২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

করপোরেট সংস্কৃতি, উদ্যোক্তার মূল্যবোধ

-

ছোট একটা কাপ কেক। তার উপর একটা ছোট মোমবাতি। কেক কাটছেন ভারতীয় টাটা সাম্রাজ্যের অধিপতি রতন টাটা। পাশে তার অসমবয়সী বন্ধু শান্তনু নাইডু। বিশ্বখ্যাত শিল্পপতি রতন টাটার ৮৪তম জন্মদিন পালনের ক্ষণটি ছিল এমন সাদামাটা। বড় কোনো হলরুম নয়, হাজার হাজার মানুষ নয়, আলোর ঝলকানি নয়, এমনকি কোনো কেক ছাড়াই জন্মদিন পালিত হয় বিপুল ধনরাশির অধিকারী এই সাদাসিধে মানুষটির। সদ্য প্রয়াত রতন টাটার সাধারণ জীবনযাপনের নানা ঘটনা নিয়ে মুখর নেটিজেনরা। তার জন্মদিন পালনের এই সাধারণ ভিডিওটি নিয়ে নেটিজেনদের মন্তব্যগুলো সাধারণত্ব যে কত অসাধারণ তারই প্রমাণ দিচ্ছে। বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে সাধারণ জীবনযাপনের এক দৃষ্টান্ত তৈরি করে গিয়েছেন তিনি।

ভারতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়া প্রতিষ্ঠান টাটা গ্রুপের প্রয়াণে তার ব্যবসায়িক অবদান নিয়ে যতখানি আলোচনা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে রতন টাটার জীবনাচরণ, সাধারণত্ব, বিনয়ী সংস্কৃতি, মূল্যবোধের চর্চা নিয়ে। কেবল ভারত নয় সারা পৃথিবীর করপোরেট জগতের নেতৃত্বের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন রতন টাটা।

একজন উদ্যোক্তা বা শিল্পপতি কেবল নিজের ব্যবসার জন্য নয় বরং একটি দেশের জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। সারা পৃথিবীতেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তাদের জীবনাচরণ কর্মীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। আগামীর করপোরেট নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার পথে বর্তমান নেতৃত্বের ভাবনা, কাজের ধরন, মূল্যবোধ, জীবনাচরণ বড় ভূমিকা রেখে চলে।

বাংলাদেশের করপোরেট জগৎ বিশ্ব করপোরেট জগতের তুলনায় নবীনতম। ৯০ দশকের শেষ দিক থেকে এদেশের করপোরেট জগতের বিস্তার জোরালো হতে থাকে। বর্তমান সময়ে এসে করপোরেট জগতের শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে দেশের অর্থনীতিতে এবং সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে।

তবে বাংলাদেশের আর সব খাতের মত করপোরেট খাতের নানা অনিময় সংবাদপত্র এবং সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। একেকজন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নামে নিজের বিপুল প্রতিপত্তি নির্মাণে ছিলেন সর্বাধিক মনোযোগী। যেখানে দেশের ক্ষতি, জনগণের ক্ষতি, এমন কি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের কথাও ভাবনায় না রেখে ক্ষমতার অপব্যবহারে সম্পদ আহরণের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার উদাহরণ তৈরি হয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অগণিত সম্পদের মালিক হতে বা বিলাসী জীবনযাপনের জন্য অনৈতিক পন্থার আশ্রয় নিয়েছে অনেক উদ্যোক্তা। প্রকাশ্যে এসব অনৈতিক চর্চার পরও সমাজের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। মূল্যবোধ, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি অন্যায়ের চর্চা করেও তারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়নি।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে তরুণরা। যে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ক্ষেত্র হবে অনুকরণীয়, অনুসরণীয়, পরিশীলিত, বৈষম্যহীন। সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন খাতে জমতে থাকা নানা অনিয়ম, ক্লেদ, অপচর্চা থেকে সংস্কার এর মাধ্যমে সেই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নকে সফল করার আকাা সবার মধ্যেই অনুরণিত। করপোরেট জগৎও এর বাইরে নয়।

ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মে ধুঁকছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। গুটিকয়েক মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা, নিজস্ব সম্পদ আহরণের অসীম আকাঙ্ক্ষা, বিলাসী জীবনপ্রীতিতে দেশের এই দুর্দশা। সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, পরিশীলিত জীবনাচরণের দৈন্যতায় এই লাগামহীন দুর্নীতির মূলে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংকিং খাতে যে লাগামহীন লুটপাট চলেছে সেখানে আইন প্রয়োগের ঘাটতি যেমন আছে তেমন উদ্যোক্তাদের নৈতিকতার ঘাটতিও আছে।

একজন অসৎ মানুষের গড়া প্রতিষ্ঠানে, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, পরিশীলিত জীবনাচরণের চর্চার অভাব থাকবেই আর সেই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ পাওয়া অসম্ভব প্রায়।

দেশের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে, পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে তবে সবচেয়ে জরুরি মানুষের মূল্যবোধের সংস্কার। সামাজিকভাবে সততার চর্চাকারীর গ্রহণযোগ্যতা বা সম্মান দেয়ার পাশাপাশি অনৈতিকতা চর্চাকারীকে প্রশ্নের সম্মুখীন করাটাও জরুরি। অসৎ উপায়ে সম্পদ অর্জন করা, অনৈতিকতার চর্চাকারীদের সামাজিক মর্যাদা দেয়া বন্ধ হওয়াও জরুরি।

একটা জন্মদিন পালনের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম আর একটা জন্মদিন পালনের গল্প দিয়ে শেষ করি।
কাপ-কেকে ছোট্ট মোমবাতি জ্বালিয়ে জন্মদিন পালনের ভিডিওটি দেখার সময় বছর খানিক আগে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের এমডির জন্মদিন পালনের একটা ছবির কথা মনে পড়ল। ওই প্রতিষ্ঠানের এমডির জন্মদিন পালনে হাজির তার পুরো অফিস। এ যেন ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য এক মহা গুরুত্বপূর্ণ উদযাপন। বিশাল টেবিলের ওপর অসংখ্য ছোট বড় অসংখ্য দামি কেক এর ছড়াছড়ি। সেই কেকগুলোর একটির ওপর আবার লেখা ‘ক্যাচ মি ইফ ই ক্যান’-অর্থাৎ পারলে আমাকে ধরো।

একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যারা কোটি কোটি সাধারণ গ্রাহকের অর্থের প্ল্যাটফর্ম সেইরকম একটি প্রতিষ্ঠানের এমডির অফিসেই এমনতর জন্মদিন উদযাপন এবং কেক এর ওপরের এই বার্তাকে নমুনা হিসেবে নেয়া যায়। এ যেন অনৈতিকতার চর্চার ঢোল বাজানো! ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের জন্য কী উদাহরণ আসলে তৈরি হয়! তাদের কাজের ক্ষেত্রে আসলে কী প্রভাব পড়ে তা সহজেই অনুমেয়। এমনকি অনৈতিকতার চর্চা করা একটি প্রতিষ্ঠানকে চর্চাগুলো করতে বাধা দেয়াও হয়নি। বরং বিভিন্ন সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাবেক সরকারের ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অবৈধ প্রয়োগ করে নানা রকম সুবিধা নিয়েছে তারা। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে নিজের কৃত কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতে পড়লেও ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক এমডির ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কোনো পরিবর্তন নেই। বরং সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে নিজেদের অন্যায়গুলোর পক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টায় তৎপর তিনি।

প্রতিষ্ঠান গড়তে উদ্যোক্তার বহুমুখী পদক্ষেপের প্রত্যেকটি বিষয় যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রধানের জীবনাচরণ, বিনয়, পরিশীলতা, সাধারণত্ব, মূল্যবোধ। ব্যক্তি থেকেই ত্বরান্বিত হয় প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের এবং প্রতিষ্ঠানের সঠিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির চর্চা। রতন টাটার প্রয়াণে তার সাধারণ জীবনাচরণ সেই অমোঘ বার্তাকেই আরো একবার সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেল। দেশের সব খাতের সংস্কারের মত করপোরেট খাতের সংস্কারে মূল্যবোধকে করপোরেট সংস্কৃতির মূলে নিয়ে আসতে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।


আরো সংবাদ



premium cement