০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর : কী ঘটেছিল

- ছবি : সংগৃহীত

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে ১১ মিনিটের সংসদ অধিবেশনে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তখনকার প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলমন্ত্র ছিল ব্যালটের মর্যাদা, গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লড়াই। সংবিধানে মূল চার স্তম্ভের মধ্যে ছিল অন্যতম গণতন্ত্র। মূল স্তম্ভ গণতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটাতে সংসদের হাতে কোনো ক্ষমতা ছিল না। দেশের মৌলিক চার স্তম্ভের একটি বিলুপ্ত করতে গেলে গণভোটের আবশ্যকতা ছিল। একদলীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে সংসদীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটে যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা। ঘটে ক্ষমতার পালাবদল, তাৎক্ষণিক বাকশালের বিলুপ্তি, রক্ষীবাহিনীর বিলুপ্তিসহ আরো কিছু পরিবর্তন। প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণের ৯ দিন পর্যন্ত সেনাপ্রধান ছিলেন পূর্বেকার সেনাপ্রধান এস এম সফি উল্লাহ। প্রেসিডেন্টের ডিফেন্স অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ পান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সেনাপ্রধান কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী; বাকশাল সরকারের ২১ জনের মন্ত্রিসভা এবং সংসদ বহাল থাকে। মোশতাক সরকার ৯ দিন পর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন।

২. খন্দকার মোশতাকের শাসনামলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম) সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙের অভিযোগে তার অনুসারীদের নিয়ে ২ নভেম্বর রাতে পাল্টা সেনা অভ্যুত্থানের প্রারম্ভিক পর্যায়েই সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে ফেলেন। দৃশ্যত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সেনা অভ্যুত্থান সফল হলেও তখনো বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের অবস্থানের অবসান ঘটাতে পারেননি। বঙ্গভবনে কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদের ট্যাংক আর্টিলারি বাহিনীর সুদৃঢ় অবস্থান ছিল। বঙ্গভবন দখল করে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করলে সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা দেখা দেয়, যার দরুন রক্তপাত ঘটা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ক্যান্টনমেন্টে ক্ষমতা দখলকারী খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে অবস্থানরত কর্নেল রশিদের মাধ্যমে সঙ্ঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার রদবদলের দীর্ঘ আলোচনার পর চার দফা চুক্তিভিত্তিক, বঙ্গভবনে ১৫ আগস্টের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার পথ সুগম করে দেন। চার দফার মধ্যে ছিল খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল থাকার সম্মতি। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করার অভিযোগে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তিনি নিজেই পদোন্নতি নিলেন; সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে ফেলেন।

৩. প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক অবস্থার হেন সঙ্কটসঙ্কুল পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মো: সায়েমকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করলে ৫ নভেম্বর তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য, খালেদ মোশাররফ প্রধান বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেননি, বরং খালেদ মোশাররফ চেয়েছিলেন খন্দকার মোশতাকই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করুন।

৪. সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের গৃহবন্দী এবং খালেদ মোশাররফ সেনাপতি হিসাবে ঘোষণা আসার পর জিয়াউর রহমানের সেনাপতির পদের অবসান ঘটে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সেনাবাহিনীতে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা থাকা সত্তে¡ও তার গৃহবন্দীর দুর্দশা থেকে উদ্ধারে ঢাকা সেনানিবাস থেকে তার পক্ষে কোনো প্রকার সহায়তা আসেনি কর্নেল আবু তাহের ৬ নভেম্বর রাত ১২.১ মিনিট অর্থাৎ ৭ নভেম্বরের ঊষালগ্নে ঢাকা সেনা ছাউনিতে সিপাহি গণবাহিনীর অভ্যুত্থান না ঘটানো পর্যন্ত।

৫. কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম সেনাবাহিনীতে থাকাবস্থায় তিনি জাসদ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন এবং বাংলাদেশে গোপনে সেনা ছাউনিতে গণবাহিনী গঠন করেন। পরে তিনি গণবাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে প্রয়াসী হন।

৬. ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দৃশ্যত ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সেনা অফিসারদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে খালেদ মোশাররফ প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিলেও যেকোনো সময় তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে যেতে পারবেন- এই ধরনের কৌশল তার ছিল। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখলের পরপর তার মা, ভাইসহ আওয়ামী লীগপন্থীদের ঢাকা রাজধানীতে বিরাট মিছিল বের হয়।

৭. নতুন সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তা এবং সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তার প্রতিদ্ব›দ্বী মনে করে তাদের হটানো অভ্যুত্থানের সফলতা হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের অবস্থান, ৩ নভেম্বর গভীর রাতে জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি কারণে দেশে দৃশ্যমান কোনো সরকার নেই, তা স্পষ্টত পরিলক্ষিত হয়। তারই প্রেক্ষাপটে সেনাপতি খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে ৬ নভেম্বর রাত ১২.১ মিনিটে ঢাকা সেনা ছাউনিতে কর্নেল তাহেরের লিফলেট বিতরণ এবং সিপাহিদের সমন্বয়ে গণবাহিনীর পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।

৮. কর্নেল তাহের ও জাসদের পরিকল্পনা ছিল সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। ৭ নভেম্বর রাতভর কর্নেল আবু তাহের, ঢাকা রাজধানীর দায়িত্বে জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, কর্নেল আবু তাহেরের ভাই ডা: আনোয়ার হোসেন প্রমুখ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। সে দিন রাতেই প্রায় ২৩ জন সেনাকর্তা অনেকের পরিবারসহ সিপাহি গণবাহিনী বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। সেনাপতি জিয়াউর রহমান ২ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে গৃহবন্দী দশা, পরাজিত স্বঘোষিত সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফের পলায়ন, অফিসাররা নিজ নিজ প্রাণ বাঁচানোর অবস্থানে থাকায় ঢাকা সেনা ছাউনিতে কর্নেল তাহেরের সিপাহি গণবাহিনীর বিপ্লবী স্লোগান এবং তাদের লিফলেট সেনা ছাউনির সর্বত্র বিদ্যমান ছিল, বিরোধী পাল্টা সেনা কর্মকাণ্ডের কোনো অবস্থান ছিল না। ৭ নভেম্বর রাত ভোর হওয়া সময়ে কর্নেল তাহেরের জাসদ সমর্থিত বিপ্লব দৃশ্যমান সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। খালেদ মোশাররফ তার অনুসারী কর্নেল হায়দার এবং মেজর হুদাকে নিয়ে ৭ নভেম্বরে কর্নেল তাহেরের অভ্যুথানের দাপটে প্রাণ রক্ষার জন্য ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেসে আশ্রয় নিয়ে ৭ নভেম্বর রাতটা অন্ততপক্ষে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। কর্নেল তাহেরের পরিকল্পিত সিপাহি গণবাহিনীর অভ্যুত্থান ছিল তখনকার পর্যায়ের পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা গ্রহণকারী সেনাপতি খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে। কর্নেল আবু তাহেরের সিপাহি গণবাহিনী স্বাভাবিকভাবেই খালেদ মোশাররফদের অনুসারীদের বাধার সম্মুখীন হওয়ার কথা। কিন্তু খালেদ মোশাররফ অনুসারী কর্নেল জাফর ইমামসহ সবাই জীবন রক্ষার্থে পালিয়ে যান। খালেদ মোশাররফ গণবাহিনীর হাতে তার সহচর কর্নেল হায়দার ও মেজর হুদাসহ নিহত হন। কর্নেল তাহেরের বিপ্লব সফল হয়।

৯. ৭ নভেম্বর অতি প্রত্যুষে অষ্টম বেঙ্গলের ব্রিগেডিয়ার আমিন জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে তার অফিসে নিয়ে আসেন। কর্নেল তাহেরের সিপাহি গণবাহিনী জিয়াউর রহমানকে না পেয়ে ফিরে আসে। এ খবর জানতে পেরে কর্নেল তাহের ব্রিগেডিয়ার আমিনের অফিসে গিয়ে সেখান থেকে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার নাম করে জিয়াকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। জিয়া রাজি হননি। ফলে রেহাই পেয়ে যান। ব্রিগেডিয়ার আমিনের মাধ্যমে মুক্ত হওয়ার পর জিয়ার অনুসারী অফিসার এবং সিপাহিদের এক অংশ জিয়াকে রাজপথে বিজয়ী বেশে নিয়ে আসেন।

খালেদ মোশাররফ চেয়েছিলেন ১৫ আগস্টের সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট এক সেনা অভ্যুত্থান। দেশের জনগণ ছিল কমিউনিজম এবং ভারতবিরোধী। দুই যুগল মিশ্রণে মুক্ত সেনাপতি জিয়াউর রহমানকে পেয়ে কর্নেল ফারুকের ট্যাংক বাহিনী এবং কর্নেল রশিদের আর্টিলারি বাহিনী বঙ্গভবন থেকে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। ট্যাংক বহরে ছিল জিয়াউর রহমানের ছবি। রাজধানীর রাজপথে লাখো জনতার মিছিল; নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত নেতৃত্বের পুরোভাগে জিয়াউর রহমান।

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী


আরো সংবাদ



premium cement
উপদেষ্টা ফারুক ই আজমের সাথে জাতিসঙ্ঘের গোয়েন লুইসের সাক্ষাৎ বিপিএল থিম গ্রাফিতি ও থিম সং প্রকাশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত সেনাসদস্যদের দেশপ্রেমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে : সেনাপ্রধান এক বিজয় অর্জন করেছো, আরেক বিজয় আসবে : শিক্ষার্থীদের প্রধান উপদেষ্টা জবির ঐক্যের মঞ্চে থাকবেন হাসনাত-রাকিব-মঞ্জুরসহ ১২ সংগঠনের নেতা প্রধান উপদেষ্টার সংলাপে যাবেন বিএনপির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল লেবাননে যুদ্ধ শেষ হয়নি : নেতানিয়াহু বরিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্রিকেটার নিহত ঢাকায় তিন দিনব্যাপী ইরানি চলচ্চিত্র উৎসব শুরু দূতাবাসের নিরাপত্তার বিষয়ে ভিয়েনা কনভেনশনে কী আছে?

সকল