দুদক সংস্কার কমিশন, জন-প্রত্যাশা
- মোহাম্মদ আবদুল মাননান
- ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৪২
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন গঠনের সরকারি প্রজ্ঞাপনে কমিশনের কোনো কার্যপরিধি বলে দেয়া হয়নি, তবে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা বর্ণিত হয়েছে। ফলে এই কমিশন ঠিক কী কী বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নপূর্বক সরকার বরাবরে উপস্থাপন করবে তা স্পষ্ট নয়। তবে কমিশনে ড. ইফতেখারুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে ক’জন আইন বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ছাড়াও একজন প্রাক্তন কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন দেখার আছে, এই কমিশনের কাছে জন-আকাঙ্ক্ষা কী।
এ কথা ঠিক, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার নিয়ে বাজারে নানা মতামত জারি আছে। বিশেষত, পরপর তিনটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় জনমনে এই কমিশন নিয়ে বিরূপ ধারণা বিদ্যমান আছে আর সেই থেকেই নির্বাচনবিষয়ক সংস্কার কমিশনের দিকে আমজনতার চোখ ঠিক যেন বাজপাখির শিকার ধরার চোখের মতো নিবিষ্ট হয়ে আছে। নির্বাচনবিষয়ক সংস্কার কমিশনের হাত খানিকটা প্রসারিত এই অর্থে যে, কমিশনের নামই হচ্ছে, নির্বাচনবিষয়ক সংস্কার কমিশন; ফলে এই কমিশন নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের সংস্কার নিয়ে কাজ করবে এবং এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের নামেই আছে দুদকের সংস্কার- অর্থাৎ কমিশনের সংস্কার। তাহলে কি এই কমিশন কেবল একটি কমিশনের সংস্কার নিয়েই কাজ করবে, নাকি বৃহত্তর অর্থে দুর্নীতি নিয়েও কথা বলবে! বিষয়ে অস্পষ্টটা থাকলেও কেবল কমিশনই নয়, দুর্নীতি নিয়েও এই কমিশন কাজ করবে বলেই ধরে নেয়া যৌক্তিক হবে।
বর্তমান দুদকের জন্ম ২০০৪ সালের ৫ নম্বর আইনবলে। এর আগে ১৯৫৭ সালের দুর্নীতিবিরোধী আইনে দুর্নীতি দমন ব্যুরো কার্যকর ছিল। ব্যুরো থেকে কেন কমিশন করতে হলো, সেই পাঠ গ্রহণ ব্যতিরেকে বর্তমান কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব সম্পূর্ণ হবে না। সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল ব্যুরো এবং সাফল্য ছিল খুবই কম। ফলে একটি স্বাধীন কমিশন করতে হয়েছে; মোটা দাগে এই কারণটি বোধগম্য- কিন্তু ব্যুরো কেন সেই অর্থে সফল হয়নি এবং ২০০৪ সালের পর গঠিত কমিশন দুর্নীতি দমন বা হ্রাসে কতটা সাফল্য দেখাতে পেরেছে, অবশ্যই তা সংস্কার কমিশনকে অধ্যয়ন করতে হবে।
অনস্বীকার্য, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কমবেশি অর্ধশত বছর কেটেছে হয় বেনামি দরখাস্তের পেছনে, নয় তো তহশিলদার, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বর, পিআইও কিংবা সাব-রেজিস্ট্রারের পশ্চাতে! দু’-চারটি রুই-কাতলা ধরার চেষ্টা করলেও বড়শির সুতাই ছিঁড়ে গেছে। ক্ষমতায় আসীনদের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা ছিল না ব্যুরোর। ফলত, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর পাট চুকিয়ে ২০০৪ সালে শেষের দিকে আইন বদলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) যাত্রা; এরই মধ্যে ২০০৭, ২০১৬ ও ২০১৬ সালে আইনে পরিবর্তন আনা হয়। ২০০৭ সালে অগণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে দুদকের ক্ষমতা বৃদ্ধিও করা হয়েছিল; কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দুদকের আইনে আছে, যা ব্যুরোর আইনেও ছিল- দুর্নীতির বিষয়ে কোনো ব্যক্তির আবেদন বিবেচনায় নিয়ে অনুসন্ধান করা যাবে। এ ছাড়া কতগুলো অপরাধের বিবরণ আছে, যার বিষয়ে তদন্ত করার এখতিয়ারও আছে এই কমিশনের। ২০০৪ সালের আইনের ১৬ ধারায় অনেক বিষয়ের মধ্যে এটিও আছে যে, দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও গবেষণা- আছে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিতকরণ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। নামী-বেনামী আবেদনে দুর্নীতির নির্দিষ্ট তথ্য থাকলে তদন্ত হতেই পারে; প্রশ্ন হচ্ছে, বিগত দিনগুলোতে এই ধরনের আবেদনের পেছনে দৌড়ে ফল কী হয়েছে?
তহশিলদার, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বর, পিআইও, সাব-রেজিস্ট্রার, এসিল্যান্ড বা স্কুল-কলেজের প্রধানের দুর্নীতির গন্ধ বা সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে দুদক তাতে সময় দিতেই পারে- দুদক দুর্নীতি বন্ধ করতে পারবে না, হ্রাস করতে পারে আর সে জন্য কিছু দৃষ্টান্তমূলক এবং দৃষ্টিগ্রাহ্য পদক্ষেপ থাকা চাই। সে সব কি খুব একটা আছে? বৈশ্বিক সূচক বাদ দিলেও জনধারণা মোটেই ভালো নয়। প্রতিনিয়তই নানা দুর্নীতির খবর আসছে; এসবের কতকটা আবার সাদা-কালোয় ছাপা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক মিডিয়ায়ও চাউর হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দুদকের সেই অর্থে তেমন হেলদোল লক্ষণীয় নয় আর নাগরিক হিসেবে উৎকণ্ঠা এখানেই। বৈশি^ক সূচক কিংবা দেশের মানুষের উচ্চবাচ্য অথবা মিডিয়ায় প্রকাশিত দুর্র্নীতি নিয়ে দুদক বেশ নির্বিকারই; বরং কোথাও কোথাও ক্লিনচিটের বন্দোবস্ত করছে দুদকের মতো একটি স্বাধীন কমিশন।
ব্যাংক, বীমা, শেয়ার, ব্যবসায়, টেন্ডার, কর-শুল্ক, উন্নয়ন প্রকল্প, বিচারালয়, ভ‚মি অফিস, এসআরও, বন দফতর, শিক্ষাসহ কতিপয় পাবলিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি এখন প্রতিদিনের সূর্যোদয়ের মতোই প্রতিশব্দে রূপ নিয়েছে; সর্বত্র বিশাল আকারের দুর্নীতি ও অনিয়ম। এই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশে টাকা পাচার। এখানে উল্লেখ করতে হবে, ফিন্যান্সিয়াল করাপশন দেখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট আছে, কিন্তু তাদের অবস্থা ওই দুদকের মতোই। বড় বড় দুর্নীতি, হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির পেছনে দুদকের সময় দেয়ার সময় নেই, নয়তো বড় রুই-কাতলা ধরতে শক্ত সুতার বড়শিই নেই তাদের, কিংবা দুদক সরকারের আজ্ঞাবহ আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতোই গা ছেড়ে দিয়েছে। শেষেরটার সত্যতা তো আছেই। ফলে এই দুদকের মেরামত করা খুবই জরুরি- এখনই করা চাই। সেটিই সংস্কার কমিশন গঠনের লক্ষ্য।
দুদক আজতক কতগুলো অভিযোগের তদন্ত করেছে, কতটি মামলায় কতগুলো চার্জশিট দিয়েছে, সেটি দুদকের সাফল্য-ব্যর্থতার একটি মাপকাঠি তো বটেই। এরপর আছে, কতটি মামলায় শাস্তি হয়েছে- এই প্রশ্ন। বলা হবে, সব মামলায় সাজা হবে না; আদালতে প্রমাণ হতে হবে। মানলাম। কিন্তু দুদক একেকটি মামলা তদন্তে, মামলা দায়েরে আর চার্জশিট দিতে দীর্ঘ সময় নেয়ার পরও প্রমাণ করতে না পারার দায়ভারও দুদকেরই। এসব বিষয়ে গভীরভাবে অনুধাবন করেই কমিশন সংস্কারের প্রস্তাব হতে পারে।
দুদকের আইনে বিশেষ পরিবর্তনের আবশ্যকতা নেই। নেই কমিশন গঠনের কিংবা চেয়ারম্যান-কমিশনার যোগ্যতা নিয়ে। বাছাই কমিটিও জুতসই আছে। একটি প্রশ্ন আসবে, পাঁচজনের বাছাই কমিটি কি স্বাধীনভাবে তিনজন কমিশনার বাছাই করতে সমর্থ হচ্ছে, নাকি সরকারের ইচ্ছেতেই সিলমোহর দিয়ে দিচ্ছে? আবার তিনজন থেকে একজন চেয়ারম্যান নিয়োগে রাষ্ট্রপতি কি স্বাধীন-নৈর্ব্যক্তিকভাবে স্বীয় ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাতে পারছেন? আদতে এখানেই সংস্কার দরকার হবে। চেয়ারম্যান-কমিশনার হয়েই কেন সরকারের তল্পিবাহকে পরিণত হয়ে যায় তিন তিনজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সেটির অনুসন্ধানও হবে সংস্কার কমিটির অন্যতম কাজ। অপরাধমূলক কাজ জেনেও একজন মানুষ কেন দুর্নীতির মতো কাজের দিকে ধাবিত হয়; সেকি কেবলই অভাব-অনটনের জন্য, নাকি আরো কারণ আছে- বের করার দরকার হবেই, বলতে হবে এর দাওয়াই কী। দুর্নীতি কেন দিনে দিনে বেড়েই চলছে, সেই কারণ খুঁজে না পেলে সুপারিশই-বা কী হবে!
দুদক কেন নিরীহ জনের হয়রানির কারণ হবে? কেন দুদকের জনবলের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ মানুষের মনে পাহাড়ের সমান হয়ে জমা হয়? কেন বড় বড় দুর্নীতি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে আর কেনই-বা ক্ষমতাসীনদের স্পর্শে এতটা ভয় এবং এসব উত্তরণের উপায় তো সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে মানুষ দেখতে চায়। একটি প্রতিষ্ঠান কতটুকু স্বাধীন থাকবে, সেটির মাথার উপর আরো কোনো নিয়ন্ত্রক থাকার দরকার আছে কিনা, কমিশনের রিপোর্টে থাকা চাই।
দুর্নীতির এখন নানারূপ- বিভিন্ন উপায়ে দুর্নীতির বিস্তার। এসব সামাল দিতে দুদকের পর্যাপ্ত এবং উপযুক্ত জনবল আছে কিনা; কমিশন তা জানাতে পারে। সংস্কার কমিশনকে বুঝতে হবে, ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের টাকা বা সম্পদ দিয়ে একজন কী করে? বিদেশে পাঠায়, দেশে গাড়ি-বাড়ি করে, বাসায় রাখে কেউ কেউ, ব্যাংকে জমায়, শেয়ার-টেয়ার কেনে, লগ্নি করে এবং কেউ নিকটজনের নামেও গচ্ছিত রাখে; ভোগও করে, সে আর কতটুকুন! এখন দরখাস্তের পেছনে কিংবা উড়ো বার্তার পেছনে না দৌড়ে সম্পদের পেছনে দৌড়ালেই তো আরাম হয়। দুর্নীতির গর্ভগৃহে প্রবেশ না করলে দুর্নীতির টিকিটিও স্পর্শ করা যাবে না। ইকবাল মাহমুদ কমিশন হুটহাট নানা জায়গায় দুর্নীতি ধরতে চলে যেত। কিন্তু কোনো দিন রমনা থানায় যাওয়ার কথা কাগজে ওঠেনি। বাধ্য হয়ে লিখেছিলাম, ‘দুদক অফিস থেকে রমনা থানা কতদূর?’ ইকবাল মাহমুদ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। জানতেন, রাত ১২টার পর রাজধানীর একটি থানায় কী হয়- কিন্তু সেখানে এক দিনও যাননি; গেছেন স্কুলে-তহশিল অফিসে।
দুদকের তদন্ত পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা চাই এবং চাই সেই সুপারিশ। ব্যক্তি অথবা অভিযোগের পশ্চাতে নয়, দৌড়াতে হবে সম্পদের পেছনে। অবস্থার নানা পরিবর্তন হয়েছে এখন; ডিজিটাল দুর্নীতিটাই বড় যেন। ব্যাংক দখল করতে সশরীরে যেতেই হয় না। কিন্তু পথে বা বেপথে কিংবা প্রথাবিরোধী পন্থায় অর্জিত সম্পদের ব্যবহারে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। সম্পদের পেছনে ছুটতে হলে অনেকটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। প্রতিটিতে প্রশাসন, সেনা সদস্য, পুলিশ, কর-শুল্ক, বিচার এবং পূর্তের লোকও থাকবে- এই টাস্কফোর্সের উপর থাকবে বিশেষ নজরদারি। শুরু হোক উত্তরা-সদরঘাট-বসুন্ধরা-শনির আখড়া থেকে। বাড়ির নিচে গিয়ে খুঁজুন বাড়ির মালিককে। সাদামাটা সহজ ফর্ম ধরিয়ে দিন। যেখানে ব্যক্তির পেশা, আয়-ব্যয়, বার্ষিক কর-প্রদানের তথ্য থাকবে। সময় দিন সাত-চৌদ্দো-আটাশ দিন, চাইলে আরো দিন। নিশ্চিত করুন, কোনো দালাল নয়, সরাসরিই এটি পূরণ করে নিয়ে আসেন। সঙ্গে পূর্তের সদস্য মেপে নিক বাড়ির পরিমাপ-সাল। সহজেই বেরুবে ওই সময়ে ন্যূনতম ব্যয় কত হয়েছিল। টাস্কফোর্স যাক ব্যাংকে। লেনদেনে কোটি বা বিশ-চল্লিশ-ষাট লাখ ছাড়ালেই নোট করুন। কালকে নোটিশ যাক; জনাব কোথায় পেয়েছেন এই টাকা? রিহাবকে বলে দিন, ফ্ল্যাট বিক্রি হলেই নির্র্ধারিত ফর্মে তথ্য দিতে হবে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে নিয়মিত জমি ক্রেতার তথ্য আসুক। শেয়ার বা অন্য লগ্নির জায়গাও বাদ যাবে না।
বিশ্বাস করার কারণ আছে, বহু বাড়ির মালিককে খুঁজে পাওয়া দুরূহ হবে। ছবি না থাকলে ব্যাংকের হিসাবধারীকেও পাওয়া দুরূহ হবে। চাকরি নেই, আয় নেই কিন্তু বাড়ি বানাচ্ছে, গাড়িতে চড়ছে; আমাদের চোখের সামনে। একমাত্র দুদক দেখছে না। আর বাইরে পাচার, ওভার ইনভয়েসিং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই ইউনিটই দেখুক। সংস্কার কমিশন দুদকের কর্মপদ্ধতিতে এই পরিবর্তন আনার সুপারিশ করবে কি?
মানুষ দেখতে চায়, সংস্কার কমিশন কী প্রতিবেদন দেয় আর অন্তর্বর্তী সরকার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও কথাসাহিত্যিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা