জেন-জিকে বিএনপির কাছে টানার কৌশল
- ড. মো: আবুল কালাম আজাদ
- ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২০:২১
১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যাদের জন্ম, তারাই জেন-জি বা জেনারেশন জেড। বর্তমানে এই প্রজন্মের সদস্যদের বয়স ১২ থেকে ২৭ বছর। আমাদের সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (দ্বাদশ) প্রায় ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি ছিল জেন-জির সদস্য। আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে টেকসই রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকবে সেই দল যারা জেন-জিকে কাছে টানতে পারবে। এর কারণ এই জেনারেশনের শক্তি ও সক্ষমতা। যে কাজটি করতে মাঠের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল ১৭ বছর ধরে নিষ্ফল লড়াই করেছে, জেন-জি সেই কাজ মাত্র ১৭ দিনে করে দেখিয়েছে। ওদের সাহস, ঐক্য, ইন্টিগ্রেশন ও মনোবল প্রমাণ করে ওরা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরে না (‘লংমার্চ টু ঢাকা’ ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ তারিখে এগিয়ে আনা তার দৃষ্টান্ত)।
প্রযুক্তিবান্ধব পরিবেশের বিকাশ
জেন-জিকে ইন্টারনেট প্রজন্ম বলা হয়। কারণ তারা ইন্টারনেট-সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি গ্রহণ ও ব্যবহারে দ্রুত সর্বোচ্চ পারদর্শিতা অর্জনে সক্ষম। এ প্রজন্ম ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দৈনন্দিন কেনাকাটা, লেনদেন, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং গ্লোবাল ভিলেজে যুক্ত থাকতে পছন্দ করে। বৈশি^ক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহারেও অগ্রণী। বিগত সময়ে বিএনপি যখনই বড় ধরনের সভা-সমাবেশ ডেকেছে পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার সমাবেশ শুরুর কিছুক্ষণ পর সভাস্থলসহ আশপাশের ইন্টারনেট হয় স্লো বা অফ করে দিয়েছে। মিডিয়ার ওপর বিএনপির সভা-সমাবেশ সরাসরি সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এতে বিএনপিকে যেমন ক্ষেপিয়েছে সাথে সাথে প্রযুক্তিনির্ভর জেন-জি প্রজন্মকেও ক্ষেপিয়ে তুলেছে। সর্বশেষ জুলাই ৩৬ বিপ্লবে সরকার ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ডাটার ইন্টারনেট সম্পূর্ণ বন্ধ করে কি প্রলয় থামাতে পেরেছিল? পারেনি।
তাই বিএনপিকে শিক্ষা নিতে হবে ওই সব দৃষ্টান্ত থেকে। বিএনপি অবশ্যই তার নির্বাচনী রোডম্যাপ ও ইশতেহারে এ প্রজন্মের কাছে স্পষ্ট করবে যে, তারা যখনই ক্ষমতা আসবে, প্রযুক্তি সহজলভ্য করবে এবং সবার জন্য সহজলভ্য করে দিয়ে সবাইকে এর আওতায় আনবে। প্রয়োজনে জেন-জি-বান্ধব ডিজিটালাইজেশন কাউন্সিল গঠন করবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কাজের পরিবেশ উন্নতকরণ
উচ্চশিক্ষিত বেকারের হিসাবে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৫ থেকে ২৭ লাখ। এর মধ্যে ২১ লাখই তরুণ-তরুণী, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। অন্য দিকে বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২ অনুসারে, বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। মানে হলো, তারা পড়াশোনায় নেই, প্রশিক্ষণেও নেই, এমনকি কাজও খুঁজছেন না। এ ধরনের তরুণের সংখ্যা বাড়ছেই। (প্রথম আলো, ২০২৪) হাসিনা সরকার ২০০৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছিল, নির্বাচিত হলে ঘরে ঘরে চাকরির ব্যবস্থা করবে। অথচ জাতি দেখল চাকরি নয়; বরং ঘরে ঘরে মামলা ঠুকেছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন নতুন বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ। বিএনপিকে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, দক্ষ মানবসম্পদ-বান্ধব শিক্ষামাধ্যম, শিক্ষিত বেকারদের বিদেশে কর্মসংস্থান তৈরি এবং বেশি বেশি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতকরণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কমিটেট হতে হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ
তরুণরা দেখেছে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে এ দেশের রাজনীতিবিদরা কিভাবে একেকজন দুর্নীতির বরপুত্র, রাঘববোয়াল ও লুটপাটে বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি তকমা পেয়েছে। দেশ থেকে তারা ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে, যা দিয়ে একটানা প্রায় চারবার বাজেট করা যেত। দেশটিকে তারা ফোকলা করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি-ব্যবসায় গড়ে তুলেছে, দেশের শিক্ষিত ছেলেদের বেকার রেখে বিদেশে বেকার হ্রাস প্রকল্প করেছে। জেন-জি এর পরিবর্তন দেখতে চায়। সেজন্য একজন চাকরিপ্রত্যাশীর চাকরিতে প্রবেশের পর তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পতির হিসাব জমা দেয়া, প্রতি বছর তার আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা বাধ্যতামূলক ও জবাবদিহির আওতায় আনতে বিএনপি কী কী পদক্ষেপ নেবে তা সামনে আনতে হবে। প্রত্যেক সংসদ সদস্যের জ্ঞাত আয়ের বিবরণী জনসম্মুখে প্রকাশের ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন নাগরিক একটির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না- এমন ব্যবস্থা করতে হবে।
মতপ্রকাশে অবাধ স্বাধীনতা প্রদান
হাসিনা সরকার খোলা মনে লেখা ও কথা বলার সব মাধ্যম রহিত করেছিল। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে নিবর্তনমূলক আইনে কত জেন-জি সদস্য নির্যাতিত হয়েছে, মামলা খেয়েছে, জেলও খেটেছে তার ইয়ত্তা নেই। এ প্রজন্ম নিজেদের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে খুবই স্পষ্টবাদী। এ ছাড়া বৈচিত্র্য, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ও মতপ্রকাশে তারা দ্বিধাহীন। যুক্তিতর্কের ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি উদার এবং কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে ভালোভাবে বোঝার জন্য গঠনমূলক তর্কে জড়াতেও পিছপা হয় না। তাই এ প্রজন্মকে সঠিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা ও অনিময়-অব্যবস্থার বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার অবাধ সুযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি গত দেড় দশকে ছিল একটি দল, দালাল, দখল ও দুর্নীতির কবলে। রাষ্ট্রের ঠিক কোনো প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে কথা বললে এই লক্ষণ পাওয়া যাবে না, তা গভীর গবেষণার বিষয়। পতিত হাসিনা সরকার দেশে ‘সিস্টেমেটিক ডিক্টেটরশিপ’ বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচার নামের একটি নতুন প্রকৃতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের তামাম প্রতিষ্ঠানকে ‘যথাযথ উপায়ে’ ব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছে। সরকার প্রথমে পুলিশের হাতে আধুনিক মারণাস্ত্র তুলে দিলো, তারপর বিচারিক ব্যবস্থাকে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বানাল। এরপর তারা নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে ভোটের অধিকার কেড়ে নেয় এবং মিডিয়া হাউজগুলোকে সফট পাওয়ার টুলস হিসেবে ব্যবহার করে। আমলাদের পা থেকে মাথার চুলের ডগা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবিয়ে দেয় সরকার। যার ফলে দেশে দায়িত্বশীল ও জনগণের সেবক জনপ্রশাসন দেখা যায়নি। ওপরের সবগুলো এপিসোড এখনকার জেন-জিরা প্রত্যক্ষ করেছে। তাই রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে অঙ্গীকার করতে হবে। ক্ষমতায় এসে অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে তার বিচার জনগণ নয়, তারাই করবে। তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে মেধাভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলবে, যা অবশ্যই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ ও পরিপোষণ করবে।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
জেন-জি প্রজন্ম দুটো মহামারী দেখেছে। ২০০৮ সালে যখন তারা বয়সে কিশোর তখন দেখেছে বিশ^জুড়ে আর্থিক মন্দা। আবার ২০২০ সালের করোনাকালীন সময়ে দেখেছে কিভাবে চোখের সামনে বড় সব জব চলে যাওয়া। তাই এ প্রজন্ম চায় তাদের আয়ের উৎসগুলো বহুমুখী হোক, যাতে একটি আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেলেও যেন অন্যটি দিয়ে চলতে পারে। তাই আগামীর সরকারকে অবশ্যই জবের নেচারে ‘বেশি পরিশ্রম, বেশি আয়’ এমন সব অপশন খোলা রাখতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরির সহায়ক পরিবেশ ও সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে।
সত্যিকার ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণ
বিএনপি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে ইতিহাসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে এত পরিমাণ বাড়াবাড়ি করেনি যা শেখ হাসিনা সরকার গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে করেছে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে জিয়ার নাম-নিশানা মুছে ফেলতে পুরো রাষ্ট্রীয় মাধ্যম ব্যবহার করে একেবারে মনগড়া প্রপাগান্ডা ছড়াতে ব্যস্ত ছিল। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জিয়াউর রহমান ছিলেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর পরবর্তী বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বহুদলীয় রাজনীতির পথ অবমুক্তকরণে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কি ছিল তা সবাই জানে। অন্য দিকে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০-এর নির্বাচন পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের রূপ আর দেশ স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত তার রূপ জাতি দেখেছে। তাই জোর করে চাপিয়ে দেয়া খেতাব ও মূর্তি স্থাপন কতটা অযৌক্তিক তা ‘জুলাই ৩৬’ গণবিপ্লবের পর জাতি দেখেছে। তাই বিএনপির উচিত হবে ইতিহাস নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে যার যতটুকু প্রাপ্য তা নিশ্চিত করা।
২০২৪-এর জেন-জি প্রজন্ম চায় বৈষম্যমুক্ত চাকরির নিশ্চিয়তা, ‘আমার ভোট আমি দেবো যাকে খুশি তাকে দেবো’ এই নিশ্চয়তা। রাজনৈতিক নেতা, আমলা বা কোনো গোষ্ঠীর হাতে দেশ থেকে আর যেন একটি টাকাও বিদেশে পাচার না হয় তার সব রকম ব্যবস্থা করা, বিচার-পুলিশ-শাসনতন্ত্রের আমূল সংস্কার এবং স্বাধীন গণমাধ্যম ও মন খুলে লেখার নিশ্চয়তা সমাজে থাকতে হবে। যে দলের জন্মই হয়েছে জনগণের জন্য, যে দল প্রতিশ্রুত দিয়ে তা রক্ষা করে সেই বিএনপি সামনের দিনগুলোতে বেপরোয়া সাহসী ও সচেতন জেন-জিকে সাথে নিয়েই শহীদ জিয়ার স্বপ্নের দেশ বিনির্মাণ করবে- এটিই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা