২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাজনীতি ও ছদ্মাবরণ

- প্রতীকী ছবি

ছদ্মবেশ ধারণ করে মানুষের দুঃখকষ্ট দেখে তা লাঘবের চেষ্টা করার ক্ষেত্রে মুসলিম খলিফাদের সুখ্যাতি আছে। বিশেষ করে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ও পরবর্তী হারুন-অর-রশিদের নাম উল্লেখযোগ্য। শুধু ইসলামের খলিফারা নন, অনৈসলামিক জগতেও ছদ্মবেশ ধারণ করে তথ্যানুসন্ধানের দৃষ্টান্ত রয়েছে। একবার হিটলার তার প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসের কাছে ছদ্মবেশে শহর ঘুরে দেখার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু তার ছদ্মবেশ কী হবে সে বিষয়ে গোয়েবলসকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, লোকে আপনার গোঁফই বেশি চেনে। অতএব সেটি ফেলে দিলেই আপনার বিশেষ কোনো আবরণ গ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না। আর গোয়েবলস একটু বেশি কথা বলতেন। তাই তিনি কম কথা বললে লোকে তাকে চিনতে পারবে না। এরূপ ছদ্মাবরণে একদিন দু’জন বেরিয়ে পড়লেন ইহুদিদের ব্যবসায়-বাণিজ্য দেখতে। ছদ্মবেশ ধারণের এমন দৃষ্টান্ত এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কম দেখছি না।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসরদের ছদ্মাবরণ মানুষের হাসির খোরাক হয়েছে। বিশেষ করে ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান ও সাংবাদিক শ্যামল দত্তের দাড়িবিহীন চেহারা দেখে কিংবা দাড়ি-টুপিওয়ালা সেজে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে দেখে হঠাৎ চেনার উপায় ছিল না। তাই শুধু আবরণ ছদ্ম হলেই হয় না, কৌশলটাও পারফেক্ট হওয়া চাই। তাহলেই কামিয়াব হওয়া সম্ভব। যেমনটি হয়েছিল নেতাজী সুভাষ বসুর ক্ষেত্রে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তিনি পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে একজন ‘মাওলানা’র বেশে ঘর ছেড়েছিলেন।

ছদ্মাবরণ ধারণ যে শুধু চেহারা ও পোশাক পরিবর্তন করেই করা হয়, তা নয়। নিজ পরিচয় গোপন রেখে ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিতি হওয়াটাও এক ধরনের ছদ্মাবরণ। অনেকে অন্য দলে স্পাই হিসেবে কাজ করেন। স্পাইগিরি করতে গিয়ে অনেকে আবার সেই দলেরই নেতা বনে যান। নিজ দলে তার আর ফেরা হয় না। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। শুধু রাজনীতিই করেননি একসময় সফলও হয়েছেন। এ বিষয়ে এডর্ন পাবলিকেশন্স প্রকাশিত একুশের স্মারকগ্রন্থে মোহাম্মাদ তোয়াহা তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাজউদ্দীন পূর্বাপর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যদিও তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগ করতেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের সাথেই জড়িত ছিলেন। পার্টির সিদ্ধান্তেই তাকে আওয়ামী লীগে রাখা হয়।

সর্বশেষ রাজনীতির ছদ্মাবরণের অভিযোগে যে নামটি এখন চাউর হয়েছে, তিনি সাদিক কায়েম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি সাইমুম মাহমুদ নামে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি তিনি ইসলামী ছাত্র শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হিসেবে নিজ পরিচয় প্রকাশ করেছেন। গণ-অভ্যুত্থানে পতিত স্বৈরাচারপন্থীদের অভিযোগ, তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছদ্মাবরণে শিবিরের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। এখন দেখার বিষয়, শিবিরের অ্যাজেন্ডা কী ছিল এবং সেটি বাস্তবায়নে তার ছদ্মাবরণ কোনো অন্যায় ছিল কি না। ফ্যাসিবাদপন্থী প্রধান ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ১৪ দল সমর্থিত অন্যান্য ছাত্র সংগঠন বাদে দেশের সব ছাত্র সংগঠন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চেপে বসা ফ্যাসিবাদকে অপসারণের জন্য আন্দোলন করেছে। অর্থাৎ- ফ্যাসিবাদ পতনের অ্যাজেন্ডা শুধু ছাত্রশিবিরের নয়, সব ছাত্র জনতার। ফ্যাসিবাদ বিরোধিতায় স্বনামে আন্দোলন করলে যেভাবে সরকারের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতন ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার চেয়ে তুলনামূলক কম বিরোধিতা হয়েছে। একই সাথে রাজনৈতিক ব্যানারে আন্দোলন করে সাধারণ জনগণের আশানুরূপ সমর্থন পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে করলে জনসমর্থন বেশি মিলেছে। এসব বিবেচনায় শুধু ছাত্রশিবির নয়, ছাত্রদলসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোও পরোক্ষভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছিল। এ ছাড়া বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর বাধার কারণে দীর্ঘদিন ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেনি। কিন্তু তাদের কার্যক্রম থেমে ছিল না। ছাত্র তথা দেশের প্রয়োজনে তারা পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে কোথাও স্বনামে আবার কোথাও বেনামে কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, আন্দোলন করেছে। এক পর্যায়ে গত ১ আগস্ট তাদের সহযোগী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সাথে তাদেরকেও যখন ফ্যাসিস্ট সরকার নিষিদ্ধ করল, তখন প্রকাশ্যে আন্দোলনের আর সুযোগ রইল না। এমতাবস্থায় রাজনীতির কৌশল হিসেবে ছাত্রশিবিরের অনেকে নিজের পরিচয় গোপন রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদের পতন ত্বরান্বিত করেছে। তাই তাদের এরূপ কর্মকাণ্ডে দোষের কিছু নেই। এ ছাড়া শুধু ছাত্রশিবিরই ছদ্মাবরণ ধারণ করেছে এমন নয়। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামক ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররাও তাদের পরিচয় গোপন রেখে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দু’জন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলাম তার দৃষ্টান্ত। এসবই রাজনৈতিক কৌশল। কৌশল শুধু মানুষ করে না, আল্লাহ তায়ালাও করেন। যেমনটি তিনি করেছিলেন, ফেরাউনের ঘরে নবী মুসাকে বড় করে।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী বাদে দেশের সব মানুষ তাদের দ্বারা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ও অবহেলিত ছিল। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের যে অ্যাজেন্ডা, সেটি শুধু ছাত্রশিবিরের গোপন কোনো অ্যাজেন্ডা নয় বরং তা ছিল দেশবাসীর। তাই ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণ-বিপ্লবকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement