২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১, ২০ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

মাঠপ্রশাসন সংস্কার প্রস্তাব

-

বর্তমান সংবিধানের চতুর্থ ভাগের প্রথম অনুচ্ছেদের বিষয় রাষ্ট্রপতি, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের বিষয় প্রধানমন্ত্রী, বিলুপ্ত ২(ক) অনুচ্ছেদের বিষয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তৃতীয় অনুচ্ছেদের বিষয় স্থানীয় শাসন। স্থানীয় সরকার বা মাঠপ্রশাসন নির্বাহী বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মাঠপ্রশাসন দলীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকলে দলীয়করণ রোধ করা অসম্ভব। একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্র নির্মাণে আমাদের অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে যে, আমরা আমাদের রাষ্ট্রের কতটুকু অংশ দলীয় এবং কতটুকু অংশ নির্দলীয় রাখব। এ ক্ষেত্রে সমীচীন হয় রাষ্ট্রের মূল অংশে থাকবে দলীয় প্রধানমন্ত্রী, দলীয় মন্ত্রিসভা এবং দলীয় সংসদ। অন্য অংশে থাকবে নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি, নির্দলীয় সাংবিধানিক সংস্থাগুলো এবং নির্দলীয় মাঠপ্রশাসন। সংবিধানের তিনটি অনুচ্ছেদে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের কথা বলা হয়েছে। মাঠপ্রশাসন সংস্কারে সংবিধান সংস্কার করার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু প্রয়োজন নির্দলীয় স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ। দলীয় মনোনয়ন না থাকলে নির্বাচন এমনিতেই সুষ্ঠু হবে। বাংলাদেশে দলীয় এবং নির্দলীয় দুই প্রকার রাজনীতিই পাশাপাশি বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ছাত্র এবং পেশাজীবীদের রাজনীতিও আইন করে নির্দলীয় করতে হবে। সাংবিধানিক সংস্থাগুলোও নির্দলীয় হবে। তাহলে দলীয় রাজনীতির সর্বগ্রাসী আগ্রাসন এবং লুটপাট থেকে জাতি মুক্ত হবে বলে আশা করা যায়।

সংবিধানে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হলেও স্থানীয় সরকারগুলোকে স্বশাসিত প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে কাজ করতে দেয়া হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত করা হয়নি। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। বিভাগীয় পরিষদ আইন প্রণয়ন করা হয়নি। জেলা ও উপজেলায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে সমন্বিত এবং এককেন্দ্রিক কোনো প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। তহবিল গঠনের জন্য আইন করে স্থানীয় সরকারগুলোকে করারোপ করার কোনো ক্ষমতা অর্পণ করা হয়নি। স্থানীয় সরকারগুলোকে পরিকল্পনা কমিশনের কাজের সাথে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা হয়নি। কোথাও কোনো জায়গায় কোনো জনপ্রিয় নাগরিককে দলের বাইরের কোনো অবস্থান থেকে নির্দলীয় রাজনীতি করার কোনো স্পেস সৃষ্টি করা হয়নি।

স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন সম্পর্কে সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের বর্ণনা নিম্নরূপ :
প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। অনুচ্ছেদ ৫৯(১) আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার অর্পণ করা হবে।
(২) এই সংবিধান ও অন্য কোনো আইন সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করবে, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লিখিত প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেইরূপ দায়িত্ব পালন করবে এবং অনুরূপ আইনে নিম্নলিখিত বিষয়সংক্রান্ত দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে;
(ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কাজ।
(খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা।
(গ) জনসাধারণের কাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

অনুচ্ছেদ ৬০। এই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের বিধানাবলিকে পূর্ণ কার্যকরতা দানের উদ্দেশ্যে সংসদ আইনের দ্বারা ওই অনুচ্ছেদে উল্লিখিত স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা প্রদান করবে।

অথচ আজ অবধি কোনো দলীয় সরকার বিগত ৫৩ বছরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে স্থানীয় প্রশাসনকে ন্যস্ত করেনি। তারা ঔপনিবেশিক প্রশাসনকে নিজেদের হীনস্বার্থে অর্থাৎ ভোট কারচুপি, গায়েবি মামলা মোকদ্দমা করে বিরোধী দল দমন, দলীয় সন্ত্রাস এবং দলীয় দুর্নীতির স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে। রাজনীতি এবং নির্বাচন তাদের কাছে একটি ব্যয়বহুল জুয়াখেলা মাত্র। নির্বাচনে অহেতুক কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভোটকে টাকার খেলা এবং তামাশা বানিয়ে ফেলেছে। জনগণ তাদের কাছে বলির পাঁঠামাত্র। বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতি সংস্কারবিমুখ এবং স্বার্থান্বেষী মহলবান্ধব। যারা দলীয় সরকারের কাছে রাষ্ট্রসংস্কারের কথা ভাবেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বাংলাদেশে সত্যিকার গণতান্ত্রিক দলগুলো নিয়ে ব্যাপক সামাজিক গবেষণার প্রয়োজন আছে। দলীয় সরকারগুলো দল নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা করতে দেবে না।

কোনো দলের ভিতরে গণতন্ত্র না থাকলে তার কাছ থেকে বাইরে গণতন্ত্র প্রত্যাশা করা বাতুলতামাত্র। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নাম বাংলাদেশ নির্বাচন ও রাজনীতি কমিশন রাখা উচিত। বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচন এবং অনির্বাচনের প্যারাডক্স না বুঝলে নোংরা রাজনীতির শুভঙ্করের ফাঁকিটা সহজ সরল বাঙালির মাথায় ঢুকবে কিভাবে? দলীয় রাজনীতির নামে নির্বাচিত দলীয় নেতারা যাতে অনির্বাচিত জনগণকে নানান অপকৌশলের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য ক্রীতদাস বানিয়ে না রাখে সেটাও সৎ বুদ্ধিজীবীদের ভেবে দেখতে হবে। এ দেশের জ্ঞানের বাজারে বিবেকহীন ও জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবীদের প্রচুর আনাগোনা। এতে দুই সচিবের নেতৃত্বে নির্বাচন বিভাগ ও রাজনীতি বিভাগ নামে দুটি বিভাগ কাজ করবে। সারা দেশে যত প্রকার নির্বাচন আছে তার সবগুলোর পরিচালনার দায়িত্বভার থাকবে নির্বাচন বিভাগের ওপর। অর্থাৎ মসজিদ কমিটি থেকে দলের কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত সব নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবে নির্বাচন বিভাগ। কোথাও কেউ ভোট দিতে না পারলে নির্বাচন বিভাগের একটি হটলাইন নাম্বারে ফোন করে জানাবে এবং থানায় একটি জিডি করবে। থানাকেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দলীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সাংবিধানিক অপরাধ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের নির্দলীয় নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করতে হবে। রাজনীতি বিভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতর রাজনীতি আইন ও গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে কি না তা দেখভাল করবে।

ইচ্ছে করেই দলীয় সরকারগুলো স্থানীয় সরকারগুলোকে দুর্বল করে রেখেছে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে দলীয় সরকারগুলো কোনো সময় আন্তরিক ছিল না। দলীয় সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরাও এ ক্ষেত্রে সরকারকে নিরুৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশে প্রধান প্রধান দলগুলো মূলত এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক এবং অন্য দলগুলো কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক। দলীয় নীতিনির্ধারণে দলীয় কর্মীদের অংশগ্রহণ খুব সীমিত। তাদের রাস্তায় শোডাউনের কাজে ব্যবহার করা হয়। শহীদ বানিয়ে ফায়দা লোটার জন্য তাদের তৈরি করা হয়। তাদের নেতাদের অন্ধভক্ত হিসেবে তৈরি করা হয়। তাদের কখনো বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বা উজ্জীবিত করা হয় না। দেশ ও সমাজ নিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে ভাবতে দেয়া হয় না। রাষ্ট্র সংস্কারকে গণসম্পৃক্ত, জনপ্রিয় এবং জনবান্ধব করতে হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সবার আগে মাঠপ্রশাসন সংস্কারে হাত দিতে হবে। মাঠপর্যায়ে সিভিল সমাজকে শক্তিশালী করার জন্য স্বাধীন ও নির্দলীয় রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। জেলা প্রশাসন হচ্ছে মাঠপ্রশাসনের কেন্দ্র। অবিলম্বে জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদকে একীভূত করে জেলা প্রশাসনের দ্বৈতব্যবস্থাপনা বন্ধ করতে হবে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্দলীয় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতে হবে এবং তার অধীনে বিচার ব্যতীত জেলা প্রশাসনের যাবতীয় কাজ হস্তান্তর করতে হবে। জেলা পরিষদকে আইন করে করারোপ করার ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে। নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধি, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং কৃষক প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করে জেলা পরিষদকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে। দলীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে নির্দলীয় নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য স্থানীয় সরকারগুলোকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সাংবিধানিক স্থানীয় সরকার কমিশনে ন্যস্ত করতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব
mukulhakim85@gm


আরো সংবাদ



premium cement
বাগেরহাটে জেলা প্রসাশক ও সিভিল সার্জনকে ৪৮ ঘণ্টার ভেতর প্রত্যাহারের দাবি সড়ক যানজটমুক্ত করতে ৬ নির্দেশনা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের লাগাম টানতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে : রিজওয়ানা হাসান গাজার স্কুলে ইসরাইলি বোমা হামলায় ১৭ ফিলিস্তিনি নিহত জাতীয়তাবাদী নামে কোনো সংগঠন করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে: রিজভী এলএনজি ও সার আমদানির অনুমোদন ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ২৭ অক্টোবর চা বোর্ডে নতুন চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল সরওয়ার হোসেন ‘ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই, যুবসমাজকে সচেতন থাকতে হবে’ মহাদেবপুরে শিয়ালের কামড়ে ৩ নারীসহ ৫ জন আহত এ বছর সরকারি খরচে কাউকে হজে পাঠানো হবে না

সকল