২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১, ২০ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

সাবেক সামরিক অফিসারদের কাজে লাগানো জরুরি

- নয়া দিগন্ত

২০২৪-এর আন্দোলনে নিজ দেশেই নিজেদের মানুষের হাতে সম্ভাবনাময় শিশু, কিশোর, তরুণসহ সাধারণ মানুষকে যেভাবে প্রাণ দিতে হলো তা ইতিহাসে বিরল। হাজারো সম্ভাবনাময় তরুণ আজো অঙ্গহীন হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, দু’ চোখের আলো হারিয়ে তবুও অনেকে স্বপ্ন দেখছে নতুন এক বাংলাদেশের, সাধারণ মানুষ নতুন করে আশা পোষণ করেছে, স্বপ্ন দেখেছে নতুন এক নিপীড়নহীন সুখী, সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের। এভাবেই স্বপ্ন তো যথেষ্ট দেখেছি আমরা তবে কবে আসবে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পালা, জাগার পালা? অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত দেশ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। সচিবালয়ের অভ্যন্তরে আনসার হামলা থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোটরসাইকেল চুরির পরের ধারাবাহিক ঘটনা,পাহাড়ে অস্থিতিশীল অবস্থা, সেই সাথে শিল্প অস্থিরতা, লেফটেন্যান্ট তানজিমের নির্মম হত্যাকাণ্ড, মূল্যস্ফীতি- এগুলো সবই আমাদের সিস্টেমের একটি মারাত্মক অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ করছে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে চারটি তেলবাহী জাহাজ এবং একটি এলএনজিবাহী জাহাজে অগ্নিকাণ্ড কি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা?

আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে একটার পর একটা মিথ্যা ও খারাপ মন্তব্য করেই চলেছে, আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সততার সাথে কূটনৈতিকভাবে কতটুকু জবাব দিতে সক্ষম হয়েছেন? এখন পর্যন্ত আগের মতোই আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের রোগ নির্ণয় ত্রুটিপূর্ণ এবং আমাদের পূর্বাভাস সমানভাবে বিপথগামী। আমরা এখনো কেবল অস্থায়ী সংশোধনের উপর নির্ভর করছি। কোটি কোটি প্রাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব ভরসা করে আমরা যাদের হাতে তুলে দিয়েছি, এখন পর্যন্ত তাদের কার্যক্রমকে কতটা সফল ভাবতে পারছি আমরা? দেশের সার্বিক দিক বিবেচনায় এই মুহূর্তে নিঃসন্দেহে আমরা এক সঙ্কটময় অবস্থায় আছি। এই সঙ্কটময় অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এই মুহূর্তে আমাদের দরকার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতে নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন, প্রকৃত দেশপ্রেমিক, অভিজ্ঞ, দক্ষ, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি যারা প্রতিটি সেক্টরের সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কম বয়সী কর্মদীপ্ত সাবেক সামরিক ব্যক্তিদের নিয়োগ বা কাজে লাগানোর মাধ্যমে আমরা এই অল্প সময়ের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে পারি। গত ১৪ অক্টোবর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো দেশ কেন এগিয়ে থাকে এবং কোনো দেশ কেন পিছিয়ে থাকে, সে বিষয়ে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছেন এবারের নোবেলবিজয়ী তিন অর্থনীতিবিদ। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল- প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হওয়ায় জাতি কেন ব্যর্থ হয়। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, যেই সমাজে দুর্বল আইনের শাসন রয়েছে এবং যেখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শোষণের ঘটনা ঘটে সেখানে প্রবৃদ্ধি হয় না, কিংবা সেই সমাজ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে দক্ষ জনবল হিসেবে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে অবসরপ্রাপ্ত দক্ষ, অভিজ্ঞ সামরিক অফিসারদের আমরা বাছাই করতে পারি যারা কি না ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে এখনো দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করতে বদ্ধপরিকর।

আমরা জানি তুলনামূলকভাবে শারীরিকভাবে ফিট, সক্রিয়, চটপটে কেবল পদমর্যাদার উপর নির্ভর করে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের তাড়াতাড়ি অবসর গ্রহণ করতে হয়। একজন সামরিক অফিসারের প্রধান গুণাবলি হলো নেতৃত্বের ক্ষমতা এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে পরিচালনা করার ক্ষমতা। তাদের বহুমুখিতা এবং পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সেই পরিকল্পনাগুলো কার্যকর করার ক্ষমতা তাদের যেকোনো পরিবেশে অনন্য করে তুলতে পারে। এ ছাড়া দেশপ্রেম, ন্যায়পরায়ণতা ও সততা তাদের অতিরিক্ত যোগ্য করে তোলে। সে ক্ষেত্রে যেকোনো সেক্টরে এই দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগানো একটি বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ হবে বলে মনে করছি।

একটি প্রবাদ আছে- ‘উপদেশ অপেক্ষা দৃষ্টান্ত শ্রেয়’ দেশের এই জরুরি পর্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তাৎক্ষণিক ও কার্যকরভাবে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তিদের কাজে লাগানো যে, কার্যকর হবে তা আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরছি।

২০০৮ সালের জানুয়ারিতে এমএস রডের টনপ্রতি মূল্য ৪০ হাজার টাকা ছিল এবং পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে তা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি হয়ে ৭২ হাজার টাকা হয়। মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের সব নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজে অস্থিরতা শুরু হয়। ফলে ২০০৮ সালে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং চট্টগ্রাম কর্মস্থল হওয়া সত্ত্বেও কমোডর হিসেবে আমাকেও সামরিক সদস্য হিসেবে ওই কমিটিতে মনোনীত করা হয়। কমিটির অন্য বেসামরিক সদস্যরা ব্যস্ততার কারণে আন্তরিকভাবে এবং দ্রæত কাজটি সম্পন্ন করতে আশানুরূপ সক্রিয় ছিলেন না। আগে গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত থাকার সুবাদে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি না হয়ে সরেজমিন গ্রাউন্ড লেভেলে তদারকি করে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা যথাযথ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেই। ফলে মূল্যহ্রাসের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। মূল্যস্ফীতি কোনো একক সংস্থা বা নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর জন্য দরকার সুষ্ঠু মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বিত প্রচেষ্টা। আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে সিন্ডিকেট তৈরি করে পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে।

এ সিন্ডিকেট অতি দ্রুত ভাঙার জন্য তারা কোন পণ্য কি দামে কিনছেন, কত দামে বিক্রি করছেন, কতটুকু কোথায় মজুদ রাখছেন- এগুলোর সঠিক তথ্য রাখার জন্য এসব পণ্যের ব্যবসায়ীদের রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম চালু করে প্রতিটি লেনদেনের অনলাইন আপডেট তদারকিতে রাখার ব্যবস্থা করা জরুরি। আর দেশের এ অবস্থায় এই সেক্টরে পূর্ব অভিজ্ঞতা, দক্ষ ও নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে সাবেক সামরিক অফিসারদের অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এই দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। এ ছাড়া দ্রæত সত্য উদঘাটনের জন্য যেকোনো তদন্ত কমিটিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বোরি) সংস্কারের লক্ষ্যে মহাপরিচালক পদে পরিবর্তন এনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ৭ অক্টোবর ২০২৪ একটি প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফি ও ওশানোগ্রাফি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা কমোডর এম মিনারুল হককে মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে যেটি নিঃসন্দেহে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই গত ১৪ অক্টোবর ‘দৈনিক আমাদের সময়’ পত্রিকায় ‘কর্মবিরতি পালন করে সরকারকে চাপে রাখতে চায় বোরির (BORI) কর্মকর্তারা’ শিরোনামে একটি খবর আমরা দেখেছি। ওই কাজে একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ব্যক্তি তথা সামরিক বাহিনী থেকে মহাপরিচালক করায় যারা কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এর পেছনে মূল কারণ কী, যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে উদঘাটন করা জরুরি বলে মনে করছি? জাতির সর্বোচ্চ কল্যাণ বিবেচনায় সক্ষম, অভিজ্ঞ, নৈতিক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারের নাম সরবরাহ করতে পারেন বিশেষত যারা গত ১৫ বছরে অবসর পেয়েছেন এবং তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য (নির্বাচনের সময় পর্যন্ত অথবা তারও বেশি) রাষ্ট্রের উপযুক্ত পদে নিযুক্ত করা যেতে পারে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে, দেশের এই মহাসঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের সবাইকে বিবেকের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। কারণ এই রাষ্ট্রের সার্বিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরে পচন ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে গেছে। তাই উপযুক্ত ব্যক্তিদের বাছাইয়ের মাধ্যমে দল গঠন করে তাদের মেধা, কৌশল, অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করার সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে করে এই বিপ্লবের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বিফলে না যায়। সর্বোপরি অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ সংস্কার কাজে আরো বেশি বিপ্লবী ও কঠোর হওয়ার পাশাপাশি যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্য স্থানে নিযুক্ত করার মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আশা ব্যক্ত করছি।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও প্রো-ভিসি, বিইউপি


আরো সংবাদ



premium cement