২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কি করবেন শেখ হাসিনা

- ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন কী করবেন? দলের দায়িত্ব কাকে দেবেন? তিনি নিজেই বা যাবেন কোথায়? এ নিয়ে তিনি মনস্থির করতে পারছেন না। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণবিপ্লবের মুখে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এখন পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করছেন। তার দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার প্রধান কারিগর ভারত সরকার এবং তার গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। ভারতের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল এমন- আমি কোনো প্রতিদান চাই না। কারো কাছে চাওয়ার অভ্যাস আমার কম, দেয়ার অভ্যাস বেশি। ভারতকে যা দেয়া হয়েছে তা তারা আজীবন মনে রাখবে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ভারতের নয়াদিল্লিতে গিয়ে আমি বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এখন প্রশ্ন, ৭৬ বছর বয়সে ভালোবাসার টানে দিল্লি গিয়ে শেখ হাসিনা কত দিন থাকতে পারবেন?

হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, কূটনীতিক পাসপোর্ট বাতিল হওয়ায় শেখ হাসিনার ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। হাসিনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক মামলা করা হয়েছে। বেশির ভাগই হত্যা মামলা। এসব মামলায় তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হবে।
হাসিনাকে ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট দিয়েছে ভারত সরকার। তাই নিয়ে এখন তিনি দুবাই চলে যাচ্ছেন- এমন আওয়াজ বাতাসে। আবার সেখানে গিয়ে আশ্রয় পাননি এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। যাই হোক, মাঝে মধ্যে তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের সাথে ফোনে কথা বলে প্রতিবিপ্লব ঘটাতে চাচ্ছেন। অনেকেই এটিকে ‘অডিও বিপ্লব’ বলছেন। পালিয়ে যাওয়া নেত্রী ফোনে তার এক নেতার সাথে বলছেন, আমি দেশের কাছাকাছি আছি, যেকোনো মুহূর্তে চট করে ঢুকে যাবো। নেত্রীর চট করে ঢুকে যাওয়ার কথা শুনে ভেতরে ভেতরে নেতাকর্মীদের ছটফটানি শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব আওয়ামী প্রেতাত্মারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন চেয়ারে এখনো বসে আছে তারাই ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে এবং বিভিন্ন তথ্য নেত্রীর কাছে পাচার করছে। ষড়যন্ত্র থেমে নেই সামাজিক মাধ্যমেও। লালমনিরহাটের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম উর্মি এক ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘সাংবিধানিক ভিত্তিহীন অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রিসেট বাটনে পুশ করা হয়েছে। অতীত মুছে গেছে। এভাবে দেশের ইতিহাস মুছে ফেলা সম্ভব নয়।’ এমন হাজারো তাপসী শহীদের মিছিলে গড়া দ্বিতীয় স্বাধীনতা ধূলিস্যাৎ করে দিতে মরিয়া হয়ে আছে। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে অডিও বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে নিমিষেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, আওয়ামী লীগের দায়িত্ব কার হাতে দিচ্ছেন। এই প্রশ্ন এখন সর্বত্র। নেতাকর্মীরাও চাচ্ছেন দলকে সংগঠিত করতে।

সর্বশেষ অডিও বার্তা থেকে জানা যায়, হাসিনা বলছেন, কাকে দায়িত্ব দেবো? যাকেই দেবো সেই তো গ্রেফতার হয়ে যাবে। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা বলছেন, হাসিনা দলের কাউকেই বিশ্বাস করেন না। তিনি শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করবেন পরিবারের মধ্যেই কাউকে বেছে নিতে। দুই মাস হয়ে গেল তিনি দিল্লিতে অবস্থান করছেন। তার সাথে রয়েছেন ছোট বোন রেহানা। কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল কাজের সূত্রে দিল্লিতে রয়েছেন। মাঝে মধ্যে তিনিও দেখা করছেন। ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা দেখা করছেন। করছেন শলাপরামর্শও। এ নিয়ে রয়েছে নানা গুজব। শোনা গেছে, হাসিনা তার ডাকসাইটে সাবেক এক মন্ত্রীকে দল গোছানোর দায়িত্ব দিয়েছেন অঘোষিতভাবে। এই নেতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও নেতাকর্মীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলছেন, ধৈর্য ধরো নেত্রী সহসাই নির্দেশ দেবেন।

এর আগেও এমন অবস্থা হয়েছিল আওয়ামী লীগের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব হত্যার পর অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। দলের একাংশ ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। তবে অনেক বড় বড় নেতা দেশেই অবস্থান করছিলেন আত্মগোপনে। অনেকে অবশ্য জেলে গিয়েছিলেন। পঁচাত্তরের ঘটনার পর ২১ বছর ক্ষমতার নাগাল পায়নি আওয়মী লীগ। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই পালিয়ে গেছেন। বিদেশে থাকায় ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনা বেঁচে গিয়েছিলেন। পশ্চিম জার্মানি থেকে ভারতে নিয়েছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। বলাবলি আছে, পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে শেখ হাসিনা কাউকে কিছু না বললেও দলের অন্তত দু’জন নেতাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় নেতাকর্মীরা যেন ভারতে চলে যায়। এ কারণেই কি সব ‘মাস্টারমাইন্ড’ও ভারতে পৌঁছে গেছে নিরাপদে!

যারা শেখ হাসিনাকে ডুবিয়েছেন তারাই আবার ঘুর ঘুর করছেন তার চারপাশে। এরাই কিন্তু নিজ দেশের নিরীহ জনগণের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়েছিল। যাই হোক, এটা কোনো সেফ এক্সিটের অংশ কি না- এ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। ঢাকায় আত্মগোপনরত কোনো নেতাই মুখ খুলছেন না; বরং যারাই রয়েছেন তাদের প্রায় সবাই শেখ হাসিনাকে দায়ী করছেন। বলছেন, তার একগুঁয়েমি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি এবং সীমাহীন দুর্নীতি দলকে অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলেছে। এই সঙ্কট এখন সর্বগ্রাসী।

শেখ হাসিনা কবে দেশে ফিরতে পারবেন? অসংখ্য হত্যা মামলা তার বিরুদ্ধে। গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে চলেছেন। প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলের দুর্নীতি, অনিয়ম, দুঃশাসন আর অসংখ্য বিচারবহিভর্‚ত হত্যার দায়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছাত্র-জনতা।

দলের কেউ কেউ বলছেন, অতিমাত্রায় ভারতনির্ভর হওয়ার কারণে শেখ হাসিনার এমন পরিণতি হয়েছে। সাথে ভারতও একপেশে নীতির কারণে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছে। আত্মগোপনরত একজন আওয়ামী লীগ নেতা বললেন, হাসিনার সমস্যা হাসিনা নিজেই। আমলাদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন, দলকে ব্যবহার করতেন লাঠিয়াল হিসেবে। দল আর সরকার এক হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে হাসিনার পতনের পর ঐতিহ্যবাহী এই দলটি হারিয়ে গেছে রাজনীতির মাঠ থেকে। আওয়ামী লীগ হয়তো আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ। মজার ব্যাপার হচ্ছে- যারা বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, এখন তারাই বলছেন, হাসিনার স্বৈরাচারী মনোভাব চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কতিপয় আমলা ও নেতার ওপর ছিলেন হাসিনা অন্ধ। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রোবটের মতো আচরণ করতেন। তাকে যা বলা হতো তাই তিনি বলে যেতেন অবলীলায়। একপর্যায়ে তিনি বনে গেলেন ‘বিএনপি-বিষয়ক মন্ত্রী’। প্রতিদিনই বিএনপি, তারেক রহমান আবার কখনো জিয়াউর রহমানকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন। ফ্যাশন আর টাকা বানানোর নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল। এখন তিনি কোথায়? সিঙ্গাপুর না ভারত, কেউ বলতে পারছেন না। শোনা গিয়েছিল, তিনি নাকি যশোর সেনানিবাসে রয়েছেন।

আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের সাধারণ সম্পাদক যখন নিরাপত্তাবাহিনীকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয় তখনই প্রশ্ন ওঠে, এই কাজটি কার। কারফিউ জারি হলে পুলিশ বা সেনাবাহিনী এই নির্দেশ দিয়ে থাকে। আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট- এই বার্তাও দিয়েছিলেন। এতে করে ছাত্রলীগ পরিণত হয় দানবে। জনমানুষের ঘৃণা সৃষ্টি হয় তাদের বিরুদ্ধে। এ জন্য কাদেরকেই দায়ী করা হচ্ছে। তিনি হয়তো বলবেন, আমাকে যা বলা হয়েছিল আমি তাই বলেছি।

এখন হাসিনার সামনে বিকল্প কী? আন্তর্জাতিক চাপে ভারত তাকে বলেছে, ভিন্ন গন্তব্য খোঁজার।

হাসিনা বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারের কার্যক্রমের নিত্যদিনের হিসাব-নিকাশ পেয়ে যাচ্ছেন মুহূর্তেই। তিনি তার সহকর্মীদের বলছেন, মজা টের পাক। কতদূর যাবে? দেখো এক মাসও টেকে কি না!

সত্য বটে, অন্তর্র্বর্তী সরকার এখনো শক্ত ভিতে দাঁড়াতে পারেনি। সরকারের ভেতরে রাজনৈতিক শক্তির উপস্থিতি না থাকায় এমনটি হয়েছে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তিন মাস কেটে গেল এভাবেই। সংলাপে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। বিএনপি চাচ্ছে যৌক্তিক সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন। জামায়াত হাঁটছে ভিন্ন পথে। তারা চায় সংস্কার শেষে নির্বাচন। এটি কিন্তু বলা হচ্ছে না, সংস্কারের জন্য কতদিন সময় দরকার।

জামায়াতের এই কৌশল পরাজিত শক্তিকেই উৎসাহিত করতে পারে। তারা অবশ্য আগেও কিছু ভুল করেছে। ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ ছিল জামায়াত। ২০০১ সালে বিএপির সাথে রাজনৈতিক জোট করার সাথে সাথে জামায়াত হয়ে গেল যুদ্ধাপরাধী, আওয়ামী লীগের শত্রু। শুধু শত্রু নয়, এমন হিংস্র হয়ে উঠল দলটি যে, জামায়াতের প্রথম সারির নেতাদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ এনে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়। এটিই আওয়ামী চরিত্র। জামায়াতের এই কৌশলকে উৎসাহিত করছে আঞ্চলিক একটি শক্তি, যে শক্তিগুলো বরাবরই জামায়াতে ইসলামীর বিরোধী ভ‚মিকায় ছিল।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখনকার ঘটনা। একদিন মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত সচিব হাসতে হাসতে এসে বললেন, স্যার আজ একটি সুখবর আছে। শেরেবাংলা জানতে চাইলেন কী সেই সুখবর!

একান্ত সচিব বললেন, স্যার আজ আনন্দবাজার আপনার প্রশংসা করেছে। তখন শেরেবাংলা বললেন, আরে গর্দভ, এটি সুখবর নয়। খোঁজ নিয়ে দেখো, আমি কোথাও ভুল করেছি। মনে রেখ, ওরা যখন আমার প্রশংসা করবে তখন বুঝবে আমি ঠিক পথে নেই। আর যখন সমালোচনা করবে তখন বুঝবে আমি সঠিক পথে রয়েছি।

এ দিকে ইসলামপন্থীরা সংগঠিত হচ্ছে। তারা নতুন এক কাফেলা তৈরি করতে যাচ্ছে। যেটি এর আগে কখনো হয়নি। এই ভূখণ্ডে নতুন। নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, এই কাফেলা তত দীর্ঘ হবে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়!


আরো সংবাদ



premium cement