২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যের অধিকার

- প্রতীকী ছবি

প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব খাদ্য দিবস। ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য- ‘উন্নত এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার’ মূলত পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে গুরুত্ব দেয়। খাদ্যের অভাব বা অপুষ্টি কেবল ব্যক্তির শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে না; বরং এটি সমাজ ও অর্থনীতির ওপরও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানবসম্পদের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে ধাবিত হওয়া সম্ভব।

সুষম খাদ্য বলতে এমন খাদ্যকে বোঝায়, যা প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান- শর্করা, প্রোটিন, স্নেহ, ভিটামিন ও খনিজ পর্যাপ্ত অনুপাতে সরবরাহ করে। সুষম খাদ্য শারীরিক বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বুদ্ধিমত্তার বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

জন্মের পর প্রথম এক হাজার দিনকে বলা হয় শিশুর জীবনের ‘গোল্ডেন পিরিয়ড’, যেখানে তাদের পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করতে না পারলে মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়। দীর্ঘমেয়াদে এই ঘাটতি শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ, জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা এবং ভবিষ্যতের কর্মক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। তাই ছোটবেলা থেকে পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ শুধু ব্যক্তির ভবিষ্যতের জন্য নয়; বরং জাতির সার্বিক সমৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অপুষ্টি, বিশেষত ভিটামিন ও খনিজের অভাব, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বিশেষভাবে দুর্বল করে দেয়। সুষম খাদ্য আমাদের শরীরকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ ও রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। পুষ্টির অভাবে অনেক ধরনের রোগ যেমন- অ্যানিমিয়া, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ওবেসিটি বা স্থূলতার মতো রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পরিমিত সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে এই ধরনের রোগ প্রতিরোধ করা যায়। পুষ্টিকর খাবার যেমন- শাক-সবজি, ফলমূল, গোটা শস্যজাতীয় খাবার এবং সঠিক প্রোটিন গ্রহণ দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকরG

বিশ্বের বহু দেশে খাদ্য নিরাপত্তা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং পুষ্টির অভাব, পুষ্টিবিদদের অভাব, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালেও ৭২০-৮১১ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। অথচ বিশ্বে উৎপাদিত খাদ্যের পরিমাণ বিশ্ব জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট।

বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে দারিদ্র্য এমন এক সমস্যা, যা খাদ্য নিরাপত্তার পথে বড় অন্তরায়। অপরদিকে, উন্নত দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ খাদ্য অপচয় হয়, যা আরো বেশি বৈষম্যের সৃষ্টি করে। তাই খাদ্য বণ্টনের ক্ষেত্রে একটি সম্মিলিত বৈশ্বিক নীতি প্রয়োজন, যা পুষ্টিকর খাদ্যের সমান বণ্টন নিশ্চিত করতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বন্যা, খরা এবং তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, জলবায়ু সহনশীল ফসলের চাষ এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্যের প্রচলন এই সমস্যা সমাধানের দিকে কার্যকরী পদক্ষেপ।

জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (SDGs) মধ্যে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো- ‘ক্ষুধা মুক্তি’ এবং ‘স্বাস্থ্যকর জীবন’ নিশ্চিত করা। ২০৩০ সালের মধ্যে সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি, দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য সুষ্ঠু খাদ্য বণ্টনের ব্যবস্থা করা সমাজের সব মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। একে দু’ভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে :

একটি উন্নত এবং সমৃদ্ধ জাতি পেতে হলে মায়ের পুষ্টি শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ, একটি ভ্রূণ যখন মায়ের পেটে থাকে তখন থেকেই তার মগজ ডেভেলপমেন্ট শুরু হয়, এ জন্য গর্ভবতী মহিলাকে এবং তার পরিবারকে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে কর্মশালার মাধ্যমে পুষ্টি শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন করতে স্কুল পর্যায়ে পুষ্টি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রচার করা যেতে পারে। সব ধরনের গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্থানীয় কমিউনিটির মাধ্যমে পুষ্টিকর খাদ্যের বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি হসপিটাল, ক্লিনিক, ব্যাংক- এ সব প্রতিষ্ঠানে নিউট্রিশনিস্ট বা পুষ্টিবিদ নিয়োগ দানের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টিবিষয়ক সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব। সাধারণ জনগোষ্ঠী সঠিক ধারণা না থাকার কারণে অপুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে জনগণ পুষ্টিসেবা পুষ্টিবিদদের কাছ থেকে গ্রহণ করার মাধ্যমে বিভিন্ন অসংক্রমিত রোগ (ডায়াবেটিস, স্থূলতা, হৃদরোগ, ফ্যাটি লিভার, বিভিন্ন ধরনের হরমোনের ভারসাম্যহীনতা) থেকে প্রতিরোধ এবং প্রতিকার করা সম্ভব হবে। অন্যথায় অল্প বয়স থেকে কঠিন কঠিন অসংক্রমিত রোগের সম্মুখীন হওয়ার মাধ্যমে মানবসম্পদ দেশের জন্য কল্যাণমূলক কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না, ফলে এটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের বাধা স্বরূপ।

২০২৪ সালের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘উন্নত এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার’ কেবল খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ দেয় না; বরং খাদ্যকে পুষ্টিকর ও সুষম করে তোলার উপরও জোর দেয়। পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাতে আমাদের আগামীর দিনগুলো আরো উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ হয়।

লেখক: পুষ্টিবিদ ‘ডায়েট কনসালটেন্ট অ্যান্ড ডায়াবেটিস এডুকেটর’
ইবনে সিনা হসপিটাল, ধানমন্ডি।


আরো সংবাদ



premium cement