২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আনুপাতিক ভোটের পক্ষ-বিপক্ষ

- প্রতীকী ছবি

আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আসন বণ্টন কিভাবে হবে? নির্দিষ্ট কোনো আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও মোট ভোটের ১০ শতাংশ ভোট পেয়ে কোনো দল যদি ৩০টি আসন পায়, সে ক্ষেত্রে তাদের কোন আসনগুলো দেয়া হবে? যে আসন তাদের দেয়া হবে সেখানে তাদের ভোট যদি ১০ শতাংশ বা তারও কম হয়, তাহলে সেখানে বাকি ৯০ শতাংশ ভোটারের প্রতিনিধি থাকল কোথায়? এ বিষয়ে ভাবতে হবে। এরকম হলে তো মানুষ আর ভোট দেয়ার আগ্রহ পাবে না। কোনো সংসদীয় আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট দেবে এক দলকে, আর বণ্টনের ফাঁদে পড়ে তাদের এমপি হবে অন্য দলের বা এলাকার কেউ! এরকম কিছু বাংলাদেশের ভোটাররা মোটেও ভালোভাবে গ্রহণ করবে কি?

জনপরিসরে নতুন নির্বাচনপদ্ধতির বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এখনো এ বিষয়ে কিছু বলেনি। ভবিষ্যতে দেশ কোন দিকে এবং কী ধারায় অগ্রসর হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। দেশে যাতে একনায়কত্বের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। সে লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাবও উত্থাপিত হচ্ছে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ আনুপাতিক ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করার পক্ষে, আবার এর বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থানও আছে অনেকেরই। সে যাই হোক, আমাদের দেশের চলমান ‘দ্বিদলীয়’ রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে, দেশে সত্যিকার শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

আনুপাতিক পদ্ধতিতে মানুষ ব্যক্তিকে নয়, ভোট দেবে দলীয় প্রতীকে এবং সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবিত তালিকা অনুযায়ী। অনেকেই বলছেন, দেশের বিদ্যমান নির্বাচনপদ্ধতি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়। এ ক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর ও সর্বোত্তম পন্থা। বাংলাদেশের এখনকার নির্বাচনী ব্যবস্থায় একজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটের চেয়ে কম পেয়েও জিততে পারেন; যখন তার প্রতিদ্ব›দ্বীরা বিভিন্ন মার্কায় বিভক্ত থাকেন। ধরা যাক, একজন প্রার্থী কাস্ট হওয়া এক লাখ ভোটের ৪০ হাজার পেলেন, আর তার তিন প্রতিদ্বন্দ্বী মিলে ৬০ হাজার (২৫+২০+১৫) ভোট পেলেন। এ রকম ক্ষেত্রে প্রথমজন জয়ী হয়েছেন বলেই ধরা হয়। এতে জাতীয় পার্লামেন্টে ওই নির্বাচনী এলাকার যিনি প্রতিনিধি হন, তিনি আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দের ও বাছাইকৃত নন।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না-ও পারে। প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে ভাগে পড়া আসনগুলোতে দলীয় প্রধান বা দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হবেন।

যারা আনুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে তারা আমাদের পাশ্বর্বর্তী দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কার দৃষ্টান্ত টানছেন। আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় নেপাল কিন্তু সুফল পায়নি। নড়বড়ে সরকার গঠিত হওয়ার ফলে ছোট দলগুলোর চাপে বারবার প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। নেপালে গত ১০ বছরে ৯ জন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হয়েছে। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের ফলে নেপালে এখন পর্যন্ত কোনো স্থিতিশীল ও শক্তিশালী সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। অথচ একটি দেশের উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীল সরকার থাকা জরুরি।

শ্রীলঙ্কা, নেপালের মতো অনুন্নত ছোট দেশের উদাহরণ আমরা কেন টানব? যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রিটেন, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো বৃহৎ/উন্নত দেশের উদাহরণ টানা যেতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের দেশে নির্বাচন আমাদের দেশের সার্বিক বিবেচনা ও পটভ‚মিতেই করা উচিত। মূল কথা হলো, জনগণের সঠিক ভোটাধিকারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, বাকস্বাধীনতা বজায় রাখা ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা বহাল রাখা হলে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবে হবে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মতো ছোট ও সঙ্ঘাতপূর্ণ দেশে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হলে, এ দেশ বিশ্ব মোড়লদের দাবা খেলার ঘুঁটিতে পরিণত হবে কি-না ভাবতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যমান পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবর্তে ভোটের আনুপাতিক হারে বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। তবে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এই পদ্ধতি চায় না। তারা বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। আর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কোনো ওপেনিয়ন এখনো জানা সম্ভব হয়নি।

অনুমান করা যায়, চলতি ব্যবস্থা বহাল থাকলে আসন্ন ভোটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। জনসমর্থন ও সাংগঠনিকভাবে তারা অন্য দলগুলোর চেয়ে এখন এগিয়ে আছে। তবে বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলো চাইছে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন। এমনকি বিএনপির অনেক পুরোনো জোট-সহযোগীও ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন চায়। তবে এ ধরনের সংস্কারে আওয়ামী লীগও ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে, যদি তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দেয়া না হয়। এ মুহূর্তে পুরোনো আসনভিত্তিক ভোটে নৌকা মার্কার পক্ষে অনেক জায়গায় প্রার্থী হতে গিয়ে প্রতিক‚ল পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারেন দলের প্রার্থীরা। কিন্তু আনুপাতিক পদ্ধতিতে জাতীয়ভাবে কেবল মার্কাকে সামনে রেখে ভোট হলে আওয়ামী লীগ তাদের এখনকার সাংগঠনিক সঙ্কট এড়িয়ে যেতে অনেকটা সক্ষম হবে।
স¤প্রতি জামায়াতে ইসলামী তাদের সংস্কার প্রস্তাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছে। জামায়াতে ইসলামী অতীতে বেশ কিছু ভুল করেছে। একাত্তরে ভুল, নব্বইয়ের দশকে এরশাদের সহযাত্রী হয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ভুল, ’৯৬-এর রাজনৈতিক ভুলের পর ’২৪-এ যদি জাতীয় পার্টি, বাম আর আওয়ামী লীগের চাওয়ার সাথে এক কাতারে দাঁড়ান, তাহলে আপনারা আরেক ইতিহাস হয়ে থাকবেন।

বিগত নির্বাচনগুলোতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যারাই পেয়েছে, তারা নিজেদের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করেছে। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সর্বসম্মতি ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হবে না। আর আবশ্যিকভাবে সংসদে শক্ত বিরোধী দল থাকবে।

কেউ কেউ বলছেন, আনুপাতিক নির্বাচন আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার একটি প্রক্রিয়া। আমরা বলতে চাই, প্রায় ৫০ বছরের সঙ্ঘাতময় রাজনীতির পর এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য একটি বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উত্তরণ খুবই প্রয়োজন। প্রকৃত অপরাধী, তছরুপ ও টাকা পাচারকারী এবং গণহত্যাকারী একটি দল পুনর্বাসনের দায়িত্ব যেন কেউ না নিই।

লেখক : সাংবাদিক
abunoman1972@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
পিক‌নিকের বা‌সে ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু : পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাসহ বরখাস্ত ৭ ঘন কুয়াশায় ঢেকেছে কুড়িগ্রাম, তাপমাত্রা ১৫.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ‘স্বৈরাচার ও ফ্যাসীবাদমুক্ত দেশ গড়তে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে’ রাশিয়ায় শিক্ষার্থীদের ‘নির্মমভাবে’ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিবাদ সাবেক প্রধান বিচারপতি রুহুল আমিন আর নেই তাজরীন ট্র্যাজেডির এক যুগ : পুনর্বাসনের দাবি আহতদের সিইসিসহ নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনারদের শপথ আজ জর্ডানে ইসরাইলি দূতাবাসের কাছে গুলি, বন্দুকধারী নিহত আহসান মঞ্জিল : বুড়িগঙ্গা-তীরের ঐতিহাসিক স্থাপনা বিউটি বোর্ডিং আছে, বিউটিয়ানরা নেই দিল্লি থেকে সরানো হবে ভারতের রাজধানী!

সকল