২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নন-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার

- প্রতীকী ছবি

চরম নাজুক অবস্থায় রয়েছে দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে মাট ৩৫টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে জুন ২০২৪ পর্যন্ত ঋণের স্থিতি ছিল ৭৪ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা।

ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এটি মোট ঋণের প্রায় ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। এসব নন-ব্যাংক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের অর্থ সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। আস্থার সঙ্কট তৈরি হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে নতুন করে আমানতও রাখতে চাচ্ছেন না গ্রাহকরা। এসব প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকসংখ্যা কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। আয় কমেছে ১০.৪৪ শতাংশ।

বলা হয়ে থাকে, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন দুরবস্থার পেছনে রয়েছে লুটেরা চক্র। তারা বিগত সরকারের আমলে উচ্চ মহলের ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে এবং প্রভাব খাটিয়ে নিয়ম না মেনে অর্থ ছাড় করিয়ে নিত। খুঁটির জোর দেখিয়ে তারা আর ঋণ পরিশোধ করছে না। অনিয়ম, লুটপাট আর ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ ঋণই এখন খেলাপি। বিশেষ করে ১৪-১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা ঋণের ৪৫ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি হয়ে গেছে। নিকট অতীতের কয়েক বছরের খেলাপি ঋণের চিত্র থেকে দেখা যায় কি যে চরম সঙ্কটে রয়েছে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

২০২০-এর জুন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ ছিল আট হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। ২০২১ এ জুনে হয় ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা, ২০২২-এ জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি এবং ২০২৩-এ জুনে ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা খেলাপি ছিল। সর্বশেষ ২০২৪-এ জুনে মোট বিতরণকৃত ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।

আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস খেলাপি ৯৯.০২ শতাংশ অর্থাৎ এক হাজার ৯৬ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির খেলাপি ৯৬.৮৫ শতাংশ বা ৭৪০ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং খেলাপি ৯৪.৭৬ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। এ ছাড়া পি কে হালদার-সংশ্লিষ্ট এফএএস ফাইন্যান্সের খেলাপি ৮৯.৫৬ শতাংশ অর্থাৎ এক হাজার ৬৪৫ কোটি। আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ৭১.৭২ শতাংশ। এর বাইরে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৯৪.৪১ শতাংশ এবং জিএসপি ফাইন্যান্সের ৯২.৩৭ শতাংশ খেলাপি রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। ব্যাংকগুলোর সাথে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এ ছাড়া নানা অনিয়মের কারণে এ খাতের ভাবমর্যাদা নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য খারাপ থাকার কারণে অনেকে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ক্রমেই বেড়ে চলছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির এখানে ঘাটতি রয়েছে।
তথ্য বলছে, দেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতে প্রশান্ত কুমার হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার পরে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।

আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পেরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবসায়নেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিগত সরকার। কিন্তু পরে আদালতের নির্দেশে আবারো পুনরুজ্জীবিত করা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখছেন না আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে আর্থিক খাতের অনিয়মের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে একদিকে যেমন খেলাপি ঋণ বেড়েছে অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান পড়েছে তারল্য সঙ্কটে। যার ফলে আমানতকারীদের প্রয়োজন সময়মতো অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। মানুষ আমানত রাখতে ভয় পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে আদায় অযোগ্য ঋণের অঙ্ক ২১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ২৮ দশমিক ২২ শতাংশ। এত বড় অঙ্কের আদায় অযোগ্য ঋণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতকেই ঝুঁকিতে ফেলেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আর্থিক খাতে ঋণ জালিয়াতি ও ব্যাপক মাত্রায় অর্থপাচার ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ অত্যধিক হারে বৃদ্ধি তারল্য সঙ্কটের অন্যতম কারণ। হাসিনার ক্ষমতার সাড়ে ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ যে কী পরিমাণ বেড়েছে, তা রীতিমতো এক ভয়ঙ্কর চিত্র। এই সময়ে শুধু ব্যাংক খাতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। এই ঋণেরও বড় অংশই আদায় অযোগ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে ২০২৪ সালের জুন শেষে বিতরণকৃত মোট ঋণ ছিল ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ফলে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই এখন খেলাপি। তিন মাস আগে মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.১১ শতাংশ। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। এ পরিপ্রেক্ষিতে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সংস্কারের আওতায় আনা উচিত বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক খাতে সংস্কারের যে উদ্যোগ নিচ্ছে সেভাবে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতেও সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারে। এ ছাড়া কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসায় ও বাণিজ্য খাতে গতি ফিরিয়ে আনতে হলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাংক খাতের পাশাপাশি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে অনেক অবদান রেখে চলেছে। তাই আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য টেকসই ও সুসংহত করতে হলে ব্যাংক খাতের পাশাপাশি নন-ব্যাংক খাতের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অর্থঋণ আদালতগুলোকেও আরো সচল করতে হবে। অর্থঋণ আদালতের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা উচিত। আদালতের সংখ্যা কম হওয়ায় এক মামলা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে হচ্ছে। মামলার তারিখ অনেক ব্যবধানে রাখা হয়। ফলে সময়ক্ষেপণ হয়। দ্রত মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা গেলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও আরো গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। ব্যাংক ও নন-ব্যাংক উভয়েরই রিকভারি এবং তদারকি জোরদার করতে হবে। খেলাপিদের ঋণের বিপরীতে যে বন্ধক রয়েছে তা আইনানুগভাবে নিলাম দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। খেলাপিরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদের দ্রত আইনের আওতায় আনা উচিত। ইতোমধ্যে আর্থিক খাত নিয়ে অন্তর্র্র্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে, যার ফলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আসা শুরু করছে। আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আসছে। প্রচুর রেমিট্যান্সও আসতে শুরু করেছে। আর্থিক খাতের তারল্য সঙ্কটের শিগগিরই উত্তরণ ঘটবে এবং জনগণ স্বাচ্ছন্দ্যে আমানত রাখবে ও বিনিয়োগ গ্রহণ করে দেশের আর্থিক খাতের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেল : main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement