দুর্নীতি দমনে তিনটি পদক্ষেপ
- জাফর আহমাদ
- ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০:০৪
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন। কিন্তু স্থায়ীভাবে দুর্নীতি দমনের কার্যকর কোনো আলোচনা, পরামর্শ বা পদক্ষেপের কথা কেউ বলেন না। ক্ষমতার পালাবদলে সবার মতামত হলো, ‘দুর্নীতিবাজকে ধরো, মারো ও জেলে পুরো’। আমরা স্বাধীনতার অর্ধশত বছর ধরে দুর্নীতির কারণে ক্ষত-বিক্ষত। এ পর্যন্ত যতবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে প্রত্যেকে পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতিবাজকে শুধু দমন করে এসেছেন। কিন্তু দুর্নীতি দমনে কিছু করেননি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে দুর্নীতিতে আক্রান্ত না হয় সে জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
দুর্নীতির উৎসমূলে সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে প্রথমত শিক্ষার সাহায্য নিতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মনে অপরাধের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। তিনটি অঙ্গন থেকে ব্যক্তিকে দুর্নীতি বা অপরাধের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যথা- পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রচারমাধ্যম। দুর্নীতিকে ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছ থেকে দূরে রাখতে এই তিন পন্থা অবলম্বন করা একান্ত জরুরি।
১. পরিবার : মানবশিশু জন্মগ্রহণ করার পর যাদের পরিবেষ্টনে আবদ্ধ থাকে তাকে মানবশিশুর পরিবেশ বলা হয়। ছোট্ট এই গণ্ডি বা বেষ্টনীর প্রধান দু’জন সদস্য বাবা ও মা, যাকে আমরা পরিবার বলে থাকি। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শিশুর পরিবেশের সম্প্রসারণ ঘটে। পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা ব্যাপক গবেষণা ও আলোচনা করে বলেছেন, পরিবেশ মানবশিশুর বিভিন্নমুখী আচরণ, ব্যবহার ও দোষ-গুণের ওপর কার্যকর প্রভাব বিস্তার করে।
পরিবার হলো একটি শিশুর জীবন গড়ার প্রাথমিক পাঠশালা। এ জন্য পরিবারের শক্তিশালী দু’জন সদস্য বাবা ও মায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বাবা-মা যে ধরনের আচরণ, কথাবার্তা ও কাজকর্ম করেন, ছেলেমেয়ে সেসব অনুসরণ করতে শেখে। ছেলেমেয়েরা তাদের জীবনের মডেল হিসেবে মা-বাবাকে গ্রহণ করে থাকে। তাই অনুকরণ প্রিয় শিশুর মা-বাবা যদি ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও পারিবারিক পর্যায়ে নৈতিকতার পরিচর্চা করেন, তাহলে তাদের সন্তানরা সেভাবে গড়ে উঠবে। ছেলেমেয়েদের নৈতিক চরিত্র গঠন করা মা-বাবার প্রতি সন্তানের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা সুস্পষ্ট জুলুম হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা নিজেরা ও পরিবার পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো।’ (আল-কুরআন)
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : পরিবারের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো একটি শিশুর জীবন গড়ার পরবর্তী পাঠশালা। এই পাঠশালার পাঠ্যতালিকাও একটি শিশুর জীবনের ভিত রচনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে জাতিসত্তা ও সভ্যতার অবকাঠামো। জাতীয় চরিত্র গঠন এবং জীবনের সব ক্ষেত্রে ও বিভাগে নেতৃত্বদানের উপযোগী সৎ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে শিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক ও ভোগবাদী পৃথিবীর মনোভাবাপন্ন পাঠ্যসূচি চালু আছে। যা আলোকিত লোক তৈরির অনুপযোগী। যার বাস্তব ফল আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বর্তমানে গ্রেফতারকৃত দুর্নীতিবাজদের একটি বিরাট অংশ উচ্চশিক্ষিত। অথচ বলা হয়- শিক্ষাই আলো। আমাদের প্রশ্ন, এসব উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি কেন অন্ধকার জগতের বাসিন্দা?
প্রকৃতপক্ষে উচ্চশিক্ষিত হওয়া আর সৎ হওয়া এক কথা নয়। সৎ ও আধুনিক যোগ্যতাসম্পন্ন লোক গঠনে অবশ্যই আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি সমান্তরালভাবে নৈতিক শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। কর্মমুখী আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি অবশ্যই নৈতিক শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হবে। কোনো বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি অপরাধের প্রতি ঘৃণা এবং অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার মনোভাব সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে।
নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তৈরি করা হলে তারা দুর্নীতি তো দূরের কথা কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে, বিবেকের কশাঘাতে টিকতে না পেরে নিজের অপরাধের বিচার নিজেই প্রার্থনা করে। আগাছা রোপণ করে কেউ যদি আম-কাঁঠালের আশা করেন এটি বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। দুর্নীতির সদর দরজা খোলা রেখে দুর্নীতি দমন হবে না। এ জন্য ধর্মীয় বিশেষ করে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিপালনের কোনো বিকল্প আছে বলে আমরা মনে করি না।
৩. প্রচারমাধ্যম : দেশের প্রচারমাধ্যমগুলো দুর্নীতি উচ্ছেদে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। এ জন্য মিডিয়ায় নৈতিকতাসম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রচার বাড়াতে হবে। দুঃখের বিষয় হলো আমাদের দেশে বেশির ভাগ মিডিয়া এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দখলে যারা নীতিনৈতিকতার ধার ধারেন না। আমাদের অধিকাংশ মিডিয়া নাগরিকদের চরিত্র হননের সাথে সাথে সমাজে ভাঙন ও জাতিসত্তা বিনষ্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
এমন সব জিনিস প্রচার করা হয়, যা বোমার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর। বোমা একটি নির্দিষ্ট আওতায় কিছু লোকের জান-মালের ক্ষতি করে। কিন্তু একটি খারাপ কথা সমাজ ভাঙনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে থাকে। ইথারে ভেসে ভেসে তার ধ্বংসের আওতার বিস্তৃতি ঘটায়। সমাজকে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সম্মুখে এনে দাঁড় করায়। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধের স্থান দখল করে নেয় হিংসা-হানাহানি, বিদ্বেষ আর অহংবোধ। ফলে মানুষ চরম দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হয়। সুতরাং মিডিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণে প্রচারমাধ্যমকে নৈতিকতার বিকাশে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরেকটি বিষয়- বাংলাদেশের এমন কোনো মহল্লা পাওয়া যাবে না যেখানে মসজিদ নেই। এলাকার বাসিন্দারা মসজিদের ইমামকে সম্মানের চোখে দেখে থাকেন। সুতরাং প্রচারমাধ্যম হিসেবে এবং সুস্থ সমাজগঠনে মসজিদের ইমামরা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় সমাজের মর্জির ওপর তাদের চলতে হয়। তাদের অনেকে সত্য কথা বলতে পারেন না।
অবহেলিত ইমামসমাজকে কাজে লাগাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ওলামা ও ইসলামী স্কলারদের নিয়ে একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তারা ইমামদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করবেন। গতানুগতিক খুতবার স্থলে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশমূলক অভিন্ন খুতবা তৈরি করবেন। যদি তাদের সরকারিভাবে এ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয় তবে দুদক ও অন্যান্য সংস্থা থেকে তারা সমাজকে আরো অধিক কিছু দিতে পারবেন। উপরোল্লিখিত তিনটি বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দুর্নীতি দমন করা সহজ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। অন্যথায় দুর্নীতি নতুন নতুন কৌশল ও রূপ ধারণ করে আরো প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গ্রাস করবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা