পরিমিত শিক্ষায় পাঁচটি শর্ত
- মো: সরোয়ার উদ্দিন
- ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৫৭
শিক্ষা গ্রহণে মানুষ জ্ঞানী ও দক্ষ হয়, অন্তরের কালিমা মুছে যায়। বাস্তবতা ও অ্যাকাডেমিক শিক্ষা গ্রহণে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, চিন্তা, ধারণা ও উপলব্ধি প্রভৃতিসহ মেধাশক্তি প্রকৃতভাবে বিকশিত ও উন্মেষ ঘটে। জগতের ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, উন্নত-অনুন্নত, সঠিক-ভুল ও গ্রহণ-বর্জন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিকল্পের ভেতর থেকে বেশি কার্যকর, মঙ্গলজনক, উত্তম ও পরিমিতকে চূড়ান্তভাবে বেছে নিতে সক্ষম করে তোলে।
এ নিরিখে উত্তম শিক্ষার পাঁচটি শর্ত : যেমন- ১. পাঠ্যসূচি, ২. আঙ্গিনা, ৩. শিক্ষক, ৪. মেধাশক্তি ও ৫. কৌশল।
পাঠ্যসূচি : উত্তম শিক্ষায় আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যসূচি প্রবর্তন করা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে জাতীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও দর্শন যথাযথভাবে অনুধাবন করার মধ্য দিয়ে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং সঠিকভাবে প্রতিফলনের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। জাতির ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ঐক্যের ভিত্তিতে সঠিক দিকনির্দেশনা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণে সক্ষম হতে হবে। অকেজো, দুর্বল, পুরনো ও নতজানু পদ্ধতি ও উপকরণ প্রভৃতি বাদ দিয়ে প্রযুক্তিগত সুবিধা, চলমান বিশ্বে জ্ঞানের বিস্তৃতি ও গতিধারা এবং যুগের চাহিদা ক্রমাগত পরিবর্তনে অগ্রাধিকার দিয়ে সমৃদ্ধ, কল্যাণমুখী এবং উত্তমের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বিনির্মাণে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে ভালো, যোগ্য ও দক্ষ মানুষ গড়ে তোলায় শিক্ষানীতির প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এ ছাড়াও বিশ্ব-শ্রমবাজারে চাহিদা অনুযায়ী যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি রফতানির উদ্দেশ্যে কারিগরি শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এ জন্য কারিগরি ধারায় উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণ ও পরিমিত উৎকর্ষ সাধন করা একান্ত প্রয়োজন। এ নিরিখে দেশের কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের ওপর বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশেষায়িত দক্ষ জনশক্তি তৈরির কারখানায় পরিণত করা যেতে পারে।
আঙ্গিনা : শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষাদান এবং শিক্ষার্থীরা যথাযথভাবে জ্ঞান আয়ত্তকরণে উত্তম আঙ্গিনার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিমিতভাবে পাঠদানের প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, ল্যাব (কম্পিউটার ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক প্রভৃতি উপকরণ), গ্রন্থগার, প্রত্যেক বিভাগে নিজস্ব সেমিনার, প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ, শিক্ষক এবং অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রভৃতির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও আসবাবপত্র, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পৃথক হল, মিলনায়তন, চিকিৎসাকেন্দ্র, শিক্ষকদের জন্য আবাসনসহ ডরমিটরি, যাতায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি থাকা আবশ্যক।
প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের সুবিধা; ফুল ও ফল, ঔষধি ও বনজ বৃক্ষ প্রভৃতি বাগান তৈরি; নিকটস্থ হাট-বাজার প্রভৃতির বিরক্তকর শব্দ, শিল্প-কারখানা প্রভৃতি হতে নির্গত কালো ও দূষিত ধোঁয়া প্রভৃতি হতে আঙ্গিনা মুক্ত রাখা জরুরি।
এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ অনিয়ম, দুর্ঘটনা ও অনাক্সিক্ষত প্রভৃতি ঘটনার সাথে সাথে শুরাহা করা। একই সাথে মুখ্য ঘটনা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে আনা প্রয়োজন।
শিক্ষক : আদর্শবান, যোগ্য-দক্ষ শিক্ষক ধৈর্য ও সাহসের সাথে পাঠ্যসূচির বিষয় ও দিক সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা, জ্ঞানের গভীরতা ও বৈচিত্র্যময় কলাকৌশল প্রভৃতি দিয়ে মেধাবীদের বহুমুখী উদ্ভাবনী জ্ঞান ও স্মরণশক্তির উন্মেষ ঘটিয়ে থাকেন। শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সময়ে নির্ধারিত পথ অনুসরণের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনের আশায় এবং জ্ঞানভাণ্ডার আরো সমৃদ্ধ করার নেশায় জ্ঞান-সাগরে নিবিড় অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে অমূল্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। এভাবে পৃথিবীর বেশির ভাগ নামকরা ও বিখ্যাত-সাধক, জ্ঞাণী, গবেষক, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক প্রমুখের আবির্ভাব ঘটেছে।
মেধা : বর্তমান বিশ্বে প্রতিযোগতায় টিকে থাকাসহ সুখ-শান্তি এবং উন্নত ও সমৃদ্ধশালী প্রভৃতি সমাজ, জাতি ও দেশ গড়তে মেধাশক্তির পরিপূর্ণ উৎকর্ষসাধন ও ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এ নিরিখে বাস্তবতাসহ অ্যাকাডেমিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ মানসম্পন্ন, বিশেষায়িত জ্ঞানার্জন এবং অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব হয়। এ লক্ষ্যে প্রত্যেক পরিবার, সমাজ, ধর্ম, গোত্র, সংস্কৃতি, দেশ ও জাতি প্রভৃতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া ও চলায় সক্ষম করে তুলতে পারে একমাত্র পরিমিত শিক্ষা। এ জন্য শিক্ষাবিদদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ও উত্তম পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা সম্ভব।
মেধা তিন প্রকার, যথা- ক. নিম্ন, খ. মাঝারি ও গ. তীক্ষè অথচ বিশাল। নিম্ন মেধাবীরা একাধিকবার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচিতে উল্লিখিত বিষয়গুলো মস্তিষ্কে আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়। এ নিরিখে যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে নির্ধারিত পাঠ্যবিষয়ের ওপর নিয়মিত পাঠদান এবং তা উদ্ধারের (মৌখিক ও লিখিতভাবে) প্রচেষ্টাসহ নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন, পরিবীক্ষণ করলে এটি সহজে হতে পারে। এটি কার্যকর যাতে হয়, তার জন্য প্রাথমিক স্তরের অ্যাকাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
মাঝারি মেধাবী শিক্ষার্থী একটু বেশি পরিশ্রমে পাঠ্যবিষয় আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়। এ জন্য এসএসসি পাসের পর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রভৃতি শিক্ষা গ্রহণ করাই শ্রেয়।
তীক্ষ্ম মেধাবীরা অল্প সময়ে কঠিন বিষয়গুলো অতি সহজে বেশি পরিমাণে আয়ত্ত করতে পারে। তাদের অ্যাকাডেমিক উচ্চশিক্ষার নানা বিষয় ও দিক সম্পর্কে জ্ঞানার্জনসহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ, বিশেষায়িত জ্ঞানার্জন ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধি অর্জনে প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
কৌশল : প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বসার নির্ধারিত আসন থাকতে হবে। কোনো অবস্থায় নির্দিষ্টসংখ্যক আসনের চেয়ে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। বসার বেঞ্চ/চেয়ারের সাথে হাইবেঞ্চ/টেবিলের সংযুক্ত ড্রয়ারের (অর্থ, বই ও খাতা প্রভৃতি দ্রব্য হেফাজতে সংরক্ষণের জন্য) ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রথম ক্লাস আরম্ভের কমপক্ষে পাঁচ মিনিট আগে এবং পরবর্তী ক্লাসগুলোর মধ্যে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট বিরতি দেয়া যেতে পারে। কমপক্ষে ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। এর চেয়ে কম উপস্থিত থাকলে কোনো অবস্থায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না।
অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় কেবল এক বিষয়ে ফেলকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী ক্লাসে ওঠার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেলের ক্ষেত্রে বোর্ড/বিশ্ববিদ্যালয়ের চ‚ড়ান্ত পরীক্ষার ফরম পূরণ সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না (এর সপক্ষে নির্বাচনী পরীক্ষা নম্বরপত্র প্রমাণ হিসেবে সংযুক্ত করা যেতে পারে)। চূড়ান্ত পরীক্ষায় পরীক্ষার হলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং কোনো রকম অসদাচরণ কিংবা অনাক্সিক্ষত ঘটনার জন্য দৃষ্টন্তমূলক শাস্তি প্রদানসহ কেন্দ্রে নোটিশ বোর্ড, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট বোর্ড/বিশ্ববিদ্যালয়কে লিখিতভাবে অবহিত করা আবশ্যক। কেবল ক্লাসে পাঠদানকারী এবং অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল শিক্ষকদের দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়নের দায়িত্ব দেয়াই শ্রেয়।
কিছু সরকারি কলেজর অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানরা চূড়ান্ত (বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়) পরীক্ষার হলে সরাসরি দায়িত্ব পালন করেন না। এ ক্ষেত্রে তারা কেবল দু-একবারের জন্য দলবদ্ধ হয়ে হলের সামনের রাস্তায় এবং করিডোর পর্যন্ত যাওয়া-আসার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকেন। অথচ তারা এ দায়িত্ব পালন করলে এক দিকে যেমন সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষকদের পরীক্ষাসংক্রান্ত কলাকৌশল ও গুণগত মান বাড়বে, অন্য দিকে পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা আরো সমৃদ্ধ হবে। মজার বিষয় হলো- দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলেও সবাই উল্লিখিত কাজের পারিশ্রমিক ঠিকই গ্রহণ করে থাকেন।
নম্বর প্রদানে সাধারণ উত্তরে ৪৫-৫৫, ভালোতে ৫৬-৬৫, উত্তমে ৬৬-৭৫ এবং অতিউত্তমে ৭৬-৮৫ শতাংশ নম্বর দেয়া শ্রেয়। প্রত্যেককে ২০০টির কাছাকাছি সংখ্যক উত্তরপত্র বরাদ্দ করা যেতে পারে। মূল্যায়ন শেষে নির্ধারিত সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল প্রধান পরীক্ষকের ঠিকানায় মূল্যয়নকৃত উত্তরপত্র পাঠাতে হবে। একই সাথে নিরীক্ষকদের মতামত ও রিপোর্টের ভিত্তিতে এবং প্রমাণসাপেক্ষে, যদি কোনো পরীক্ষক অস্বাভাবিক উচ্চ (বেশি) অথবা কম (নিম্ন) হারে নম্বর দেন বা উত্তরপত্রের ভেতরে প্রদত্ত নম্বর কাভার পাতায় সঠিকভাবে তুলে না থাকেন; এ ক্ষেত্রে ওই পরীক্ষককে দিয়ে ওই উত্তরপত্রের সঠিক নম্বর অথবা প্রয়োজনে দ্বিতীয় পরীক্ষক নিয়োগসহ উত্তরপত্রগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
ইনকোর্স পরীক্ষায় ২০ নম্বর বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট কলেজে। এই ২০ নম্বর এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ৮০ নম্বর চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর যুক্ত হয়ে মোট ১০০ নম্বরের ওপর ফল ঘোষণা করা হয়। ইনকোর্স পরীক্ষার যে হালহকিকত যা শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশে আদৌ সহয়তা করে কি না! তবে কলেজ প্রশাসনসহ বিভাগের শিক্ষক ও কর্মচারীদের রীতিমতো আয়ের উৎস হিসেবে পরিণত হয়েছে- এ কথা দিব্যি বলা যায়।
লেখক : সরকারি কলেজের অধ্যাপক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা