২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতি ও ইতিহাস

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতি ও ইতিহাস - ফাইল ছবি

আগামীকাল (৫ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। পৃথিবীর অন্যতম সুপার পাওয়ার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় প্রতি চার বছর পর। এ নির্বাচনের উত্তাপ শুধু আমেরিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি অন্যান্য দেশের মতো সহজ নয়, এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া।

দ্বিদলীয় নির্বাচন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি রাজনৈতিক দল হচ্ছে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দল। ছোট ছোট কিছু রাজনৈতিক দলও রয়েছে। যেমন- লিবার্টারিয়ান, গ্রিন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি। এসব দলও অনেক সময় প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। রিপাবলিকান পার্টি : রিপাবলিকান পার্টি ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’ নামে পরিচিত। এটি একটি রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল। সাধারণভাবে দেখা যায়, গ্রামীণ এলাকাগুলোতে রিপাবলিকান পার্টির সমর্থন বেশি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির এবারের প্রার্থী। রিপাবলিকান পার্টির আগের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে আছেন জর্জ ডব্লিউ বুশ, রোনাল্ড রেগান ও রিচার্ড নিক্সন।

ডেমোক্রেটিক পার্টি : যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ডেমোক্রেটিক পার্টি হচ্ছে উদারনৈতিক রাজনৈতিক দল। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে জয় লাভ করেছেন। জো বাইডেন একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। বারাক ওবামা যখন আট বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন জো বাইডেন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমেরিকার শহর অঞ্চলগুলোতে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থন জোরালো। সাবেক ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্টদের মধ্যে রয়েছেন জন এফ কেনেডি, বিল ক্লিনটন এবং বারাক ওবামা।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর যোগ্যতা : জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক হতে হবে। কমপক্ষে ১৪ বছর আমেরিকায় অবস্থান করতে হবে। বয়স ৩৫ বছর হতে হবে। কেউ দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে পারবে না।

কারা ভোট দিতে পারবে না : কোনো বিদেশী জাতীয় পর্যায়ের কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে না। নির্বাচনী এলাকায় নির্দিষ্ট সময় (সাধারণত ৩০ দিন) বসবাস না করলে ভোট দিতে পারবে না। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী এবং কোনো কারাবন্দী ভোট দিতে পারবে না।

প্রতীক হাতি আর গাধা কেন : রিপাবলিকান প্রার্থীর প্রতীক হচ্ছে হাতি আর ডেমোক্রেটিক প্রার্থীর প্রতীক গাধা। প্রশ্ন হচ্ছে- একটি উন্নত দেশের দলের প্রতীক কিভাবে হাতি আর গাধা হয়? প্রতীক নির্বাচনের বিষয়টি খুবই মজার। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের দৃষ্টিভঙ্গি ও স্লোগান ছিল জনগণকে শাসন করতে দাও। তার এই নীতির জন্য সমালোচকরা তাকে গাধা বলে। জ্যাকসন সমালোচনার পরও এই নীতিতে অটুট থাকেন এবং নির্বাচনী প্রচারণায় গাধার ছবি ব্যবহার করেন। এভাবে গাধাই হয়ে যায় ডেমোক্রেটদের স্থায়ী প্রতীক। ১৮৭৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউলিসেস এস গ্রান্ট তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেন। তার সমালোচনা করে কার্টুনিস্ট থমাস নাস্ট একটি কার্টুন ছাপান, যেখানে রিপাবলিকান ভোটকে ফুটিয়ে তুলতে হাতি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে এটিই হয় রিপাবলিকান দলের স্থায়ী প্রতীক।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি : নাগরিকদের সরাসরি ভোটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। এ দেশে নির্বাচন পদ্ধতি হলো পরোক্ষ। নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে প্রার্থীকে দুই ধরনের ভোটে জিততে হয়। একটি হচ্ছে পপুলার ভোট বা সাধারণ জনগণের ভোট। আরেকটি হচ্ছে ইলেকটোরাল ভোট। প্রথমে জনগণ ভোট দিয়ে ইলেকটোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলী নির্বাচন করেন। এখানে একটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যালট পেপারে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম লেখা থাকে। আবার একেক রাজ্যের নিয়মানুসারে নির্বাচকমণ্ডলীর নাম উল্লেখ থাকতেও পারে, নাও পারে। জনগণ কোনো নির্দিষ্ট প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে ভোট দেয়ার অর্থ হলো তার দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দেয়া। পরবর্তীতে এই নির্বাচকমণ্ডলী ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন জনগণের পছন্দের প্রেসিডেন্টকে। নির্বাচনে প্রার্থীরা সাধারণত ইলেকটোরাল ভোট জেতার জন্য লড়াই করেন। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। যে অঙ্গরাজ্যে জনসংখ্যা বেশি তার ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যাও বেশি। মোট ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা হচ্ছে ৫৩৮টি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে একজন প্রার্থীকে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেতে হয়। একটি রাজ্যে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি পপুলার ভোট পান তিনি ওই রাজ্যের সবগুলো ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যান।

অবশ্য দু’টি রাজ্যের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম আছে। এভাবে একেকটি রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট যোগ হয়ে যে প্রার্থী ২৭০ পার হন তিনিই হন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোট যে অঙ্গরাজ্যগুলোতে রয়েছে সেগুলো হলো- ক্যালিফোর্নিয়া (৫৫), টেক্সাস (৩৮), ফ্লোরিডা (২৯), নিউ ইয়র্ক (২৯), ইলিনয় (২০), পেনসিলভানিয়া (২০)। যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ রাজ্যই রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট বলে চিহ্নিত হয়ে গেছে। তাই প্রার্থীরা প্রচারণার সময় নিরপেক্ষ রাজ্য জর্জিয়া, অ্যারিজোনা, মিশিগান, নেভাদা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিনের দিকে বেশি মনোযোগ দেন। কারণ এই রাজ্যগুলোতে বোঝা যায় না জনগণ কোন দলকে সমর্থন করে। এগুলোকে বলে ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ স্টেট। অর্থাৎ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আসল লড়াই হয় এ রাজ্যগুলোতেই। কেউ যদি মার্কিন নাগরিক হয় এবং বয়স যদি ১৮ বছর হয় তাহলে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে। ভোট গণনা হতে কয়েক দিন লাগে। তবে নির্বাচনের পরের দিনই বোঝা যায়, কে বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। নতুন প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন ২০ জানুয়ারি। এই অনুষ্ঠানের পরই নতুন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজে যান তার চার বছরব্যাপী মেয়াদ শুরু করার জন্য।

কেন এই পদ্ধতি বেছে নেয়া হলো : অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন দেশটির বিশাল আকার ও বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ কঠিন হওয়ার কারণে জাতীয়ভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তখনো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয় ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি, অঙ্গরাজ্যগুলোও তাদের নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে ছিল অনেক বেশি সোচ্চার। রাজনৈতিক দলগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো এবং পপুলার ভোটকে মানুষ ভয় পেতো। সংবিধান প্রণেতারা ১৭৮৭ সালে সংবিধান রচনার সময় কংগ্রেস এবং জনগণের সরাসরি ভোটে (পপুলার ভোট) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুটো ধারণাই বাতিল করে দেন। তাদের যুক্তি ছিল পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে লোকেরা তাদের স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেবে এবং তার ফলে বড় রাজ্যগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। ছোট ছোট রাজ্যগুলো এই ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিকে সমর্থন করে কারণ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই পদ্ধতির পক্ষ নেয় কারণ সে সময় এসব রাজ্যে দাসের সংখ্যা ছিল অনেক। দাসদের ভোটাধিকার না থাকলেও আদম শুমারিতে তাদের গণনা করা হতো। এ ছাড়াও সংবিধান রচয়িতারা চাননি, রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে শুধু আইন প্রণেতারা দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করুক।

নির্বাচনের ইতিহাস : যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন। ১৭৮৯ সালে কার্যকর হওয়া মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী তিনি নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস। ১৭৯৭ সালে তিনি নির্বাচিত হন। হোয়াইট হাউজে বসবাসকারী প্রথম প্রেসিডেন্ট তিনি।

১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। তিনি রিপাবলিকান পার্টির প্রথম প্রেসিডেন্ট। দাসপ্রথার চরম বিরোধী ছিলেন। ১৮৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার অবসান ঘটান। ১৮৬৫ সালের ১৫ এপ্রিল গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। বারাক ওবামা ৪৪তম প্রেসিডেন্ট। তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত হন। ২০১২ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি রিপাবলিকান পার্টি থেকে নির্বাচিত হন। তিনি একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য জো বাইডেন এর আগে ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪৭তম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আগামীকাল হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দুই প্রার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিয়েছে বিভিন্ন জরিপ প্রতিষ্ঠান। শেষ পর্যন্ত কে হতে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। কমলা হ্যারিস নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেখার জন্য পুরো বিশ্ব অপেক্ষায়।

লেখক : লেখক ও প্রভাষক


আরো সংবাদ



premium cement
আগামী বছর রোহিঙ্গা বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত জাতিসঙ্ঘের ড. ইউনূসের ৬ মামলা বাতিলের রায় প্রকাশ গাজায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৭১ ফিলিস্তিনি নিহত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৭ কর্মকর্তাকে দুদকের তলব খালেদা জিয়াকে পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র বাহিনী থেকে দূরে রাখা হয়েছিল : ফখরুল নোয়াখালীতে ট্রাকচাপায় এক শিশু নিহত ইউক্রেনে প্রথমবারের মতো আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা রাশিয়ার রংপুরে ৩ দশমিক ১ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন সকলের সামাজিক দায়িত্ব : উপদেষ্টা ৪টি সংস্কার করলেই অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন দিতে পারবে : মোস্তাফিজার রহমান গৌরনদীর সাবেক মেয়রকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

সকল