২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সাংবিধানিক রাজনীতি ও জামায়াতে ইসলামী

-

পর্ব-২
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী পাকিস্তানে হিজরত করেন এবং সেখানে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত রেডিওতে পর পর পাঁচটি বক্তৃতা করেন। তাতে তিনি ইসলামের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শিক্ষার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তার কাছে ইসলাম একটি স্লেøাগান মাত্র ছিল না। তিনি দেশের সেই স্বল্পসংখ্যক নেতাদের একজন যারা মুখে যা বলেছেন, বাস্তবেও তা কার্যকর করে দেখিয়েছেন। তিনি বিরামহীনভাবে সারাদেশ সফর করে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে বক্তৃতা করে জনমত গড়ে তোলেন। তার এসব সত্যনিষ্ঠ বক্তব্য বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত হানে। মাওলানার ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবি তাদের কাছে অসহ্যকর লাগে এবং তারা তাকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে অভিযুক্ত করে। ফলে ১৯৪৮ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ১৯৫০ সালের ২৮ মে পর্যন্ত তাকে কারারুদ্ধ রাখা হয়।

সংবিধান রচনায় জামায়াত : আবুল আ’লা মওদূদী শুরু থেকেই পাকিস্তানের জন্য একটি ইসলামী শাসনতন্ত্র রচনার ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মাওলানা মওদূদীর প্রচেষ্টায় এই শতাব্দীতে প্রথমবারের মতো ৩১ জন বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপ তথা দেওবন্দি, ব্রেলভী, আহলে হাদিস ও শিয়া আলেমরা করাচিতে মিলিত হন। তার প্রচেষ্টার বদৌলতে পাকিস্তানের জন্য একটি ইসলামী সংবিধানের ভিত্তি তখনই রচিত হয় যখন জাতীয় পরিষদে (Coustituent Assembly) ‘আদর্শ প্রস্তাব’ (The Objective Resolution) গৃহীত হয়। এতে তারা ২৪ দফা নীতিমালা গ্রহণ করেন যা নতুন সংবিধানে সংযোজন করা হয়।

ফাঁসির কাষ্ঠে মওদূদী : ১৯৫১-৫৩ সালের দিকে পাঞ্জাব প্রদেশের অধিবাসীদের অধিকাংশই কাদিয়ানিদেরকে সংবিধানে আলাদা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ঘোষণার দাবি করে। মাওলানা মওদূদী তাদের এই দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি ‘কাদিয়ানি সমস্যা’ নামে এক পুস্তিকা রচনা করেন এবং তাতে সরকারি নীতির সমালোচনা করেন। ফলে ১৯৫৩ সালের ২৯ শে মার্চ তাকে গ্রেফতার করা হয়। সামরিক আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলে তিনি ঘোষণা করেন, ‘যদি আল্লাহর এরূপ ইচ্ছা থাকে আমি তাহলে হাসিমুখে তা বরণ করে নেবো। আর আমি এখনই মরে যাব এরূপ ইচ্ছা যদি তার না থাকে তাহলে তারা যে চেষ্টাই করুক না কেন, আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (আব্বাস আলী খান)

যা হোক, এই মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্ব এতই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে যে, সরকার বাধ্য হয়ে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ রহিত করে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়। ১৯৫৫ সালের ২৫ মে হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস রিট ইস্যু করলে মাওলানা মুক্তি লাভ করেন। অবশেষে ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিকের প্রথম সংবিধান চালু করা হয়। এতে জামায়াতের অধিকাংশ দাবিই গৃহীত হয়। কিন্তু পাকিস্তানে একটি সত্যিকার ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এই সংবিধান একটি ভিত্তি হিসেবে দাঁড়ালেও দুঃখজনকভাবে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর একটি ডিক্রির দ্বারা সংবিধান বাতিল ঘোষণা করেন। পরে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করেন এবং জামায়াতে ইসলামীসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

ইসলামী আইনের জন্য মওদূদীর সংগ্রাম : মাওলানা মওদূদী সামরিক আইন থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত যত বক্তৃতা করেন তা সঙ্কলিত করে বৃহত্তর ও সংশোধিত আকারে ‘ইসলামী আইন ও সংবিধান’ নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। এতে তিনি আধুনিক সরকারে কিভাবে শরিয়াহ আইন চালু করা সম্ভব তা যুক্তিসঙ্গতভাবে তুলে ধরেন। তার যুক্তি এতটাই বলিষ্ঠ ছিল যে, উচ্চস্তরের খ্রিষ্টান পাকিস্তানের চিফ জাস্টিস এ আর কর্নেলিয়াস পর্যন্ত জনসমক্ষে পাকিস্তানের জন্য একমাত্র শরিয়াহ আইন উপযুক্ত বলে সুপারিশ করেন। ১৯৬৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে সব বিচারক ইসলামী আইন চালুর আশা প্রকাশ করেন। ১৯৬০ সালের ৫ ও ৬ মে মাওলানা মওদূদী এবং সব মুসলিম গ্রুপের প্রতিনিধিত্বশীল আলেমদের এক সম্মেলন লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়। তারা সরকারের শাসনতন্ত্র কমিশন কর্তৃক তাদের কাছে উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণ তুলে ধরেন এবং গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেন।

১৯৬১ সালের All Pakistan Women’s Association-এর সুপারিশে আইয়ুব খান মুসলিম পারিবারিক আইন (অর্ডিন্যান্স) ঘোষণা করেন যাতে শরিয়াহবিরোধী বিধান সংযোজন করা হয়। এ সময় মাওলানা মওদূদীসহ ২০৯ জন আলেম এক বিবৃতিতে এর জোর প্রতিবাদ করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান।

১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান তার ইচ্ছামতো একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন। তাতে ইসলামকে রাষ্ট্রের মৌল আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হলেও তা ছিল অগণতান্ত্রিক এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার অনুপযোগী। তা ছাড়া এতে একনায়কতন্ত্রের দ্বার প্রস্তুত করা হয়েছিল। জামায়াত ১৯৫৬ সালের সংবিধান সংশোধন করে চালু করার দাবি জানায়। জামায়াতের আন্দোলন শক্তিশালী হতে শুরু করলে ১৯৬৪ সালের ৬ জানুয়ারি জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মওদূদী ও অন্যান্য জামায়াত নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। জামায়াতের নামে মিথ্যা মামলা সাজানো হয়। কিন্তু পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা বেআইনি বলে রায় দেন।

আইয়ুব খানের শাসনামলে (’৫৮-’৬৯) পাকিস্তানে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন, জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য অবাধ প্রচার, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার ছড়াছড়ি, মদ, জুয়া পতিতালয়ের প্রসার, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ ও সরকারি চাকরিজীবী, অর্থনৈতিক বৈষম্য, গণতন্ত্রের প্রতি বাধা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড ইসলামী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আইয়ুব খান বেশ চাতুর্যের সাথে ইসলামী নাম ব্যবহার করতেন। জামায়াত আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল। কিন্তু আন্দোলন যতই অগ্রসর হতে থাকে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও যেন জামায়াতের কমে যায়। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে ইসলামী সংবিধান চালু করার ব্যাপারে প্রতিটি সরকারের যেমন গড়িমসি ছিল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষত বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী দলগুলোও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করেনি। মুসলিম লীগের অদূরদর্শিতা, কায়েমি স্বার্থবাদিতা ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের ফলে পাকিস্তানে বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী দলগুলো বিকশিত হয়। এ জাতীয় দলগুলো আইয়ুব খানকে অপসারণ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকে। আর জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলো চাচ্ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সংবিধান। ফলে আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলন দ্বিমুখী প্রক্রিয়ায় চলছিল। আইয়ুব খান নতি স্বীকারের কাছাকাছি এসে গিয়েছিলেন। ঠিক সে সময় বামপন্থীরা হঠকারিতা করে আন্দোলনকে ধ্বংসাত্মক তৎপরতার দিকে নিয়ে যায়। মাওলানা মওদূদী অবস্থা আঁচ করে জনমতকে সঠিক খাতে রাখার জন্য ১৯৬৯ সালের ২৩ মার্চ ‘জোশে ইসলাম দিবস’ পালনের আহ্বান জানান। এ দিবসটি জনগণের মধ্যে এমন বিপুল সাড়া জাগায় যা পাকিস্তানের ইতিহাসে ছিল এক অনন্য ঘটনা। অবশ্য পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে। মুসলিম লীগ ইসলামের নাম নিয়ে বহুবিধ ইসলামবিরোধী কাজ করার ফলে জাতীয়তাবাদীরা ইসলাম ও ইসলামপন্থী দলগুলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর সুযোগ পায়।

আইয়ুব খান এক শ্রেণীর আলেমকে হাত করে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতেন। তারা সর্বদা তার স্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকত। পক্ষান্তরে, তারা ইসলামী আন্দোলনকারী সংগঠনের বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজিতে লিপ্ত থাকত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। এই শ্রেণীর তথাকথিত আলেম গোষ্ঠী পাকিস্তানে ইসলামী আন্দোলনের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করে। আইয়ুবের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও অনৈসলামিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জামায়াতসহ অন্যান্য বিরোধী দল গণ-আন্দোলন শুরু করে। প্রথমে রাজনৈতিক জোট পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (PDM) এবং পরবর্তীতে ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটির (DAC) আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠলে আইয়ুব খান অনেকটা বিব্রত হয়ে পড়েন।

দেশে মারাত্মক রাজনৈতিক অরাজকতার মুখে আইয়ুব খান অবশেষ ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এবং দেশে আবার সামরিক আইন জারি হয়। বারবার সামরিক একনায়কত্বের হাতে পড়ে পাকিস্তান শাসনতান্ত্রিক সঙ্কটে পড়ে এবং তাতে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজও ব্যাহত হয়। আইয়ুবের মতো ইয়াহিয়াও ইসলামের প্রতি আন্তরিক ছিল না। যদিও ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে তার Legal Framework Order-এ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল।

১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার এক পরীক্ষা মাত্র। পাকিস্তানের জনগণ প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের মতামত দেয়ার সুযোগ পায়। জামায়াতের মতো ইসলামী সংগঠনও নির্বাচনে অংশ নেয়। জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলো জনগণকে ইসলামী আদর্শের পক্ষে রায় দেয়ার আহ্বান জানায়। কারণ এ নির্বাচনে বিজয়ী গণপ্রতিনিধিরাই সংবিধান তৈরি করবে। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ছয় দফার জনপ্রিয়তায় আওয়ামী লীগের প্রবল জোয়ারের সামনে জামায়াতসহ কোনো দলই দাঁড়াতে পারেনি। পশ্চিমাঞ্চলে জুলফিকার আলী ভুট্টো ‘ইসলামী সমাজতন্ত্রের’ স্লোগান দ্বারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে ভোটে জয়লাভ করেন। মুজিব একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানালে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অভ্যন্তরীণ সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ফলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
ayubmiah@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement