারতের অতিরিক্ত খবরদারির কারণে বিরক্ত হয়ে নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলা শুরু করে। এর ফলে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপের অবস্থান ও তৎপরতা নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এরূপ ধারণা চাউর হয় যে, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের চাইতে বামপন্থীদের প্রভাব বেশি।
এরূপ পরিস্থিতিতে ভারত ও আওয়ামী লীগের একাংশ মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য যাতে বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে না যায় সে জন্য ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ (বিএলএফ) নামে আলাদা বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেয় এবং তাতে শুধু আওয়ামী লীগ কর্মীদেরকেই রিক্রুট করা হয়। এ বাহিনীর তাত্ত্বিক ও সংগঠক ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ। তারা এ বাহিনীর সদস্যদের ‘মুজিববাদ’-এর দীক্ষা দিতেন। এ বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর যথেষ্ট মতপার্থক্য ছিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছে বলে জানা যায়। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে মূলধারার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছিল। তাদের সাথে বহু অসামরিক মুক্তিযোদ্ধাও ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রথমে বামপন্থীরাই উত্থাপন করে। তাদের দৃষ্টিতে সেটি কোনো বিচ্ছন্নতাবাদী আন্দোলন ছিল না। পরবর্তীতে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে কোনো কোনো গ্রুপ স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। চূড়ান্তভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তারা তাদের মতো করে নেতৃত্ব দিতে পারেনি। পরে চীনপন্থীরা তাদের রণকৌশল প্রশ্নে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কোনো গ্রুপ আন্ডারগ্রাউন্ড চলে যায় এবং উগ্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতি
গণতান্ত্রিক তথা নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলো কখনোই ভালো করতে পারেনি। বাম রাজনীতির গুরু মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন জনপ্রিয় নেতা। কিন্তু তিনি ১৯৫৪ সালের পরে আর নির্বাচনমুখী ছিলেন না। তার রাজনৈতিক আদর্শ রহস্যেঘেরা। এক দিকে তিনি ছিলেন ধর্মীয় নেতা; অন্য দিকে তার অনুসারীরা ছিল বামপন্থী। এরূপ পরস্পরবিরোধী রাজনীতির মাধ্যমে তিনি কী অর্জন করতে চেয়েছিলেন তা পরিষ্কার নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল; কিন্তু ভাসানী ও চীনপন্থী কমিউনিস্টদের একাংশ মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেয়। আরেকটি অংশ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে অভিহিত করে। রাশিয়াপন্থী কমিউনিস্টরা নিজস্ব ধারা বেগবান করতে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগের ওপর সওয়ার হয়। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল গঠনের পেছনে এদের বড় সমর্থন ছিল। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ স্লেøাগান দিয়ে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করেছিল ১৯৭২ সালে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। কিন্তু উগ্রতা ও হঠকারিতার জন্য তারা বেশি দূর আগাতে পারেনি। যে দলটির জন্ম হয়েছিল পুঁজিবাদী আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরুদ্ধে এবং যে দলটির হাজার হাজার কর্মী আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে নিহত হয়েছিল, পরবর্তীতে সে দলের একটি গ্রুপ আওয়ামী সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করেছে এবং সমাজতন্ত্রের নীতি আদর্শ একেবারে জলাঞ্জলি দিয়েছে। ভাসানীর অনুসারীদের একটি অংশ রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে এবং বামপন্থী নীতি-আদর্শ ভুলে গিয়ে বুর্জোয়া আওয়ামী সরকারের অধীনে ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছে। আরেকটি অংশ বিএনপির সাথে মিশে গেছে। রাশিয়াপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি কোনো দিনই নির্বাচনে ভালো করতে পারেনি। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শ্রমিকদের মধ্যে বামপন্থী রাজনীতি বেশ জনপ্রিয় ছিল। সময়ের বিবর্তনে তাদের সে অবস্থান হারিয়ে যায়। দেশে দ্রুতগতিতে একটি মধ্যবিত্ত ও উঠতি ধনিক শ্রেণী গড়ে উঠতে থাকে এবং এরা আবার পাশ্চাত্যের বাজার অর্থনীতির ভোগবাদের প্রতি আকৃষ্ট। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ভোগবাদী দর্শন সবাইকে কমবেশি প্রভাবিত করেছে। আবার অন্য কোনো দেশেও সমাজতন্ত্রের সেই আবহ আর নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করায় এ আদর্শের আর কোনো ভবিষ্যৎ আপাতত কোথাও দেখা যাচ্ছে না; বাংলাদেশে তো নয়ই।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা