সরকারি প্রকল্প অর্থায়নে সুকুকের সম্ভাবনা
- মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ
- ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:৫৬
সুকুক এক ধরনের বিনিয়োগপত্র যার গঠন ও বাস্তবায়নে শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিত করা হয়। বর্তমান বিশ্বের আর্থিক জগতে সুকুক সুপরিচিত। তবে কোনো বিনিয়োগপত্রের শরিয়াহসম্মত হতে এর নামকরণ সুকুক হওয়ার প্রয়োজন নেই। শরিয়াহসম্মত হতে নামকরণের পরিবর্তে এর গঠন ও বাস্তবায়নের বিষয়গুলো বরং প্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ সুকুক একদিকে যেমন একটি বিশেষ্য, অন্য দিকে এটি একটি বিশেষণ। ২০০১ থেকে এখন পর্যন্ত আনুমানিক ৪০টি দেশ থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সুকুক ইস্যু করা হয়েছে। এর প্রায় অর্ধেক সার্বভৌম/সরকারি সুকুক, যার মধ্যে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো ছাড়াও অন্যান্য দেশ রয়েছে।
বর্তমানে সুকুকের প্রচলন শুরু হয়েছে প্রচলিত বন্ডের শরিয়াহসম্মত একটি বিকল্প হিসেবে। প্রচলিত বন্ডগুলো সুদভিত্তিক হওয়ায় ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন, ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী বীমা/তাকাফুল ও শরিয়াহ ফান্ড) ও শরিয়াহ পরিপালনে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিরা এতে বিনিয়োগ করতে পারে না। অন্য দিকে সুকুকে ইসলামিক বিনিয়োগকারীরা ছাড়াও প্রচলিত সব ধরনের বিনিয়োগকারী ও যেকোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যক্তি বিনিয়োগ করতে পারেন। অর্থাৎ প্রচলিত বন্ডগুলো যেখানে এক শ্রেণীর বিনিয়োগকারীর জন্য বিনিয়োগযোগ্য নয়, সুকুক সেখানে সবার জন্য বিনিয়োগযোগ্য। ফলে সুকুক ইস্যু করার মাধ্যমে ইস্যুকারী অধিকসংখ্যক বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রথম দু’টি সুকুকে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল। পরবর্তী সুকুকগুলোতে ইসলামিক ব্যাংকিংকে অগ্রাধিকার দেয়ার লক্ষ্যে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে শর্তসাপেক্ষে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ইস্যুকৃত সরকারি সুকুকগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এ ধরনের সুকুকের ব্যাপক চাহিদা বিদ্যমান। সুকুকগুলোর প্রতিটির রেট অফ রিটার্ন প্রচলিত ট্রেজারি বিল/বন্ড থেকে অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি কয়েক গুণ বেশি সাবস্ক্রাইব হয়েছে। ব্যাংকব্যবস্থার বাইরে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধকরণে কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নেয়া সত্ত্বেও এমন অসাধারণ সাড়া পাওয়া গেছে। এ থেকে সহজে অনুমেয়, সুকুকে বিনিয়োগ উদ্বুদ্ধকরণে পদক্ষেপ নিলে সাড়া আরো বেশি হতো।
আমাদের দেশে চারটি সুকুকের মাধ্যমে সরকার মোট ১৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে, যা জুন ২০২৪-এ অভ্যন্তরীণ সরকারি দায়ের স্থিতির মাত্র ২.১১ শতাংশ। অথচ, সুনির্দিষ্টভাবে সুকুকে বিনিয়োগ চাহিদা আছে প্রতিটি ইসলামী আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ও বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে। বাংলাদেশে বিদ্যমান ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক, ৩০টি প্রচলিত ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ও উইন্ডোভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং, ৩৪টি ইসলামী বীমা বা তাকাফুল সেবাপ্রতিষ্ঠান ও ১৮টি শরিয়াহ ফান্ডের সরকারি বিনিয়োগপত্রে বিনিয়োগ করতে হলে সুকুকের বিকল্প নেই। এ ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ে বেশির ভাগ মুসলিম শরিয়াহসম্মত সঞ্চয় ও বিনিয়োগে আগ্রহী। অনেকে তাদের প্রভিডেন্ট/ পেনশন/ গ্র্যাচুইটি ফান্ড শরিয়াহ সম্মতভাবে পরিচালিত হতে দেখতে আগ্রহী। এ বিশাল চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত ইসলামী বিনিয়োগপত্র বাজারে নেই। চাহিদার তুলনায় বাংলাদেশে সরকারি সুকুকের সরবরাহ যে একেবারে অপ্রতুল তা বোঝা যায় প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংকের সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে; যেটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী হওয়ার অনুমোদন পাওয়ার পরেও অগ্রসর হতে পারেনি আকর্ষণীয় হার প্রদান করে এমন পর্যাপ্ত সরকারি সুকুক না থাকায়।
বহুবিধ চাহিদা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুকুক ইস্যু করা সম্ভব। যেমনÑ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। একটি নির্দিষ্ট সময় পর ইস্যুকারীর পক্ষে পুনঃক্রয়ের সুযোগ (কল অপশন) রেখে বা বিনিয়োগকারীর পক্ষে ইস্যুকারীর কাছে বিক্রয়ের সুযোগ (পুট অপশন) রেখে মেয়াদবিহীন বা পার্পেচুয়াল সুকুকও ইস্যু করা যেতে পারে। সুকুকের রেট অফ রিটার্ন স্থির, পরিবর্তনশীল বা কোনো একটি বেঞ্চমার্কের ভিত্তিতে হতে পারে। সুকুক আয়ভিত্তিক ও আয়বিহীন প্রকল্পের জন্যও হতে পারে। অর্থাৎ সুকুক গঠনের সম্ভাবনা বিস্তৃত ও সরকারের বিভিন্ন অর্থায়ন প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। ফলে বিদ্যমান সব ধরনের সরকারি বিনিয়োগ ও সঞ্চয়পত্রের বিকল্প হিসেবে সুকুক ইস্যু করা যেতে পারে।
এর মাধ্যমে এক দিকে যেমন সরকারের অর্থের চাহিদা মেটানো সম্ভব, অন্য দিকে সরকারি বিনিয়োগ বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী সবার চাহিদা মেটানো সম্ভব। যাদের এই ধরনের বিনিয়োগপত্রের চাহিদা নেই, সমবিনিয়োগ সুযোগ থাকার ফলে তাদের অন্তত কোনো ক্ষতি নেই। বরং সরকারি প্রকল্পের অর্থায়নে ঋণ বা দায়ভিত্তিক চুক্তির পরিবর্তে অংশগ্রহণমূলক চুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের জিডিপির তুলনায় দায়ের অনুপাতেও উন্নতি করা সম্ভব। ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থার মুদারাবাহ ও মুশারাকাহ চুক্তিগুলো ব্যবহার করে এটি অর্জন সম্ভব।
সুকুকের মাধ্যমে সরকারি ব্যয়ে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব । সুকুক ইস্যু থেকে প্রাপ্ত অর্থ যদি কোনো কিছু ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যবহার করা হয়, তাহলে প্রকাশ করতে হয় যে কী ধরনের সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় করা হবে। অর্থ যদি সম্পদ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়, তাহলে প্রকাশ করতে হয় যে কী ধরনের সম্পদ নির্মাণ করা হবে ও নির্মাণকাজ শেষ করতে কত সময় লাগবে। যদি সম্পদ ক্রয় করে ভাড়া দেয়ার কাজে অর্থ ব্যবহার করা হয় তাহলে প্রকাশ করতে হয় কী ধরনের সম্পদ ক্রয় করা হবে ও ভাড়ার পরিমাণ কত হবে। সুকুক ইস্যু করার আগে যেমন কিছু তথ্য প্রকাশ করতে হয়, ইস্যু করার পরেও সুকুকের ধরণভেদে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করতে হয়। প্রচলিত বন্ডের ক্ষেত্রে তথ্য প্রকাশের এমন বাধ্যবাধকতা থাকে না।
এখন পর্যন্ত ইস্যুকৃত প্রতিটি সরকারি সুকুকের বিপরীতে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন- প্রথমটি ইস্যু করা হয় সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের অর্থায়নে। দ্বিতীয়টি ইস্যু করা হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োাজনভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে। তৃতীয়টি ইস্যু করা হয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে। চতুর্থটি ইস্যু করা হয় চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে রাস্তা প্রশস্তকরণ এবং শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের অর্থায়নে।
প্রতিটি সুকুকের প্রকল্প বাছাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেবট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে একটি ভূমিকা রেখেছে। তারা অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও সুকুক ইস্যুর আগে প্রকল্পগুলোর উপযুক্ততা যাচাই করেছে ও প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলেছে। সুকুক ইস্যু করার পরে প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে ও ক্ষেত্র বিশেষে সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। এ ছাড়া তারা সুকুকের জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি ও একটি শরিয়াহ কমিটি গঠন করেছে যেখানে সুকুকের কাঠামো ও শরিয়াহ বিষয়গুলোর পাশাপাশি প্রকল্পের বিভিন্ন দিকও আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিটি সুকুকের জন্য প্রসপেক্টাস প্রস্তুত করা হয়েছে যেখানে প্রকল্প ও সুকুক অর্থের ব্যবহার বিষয়ক একটি ধারণা দেয়া হয়েছে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত। এসব পদক্ষেপ প্রচলিত বন্ডের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ দ্বারা বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায় থাকে না।
পদক্ষেপগুলোকে আরো শক্তিশালী করার মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পের মূল্যায়ন, বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বড় ধরনের উন্নতি করা সম্ভব। পর্যাপ্ত তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব। সংশ্লিষ্টদের এখন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান সরকার যেহেতু সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং একই ধরনের প্রতিশ্রুতি পরবর্তী সরকারগুলো থেকেও যেহেতু আমরা প্রত্যাশা করি, এটি অর্জনের একটি পদক্ষেপ হিসেবে প্রচলিত বন্ড বা অন্যান্য ঋণভিত্তিক মাধ্যমের পরিবর্তে সুকুক ইস্যু করে সরকারি প্রকল্পে অর্থায়ন করার একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসাটা সময়োপযোগী হবে।
এ ছাড়া সুকুকের মাধ্যমে সরকারি সম্পদের সাথে সরাসরি জনসম্পৃক্ততা সৃষ্টি করা সম্ভব। সুকুকের অর্থায়নে সৃষ্ট সম্পদ যেহেতু সুনির্দিষ্ট থাকে, সম্পদগুলোকে (যেমন, রাস্তা, বিদ্যালয়, নলকূপ ইত্যাদি) সুকুক অর্থায়নে সৃষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা থাকতে পারে। এর মাধ্যমে জনগণ অবহিত হবে তাদের অর্থ কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে, যা সরকারি সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন নেয়ার একটি মানসিকতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে কিছু জনপ্রতিনিধির নিজের টাকাতে কাজগুলো হচ্ছে বলে যে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা বিদ্যমান তা কিছুটা হলেও হয়তো নিয়ন্ত্রিত হবে। নতুন বাংলাদেশে আমরা সচেতন জনগোষ্ঠী প্রত্যাশা করি। কিন্তু সচেতন হওয়ার সুযোগটা তাদের দিতে হবে।
লেখক : ইসলামী অর্থব্যবস্থা বিষয়ক পরামর্শক
mezbah.u.ahmed@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা