২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এই মুহূর্তে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

- প্রতীকী

শেখ হাসিনা নেতৃত্বে সংঘটিত নৃশংস গণহত্যায় শত শত মায়ের বুক খালি হয়েছে, পঙ্গুত্ববরণ ও চোখ হারিয়েছে হাজার হাজার শিশু, শিক্ষার্থী, শ্রমিক, হকারসহ সাধারণ মানুষ। তিনি রেখে গেছেন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র ও ভঙ্গুর অর্থনীতি। তাই এ রাষ্ট্র ও অর্থনীতিকে সংস্কার করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বৈষম্যহীন ও কল্যাণমূলক সমাজ ও অর্থনীতি। নির্মাণ করতে হবে নতুন বাংলাদেশ। নতুন বাংলাদেশে থাকতে পারে নানা মত, নানা দল, আদর্শ কিন্তু দেশ হবে সবার। থাকবে না কোনো বিভক্তি, থাকবে গভীর দেশপ্রেম। আমাদের এই বাংলাদেশকে এর পূর্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমাদের। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা ও খেলাপি ঋণ ক্রমাগত বৃদ্ধি, বেকারত্ব, পোশাক খাতে অস্থিরতা এবং শিল্প কারখানা প্রয়োজনীয় জ্বালানি সঙ্কট এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ঘাটতি।

বিশ্বব্যাংকের এবারের প্রতিবেদনের মূল ফোকাস হলো- ‘সুন্দর আগামীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি’। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, চাকরির মান ও দক্ষতার ঘাটতি। ছাত্রদের নেতৃত্বে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে তার অন্যতম কারণ হলো, চাকরির সুযোগ সীমিত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি। প্রাথমিকভাবে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলেও এর পেছনে গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ ছিল। গত কয়েক দশকে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখানো হলেও তাতে তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেলেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি; যা প্রশ্নবোধক। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হারে। অথচ এ খাতে এ সময়ে কর্মসংস্থান কমেছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ।

অন্য দিক প্রতিটি খাতে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে। আবার কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য লক্ষণীয়। ২০০০ সাল থেকে কৃষি থেকে শিল্প ও সেবা খাতের দিকে কর্মসংস্থানের যে কাঠামোগত পরিবর্তন শুরু হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা ধীর হয়ে গেছে। বাড়তি শ্রম কৃষিতে সংস্থান হচ্ছে। শহরে কর্মসংস্থান কমে গেছে। এ অবস্থায় নতুন ও শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। বিশেষ করে শহর এলাকায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমবাজারে চাহিদা এবং সরবরাহ উভয় পর্যায়েই সমস্যা রয়েছে। ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের আন্দোলন চলাকালে স্বৈরাচারী সরকারের দমন-পীড়নে ও গোলাগুলির কারণে দেশের ক্ষুদ্র-মাঝারি ও বৃহৎশিল্প কারখানাসহ পোশাক খাতে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এতে অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়ে, যার রেশ এখনো অন্তর্বর্তী সরকারকে টানতে হচ্ছে। আর মুদ্রাস্ফীতি তো গত সরকারের আমল থেকেই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরো বেশি, তা ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আবার বন্যায় কৃষি খাতে উৎপাদনে ব্যাঘাত ও সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা সমস্যা, মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া সিন্ডিকেট নিত্যপণ্যের বাজারকে আরো বৃদ্ধি করে। ফলে লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের বাজার। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণীর ভোক্তা অস্বস্তিতে আছেন।

প্রতিদিন কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ ভোক্তা। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ট্রাস্কফোর্স গঠন করেছে ও তদারকি শুরু করেছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, গেল দেড় দশকে রাষ্ট্রের দেশী-বিদেশী ঋণ ছাড়িয়েছে ১৮ লাখ কোটি টাকা। আর ব্যাংক খাতের খেলাপি ছাড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অন্য দিকে গত দুই বছরে মূল্যস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্যও আকাশচুম্বী। আবার এই সময়ে রফতানি আয়ও কমেছে ৬ শতাংশ। নানামুখী চ্যালেঞ্জ অন্তর্বর্তী সরকারের সমানে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানের মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছুতেই পিছপা হওয়া যাবে না। এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের সফল হতেই হবে, এমন মনোভাব মাথায় রাখতে হবে। সম্পদের স্বল্পতা, ঋণের ভার সব কিছু মাথায় রেখেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সাথে অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি মানুষকেও জানাতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অবশ্যই অতীতের চেয়ে ভালো হতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অর্থনীতির দিক পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় অর্থনীতির সুফল পেতে মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানে দ্রুত পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যদি দ্রুত পরিবর্তন আনা যায়, বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পারলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। সেই সাথে ডিজিটাল ইকোনমির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা সম্ভব হলে এটিও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে। স্বৈরাচারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা অল্প কিছু ব্যক্তির হাতে দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে ছিল। দেশের অর্থনীতির বৃহদাংশই তাদের ও তাদের মালিকানাধীন শিল্প গ্রুপগুলোর নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা অনেকেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছেন। কিন্তু তাদের সহযোগীরা মার্কেট এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজার ব্যবস্থাপনা, পোশাক খাতে নানা সমস্যাসহ অর্থনীতিতে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। তাই দুর্বৃত্তায়ন থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে হবে। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়া উচিত। অর্থনীতিতে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রথমে প্রয়োজন সমস্যা চিহ্নিত করা, এ পথে যে প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিছু দিন আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছিলেন- ‘ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে অতিরিক্ত তিন বিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ও জাইকার কাছে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলার দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রিম অর্থ পরিশোধ ও বকেয়া পাওনা নিয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলোচনা চলছে।’ আমি বলব, এসবই ভালো উদ্যোগ তবে এ মুহূর্তে জনগণের ভাষা বুঝতে হবে। তারা চায় নিত্যপণ্যের দাম সাধ্যের মধ্যে আনা, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, ব্যাংক খাতের তারল্যসঙ্কট নিরসন ও পণ্য আমদানি-রফতানিতে স্বাভাবিক গতিসহ বিনিয়োগে গতি ফিরিয়ে আনা। এ মুহূর্তে সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত অর্থনীতি পুরোপুরি সচল করা। বিশেষ করে তৈরী পোশাক ও বস্ত্র খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও কৃষি উৎপাদনে বিশেষ করে শাকসবজিসহ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বিপণনের প্রতি নজর দেয়া। গত কিছু দিন আগে এক আকস্মিক বন্যা কৃষক ও খামারিদের জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। দেড় মাসের মধ্যে ফেনী-কুমিল্লার বন্যা, এরপর কুড়িগ্রামে বন্যা এবং সর্বশেষ দেখা গেল শেরপুর-নেত্রকোনায় বন্যা। এ তিন বন্যায় লাখো কৃষক ও খামারির শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এই ক্ষতি পূরণে দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়া হলে কৃষক ও খামারিরা তো পথে বসবেনই, উৎপাদন কমে গিয়ে বাজারে পণ্যের চাহিদায়ও টান পড়বে। সেই চাপ এসে পড়ে ভোক্তার ঘাড়েও। ফলে বাজার অর্থনীতি ঠিক রাখতে কৃষক ও খামারিদের পাশে দাঁড়াতেই হবে। তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। এতগুলো মানুষ ও তাদের পরিবারের অনিশ্চয়তার বিষয়টি সরকারকেই ভাবতে হবে। এ ছাড়া বাজারে চাল, সবজি, ডিম, মুরগি, মাছের সরবরাহ ঠিক রাখতে হলেও কৃষকও খামারিদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সার ও বীজের সরবরাহ বাড়িয়ে কিংবা প্রণোদনা দিয়ে কৃষক ও খামারিদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তৈরী পোশাকের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে এই খাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে না। অর্থনীতি সচল করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো নিরসনে কাঠামোগত সংস্কারে হাত দিতে হবে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এসব সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সময় পাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ আছে তথাপিও পরবর্তী যে সরকার আসুক অর্থনীতিকে সচল করতে যেমন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দূরীকরণ, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, কর ও শুল্কনীতির সংস্কার ইত্যাদির প্রতি দ্রুত নজর দিতে হবে।

এসব সমস্যার সমাধানে সরকারের উচিত হবে একাধিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা। এসব শুরু করতে দেরি করা যাবে না, সেটিই হলো বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বাণিজ্য ও অন্যান্য সেক্টরে অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ মহলের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। মানুষের মনে ক্রমেই ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সাথে জনগণের আস্থা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। দেশ-বিদেশের চক্রান্তকারীদের এখন একযোগে রুখতে হবে।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেল : main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল