নির্বাচন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে
- ওয়ালিউল হক
- ২০ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৩৫
নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের ধারক-বাহকসহ সাধারণ মানুষও আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে, এতদিন যাবৎ যে নির্বাচন ব্যবস্থা ছিল সেটিই বহাল থাকবে নাকি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হবে। আমাদের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার নাম হচ্ছে, First past the post অর্থাৎ নির্বাচনী দৌড়ে প্রথম যিনি হবেন তিনিই জিতবেন। এ ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী আসনে যে কয়জন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবেন তাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন তাকেই ওই আসনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। অন্য দিকে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে নয়, দলকে ভোট দেয়া হয়। যে দল প্রদত্ত ভোটের যে কয় শতাংশ ভোট পাবে জাতীয় সংসদে তারা ওই কয় শতাংশ আসন পাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনো দল ৩০ শতাংশ ভোট পায় তাহলে জাতীয় সংসদেরও ৩০ শতাংশ আসন পাবে।
কয়েক দিন আগে নির্বাচন সংক্রান্ত একটি আলোচনা সভায় দেখা গেল, বিএনপি বাদে উপস্থিত অন্য সব দল সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছে। উপস্থিত দলগুলোর মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, গণসংহতি, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, সিপিবি। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে বেশ অনেক দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও দলের অন্য নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অভিমত কী তা জানা যাচ্ছে না। তবে অনেকেই ধারণা করেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে শুধু সম্মতই হবে না, আগ্রহের সাথে লুফে নেবে। কারণ ওই ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসা সহজ হয়ে যাবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, যেহেতু এ ধরনের একটি নির্বাচনী ব্যবস্থার সাথে এ দেশের সাধারণ মানুষ পরিচিত নয়, সে কারণে বিএনপি একটি নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষপাতী নয়। বিএনপির অন্য নেতারা বিভিন্ন টকশো ও আলোচনায় বলেছেন, প্রধানত দু’টি কারণে তারা সংখ্যানুপাতিক তত্তে¡র বিরোধী। ১. সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হবে। কারণ, আওয়ামী লীগের ২০-২৫ শতাংশ রিজার্ভ ভোট রয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫ শতাংশ ভোট পেলে সংসদে ৭৫টি আসন পাবে। ২. আগামী সাধরণ নির্বাচনে বিএনপির ভ‚মিধস বিজয় ঠেকানোর ষড়যন্ত্র হিসেবেই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে- সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হলে তাদের পক্ষে ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। সে ক্ষেত্রে তাদের হয়তো কোয়ালিশন পার্টনার খুঁজতে হবে। অন্য দিকে যদি বর্তমান নিবাচনী ব্যবস্থা বহাল থাকে তাহলে হয়তো ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে তারা দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে যেতে পারে। যেমনটি হয়েছিল ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সেবার বিএনপি ৪১.২ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল ২০৭টি। আর আওয়ামী লীগ ২৪.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল ৩৯টি।
দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতির সাথে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেশ খানিকটা মিল আছে। ১৯৭৫ সালে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) আজীবন চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ গণধিকৃত অবস্থায় ছিল। কারণ ১৯৭৪ সালে আওয়ামী শাসনামলে সংঘটিত দুর্ভিক্ষে বেসরকারি হিসাব মতে ১০-১৫ লাখ মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে, তদজনিত বিভিন্ন রকম অসুখ-বিসুখে মারা গিয়েছিল। আর ১৯৭২-৭৫ সালের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। কোয়ালিশন সরকার খুব একটি স্থিতিশীল সরকার হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার নজির আছে। পাকিস্তানে কোয়ালিশন পার্টনার সমর্থন প্রত্যাহার করায় ইমরান খান সরকারের পতন ঘটে। পরবর্তী সময়ে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও একক সংখ্যাগষ্ঠিতা না পাওয়ার কারণে বিরোধী দলের ভ‚মিকা পালন করছে। আবার নেপালে গত কয়েক বছর ধরে কোনো সরকারই বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারছে না। আমাদের এই ভূখণ্ডেও কোয়ালিশন সরকারের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান) আইন সভা নির্বাচনে শেরবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলেও সেই সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। একের পর এক মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও কোনোটিই স্থায়িত্ব পায়নি। যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলোর মধ্যে অর্থাৎ কেএসপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বিবাদ এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর ওপর অধিবেশন চলাকালে হামলা করা হয়েছিল এবং পেপার ওয়েটের আঘাতে তিনি আহত হয়েছিলেন। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় দু’দিন পর তার মৃত্যু হয়। পরবর্তী সময়ে সে ঘটনার বিচার হয়নি। আর তার জের হিসেবে এক মাসের মধ্যে অর্থাৎ অক্টোবরে পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন জারি হয়।
এ দিকে যারা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষপাতী তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু বিগত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে জনগণকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করেছে সে কারণে আওয়ামী লীগকেও তিনটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে তাহলে তাদের আসন পাওয়া নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আর সুশাসন যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে কোয়ালিশন সরকারও টিকে থাকে দীর্ঘ দিন। যার উদাহরণ হচ্ছে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ এবং তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান। মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একটানা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আর এরদোগান ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর এবং ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন।
বিএনপি মনে করে, ছোট দলগুলো স্বৈরতন্ত্র ঠেকানোর কথা বললেও আসলে তারা বড় দলগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। কারণ বড় দলকে যখন কোয়ালিশন পার্টনার খুঁজতে হবে তখন ছোট দলগুলো তাদের অযৌক্তিক দাবি বড় দলের কাছ থেকে আদায় করে নিতে চেষ্টা করবে। আর ছোট দলগুলো মনে করে, বিএনপি বড় দল হিসেবে অন্য কোনো দলকে বড় হতে দিতে চায় না বলেই তারা বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতি অব্যাহত রাখতে চায়। বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তাতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ছিল একে-অপরের প্রতিদ্ব›দ্বী। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি বিদ্যমান থাকলে আগামীতে ওই একই দৃশ্য দেখা যাবে। সাধারণ মানুষ ভোট পচাতে চায় না বলেই ওই দুই দলকে ভোট দেয়; কিন্তু সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে কোনো ভোটই পচবে না, কাজে লাগবে। সে কারণে ছোট দলের বড় দলে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
এখন বিএনপি ও অন্য দলগুলো যদি তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকে তাহলে দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে এবং ভারতের মদদপুষ্ট শেখ হাসিনা ও তার দলবল ‘চট করে’ দেশে ঢুকে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে দেশের স্বার্থে নমনীয় হতে হবে এবং একটি সমঝোতায় আসতে হবে। সমঝোতাটা হতে পারে এরকম : জাতীয় সংসদ হবে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষের নির্বাচন হবে প্রচলিত পদ্ধতিতে আর উচ্চকক্ষের নির্বাচন হবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। নিম্নকক্ষের নির্বাচনে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে উচ্চকক্ষে সে দল তত শতাংশ আসন পাবে। এতে করে কোনো দলের পক্ষে উচ্চকক্ষে একক আধিপত্য বিস্তার করা কঠিন হয়ে উঠবে। ফলে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার উত্থান রোধ সহজ হবে।
তাহলে বিএনপিকে এটি পরিষ্কার করতে হবে যে, তারা কেমন উচ্চকক্ষ চায়। অর্থাৎ উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কী হবে, সদস্য সংখ্যা কতজন হবে, সদস্যদের কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকবে কি না ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্রিটেনের হাউজ অব লর্ডসে আধ্যাত্মিক কোটায় ২৬ জন বিশপ আছেন। এখন বাংলাদেশেও সেরকম কোনো আধ্যাত্মিক কোটা থাকবে কি, যাতে করে ধর্মীয় ব্যাপারে আলেম-ওলামাদের পরামর্শ নেয়া যায়!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা