২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিপ্লব-পরবর্তী কার্যকর পুলিশের জন্য

- প্রতীকী ছবি

পতিত আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে পুলিশি রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলেছিল। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গত ১৫ বছর ধরে তারা তাদের পেটোয়াবাহিনী হিসেবে পুলিশকে তৈরি করেছে। পুলিশের সর্বস্তরে দলীয় নেতাকর্মী আর ক্যাডারদের নিয়োগ দিয়েছে। গত দেড় দশকে লীগ আর পুলিশ সমর্থক হয়ে উঠেছিল। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৯-২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশে মোট ৮৩ হাজার ৭০টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। দেড় দশকে শুধু কনস্টেবল, এসআই ও সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেয়া হয় এক লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জনকে, যা পুলিশ বাহিনীর মোট জনবলের প্রায় অর্ধেক। এই বিশাল জনবলকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ। এতে এক দিকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, অন্য দিকে বিরোধী তথা সাধারণ জনগণকে দমন-পীড়ন করতে এদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকের বিরুদ্ধে জাল সনদ এবং তথ্য প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। প্রতারণা ও অযোগ্যতার কারণে পুলিশের অন্তত ৯০ হাজার সদস্যের নিয়োগ সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে। গত ১৫ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে পুলিশের যে দলীয়করণ হয়েছে, তার প্রতিফলন আমরা দেখেছি জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়। এরা আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য চরম নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতার প্রদর্শন করে আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে, নির্বিচারে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। যার ফলে অভ্যুত্থানের ঠিক পরপরই পুলিশের ওপর জনগণের অনাস্থা আর ঘৃণার প্রকাশ দেখেছি। দেশজুড়ে থানা ও পুলিশের ওপর আক্রমণ হয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যের দুর্নীতি আর অপেশাদার আচরণ জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, হতাশা তৈরি করেছে। অভ্যুত্থান দমন করতে পুরো দেশে হত্যাযজ্ঞ চালানো ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, মামলা হয়েছে। ফলে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য এখন পলাতক। পুলিশে এখন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অন্য দিকে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পালনকারী অনেক পুলিশ কর্মকর্তা নিজেদের পদোন্নতি আর পদায়ন নিয়ে ব্যস্ত। এ কারণেই দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর জনগণের বিশ্বাসের অভাব ও আওয়ামী পুলিশের অসহযোগিতার কারণে দেশে এখন একটি অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পুলিশের একটি অংশ এখনো তাদের দলীয় অনুগত্যের জন্য বর্তমান সরকার আর জনগণের জন্য কাজ করতে অনাগ্রহী। তাই পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন অ্যাকশনে যেতে, কিন্তু বাহিনীর সদস্যরা নির্বিকার।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ২০২১ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। পুলিশের বিরুদ্ধে ঢালাও দুর্নীতি, অপরাধ, আইনের অপব্যবহারের অগণিত অভিযোগ রয়েছে। অথচ প্রায় দুই লাখ ১৩ হাজার সদস্যের পুলিশের এক শতাংশের বিরুদ্ধেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাজধানীতে ৯৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ২৭৮টি মামলা হয়েছে। অভিযুক্ত হয়েছেন কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। আসামিদের মধ্যে তিনজন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক, আটজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, সাতজন উপ-মহাপরিদর্শক, ১২ জন পুলিশ সুপার, ১৪ জন অতিরিক্ত এসপি, ছয়জন সহকারী এসপি, ১২ জন ওসি, আটজন পরিদর্শক, ১০ জন উপপরিদর্শক এবং একজন সহকারী উপপরিদর্শক রয়েছেন। বেশির ভাগ মামলা হত্যা বা বিস্ফোরক পদার্থ এবং অস্ত্র আইনের অধীনে দায়ের করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৯ জন অতিরিক্ত আইজিপি, দুজন (সুপারনিউমারারি) অতিরিক্ত আইজিপি, পাঁচজন ডিআইজি এবং একজন অতিরিক্ত ডিআইজিসহ ১৭ জন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এসব শূন্যতা অবিলম্বে পূরণ করতে হবে।

পুলিশবাহিনীকে দিয়ে দেশের সাধারণ জনগণকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সুরক্ষা ও সেবা দেয়ার বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য টাউন’। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও নিয়মতান্ত্রিক পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজন রয়েছে, যা এখনকার অকার্যকর ও অনৈতিক পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে করা সম্ভব নয়। পুলিশ সংস্কার এখন সময়ের দাবি। তবে এটি সময়সাপেক্ষ। পুলিশকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার সাথে সংস্কারের সম্পর্ক ওতপ্রোত। প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ পেশাদার পুলিশবাহিনী গঠনে সময় প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৯ সদস্যের পুলিশ কমিশন গঠন করেছে, যাদেরকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল, সাব-ইন্সপেক্টর ও অন্যান্য পদে নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটি মনে রাখতে হবে, পুলিশের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণসহ যে পর্যায়গুলো রয়েছে, তা সময়সাপেক্ষ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীতে সৃষ্ট জনবল শূন্যতা দ্রæততম সময়ে পূরণের দাবি রাখে।

সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় যেটি একই সাথে নিশ্চিত করা প্রয়োজন তা হলো, পুলিশ বাহিনীকে কার্যকর করে তোলা, যাতে জনগণকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সুরক্ষা ও সেবা দেয়া যায়। আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগের দলীয়করণ থেকে দেশের গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী ও আনসারও রেহাই পায়নি। গত ১৫ বছরে আনসারে নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ সদস্যই আওয়ামী লীগ বা দলটির অঙ্গসংগঠনের কর্মী, যাদের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ।

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে প্রচলিত ধারায় স্বল্প সময়ে একটি দক্ষ ও কার্যকর পুলিশ বাহিনী গঠন করা দুরূহ। তবে সশস্ত্রবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে অল্প সময়ে পুলিশ বাহিনীকে কার্যকর করা সম্ভব। বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী থেকে অবসর নেয়া একটি বিশাল প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে। তাদের মধ্যে বাছাইকৃত যোগ্য সদস্যদের নিয়োগের মাধ্যমে খুব সহজেই বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর জনবল শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব। দেশের এই দুঃসময়ে সশস্ত্রবাহিনী থেকে অবসর নেয়া বিশাল প্রশিক্ষিত জনবলের সঠিক ব্যবহার করা প্রয়োজন। সশস্ত্রবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং প্রশিক্ষণ (অস্ত্র ও শৃঙ্খলাবিষয়ক) অত্যন্ত উঁচু মানের। সশস্ত্রবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী একজন সৈনিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম এসএসসি/এইচএসসি। মাত্র ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সে চাকরিতে যোগ দেয়ার পর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর ল্যান্স করপোরাল, করপোরাল, সার্জেন্ট, ওয়ারেন্ট অফিসার, সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার পদে সৈনিকরা পদোন্নতি পান। সশস্ত্রবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী সর্বোচ্চ ২২ থেকে ২৬ বছর সক্রিয় চাকরির পর মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সে শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ যোগ্য থাকা অবস্থায় অবসর গ্রহণ করতে হয়। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা সশস্ত্রবাহিনীর রিজার্ভিস্ট তালিকায় থাকেন। এসব সদস্য ও কর্মকর্তাদের দেশের জরুরি প্রয়োজনে সশস্ত্রবাহিনীতে আবারো নিয়োগ দেয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আবারো নিয়োগের প্রচলন রয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশের পুনর্গঠন, জনবল সঙ্কট দূর করা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অবিলম্বে নিচের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে :

১. সশস্ত্রবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের পুলিশ বাহিনীর শূন্য পদে যোগ্যতা অনুযায়ী পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে খুব কম সময়ে ২০ থেকে ৩০ হাজার পুলিশ সদস্যের শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব হবে।

২. পুলিশ বাহিনীর অফিসার পদের শূন্যতা পূরণের ক্ষেত্রে সশস্ত্রবাহিনীর আগ্রহী অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের তাদের যথাযথ পদ অনুযায়ী পুলিশ, বিজিবি বা আনসার বাহিনীতে চুক্তিভিত্তিতে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।

৩. পুলিশে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এই বিপুল সংখ্যক প্রশিক্ষিত অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের তিন সপ্তাহের কনভার্সন বা রূপান্তর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশ আইনে প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

৪. নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে আনসারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের প্রাধিকার দেয়া যেতে পারে এবং তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের সময়সীমা দুই মাসে সীমিত করা যেতে পারে।

৫. অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আগে নিশ্চিত করতে হবে যে, চাকরিকালীন বা অন্য সময়ে কোনো শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা দুর্নীতি অথবা অন্য কোনো অভিযোগে কেউ শাস্তিপ্রাপ্ত কি না।

এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমানে পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে যে শূন্যতা বিরাজ করছে তা অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হবে। এটি দেশে বর্তমানে জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, তা পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।


আরো সংবাদ



premium cement