২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পূজায় ইসলামী গান : পেছনে কী

- ছবি : সংগৃহীত

দেশে এ মুহূর্তে উদযাপিত হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখে বিগত আওয়ামী সরকারের পতনের পর ভিন্ন এক পরিবেশে এবারের পূজা উদযাপিত হচ্ছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের এবারের উৎসব উদযাপন অধিকতর আনন্দঘন করে তুলতে নির্বাহী আদেশে ১০ অক্টোবর ২০২৪ বৃহস্পতিবার এক দিন অতিরিক্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। এর ফলে সপ্তাহান্তের শুক্র ও শনিবারসহ ১৪ অক্টোবর রোববার বিজয়া দশমী উপলক্ষে নিয়মিত ছুটি মিলিয়ে টানা চার দিন ছুটি থাকছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনের পর দেশে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের উপর বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হামলার ঘটনা ঘটে। পরে দেখা গেছে, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে পতিত স্বৈরাচারের দোসররাই সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। অতীতেও দুর্গাপূজার সময় এ ধরনের তৎপরতার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টি করে কিছু কুচক্রী মহলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা দেখা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মাত্র দুই মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি সুস্থির হয়ে ওঠেনি। এ কারণে দুর্গাপূজার সময় যাতে কোনো অঘটন না ঘটে সে জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সজাগ দৃষ্টি রাখছে।

সতর্ক প্রহরার কারণে এখন পর্যন্ত পূজা উদযাপন সামগ্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ থাকলেও একটি ঘটনা চার দিকে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জেএমসেন হলে বৃহস্পতিবার পূজা উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় ‘চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি’ নামের একটি সংগঠন দু’টি গান পরিবেশন করে। গান দু’টি ছিল বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের বিখ্যাত বাউল সঙ্গীত ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এবং প্রিন্সিপাল চৌধুরী আবদুল হালিমের লেখা ‘শুধু মুসলমানের লাগি আসেনি কো ইসলাম’।

জানা গেছে, ওই সংগঠন মহানগর পূজা উদযাপন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সজল দত্তের আমন্ত্রণেই ওখানে যায়। পরিবেশনা শেষে সঙ্গীত পরিবেশনকারীরা তাদের দাওয়াত দানের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ দিতে এবং একইভাবে উপস্থাপককে সঙ্গীত পরিবেশনকারীদেরকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য সাধুবাদ জানাতে দেখা যায়। প্রথম গানটির ফোকাস ছিল হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি, আর দ্বিতীয় গানে ইসলামে সর্ব ধর্মের জন্য সাম্যের যে বিধান রয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে।

পুরো বিষয়টি আয়োজক ও পরিবেশকদের পারস্পরিক সম্মতি ও সৌহার্দ্যরে ভিত্তিতে ঘটে থাকলেও দর্শকদের একাংশ এটি ভালো চোখে দেখেননি। ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে অসন্তোষ প্রকাশ করা হতে থাকে। আলোচ্য সংগঠনটি জামায়াত ঘরানার এ ধারণার ভিত্তিতে জামায়াত-শিবিরের লোকজন পূজামণ্ডপে উঠে জোরজবরদস্তি ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করেছে বলেও প্রচারণা শুরু হয়ে যায়। শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনই নয়, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিকে অপছন্দ করেন এমন অনেককেও এই প্রচারণার পালে হাওয়া দিতে দেখা যায়। পরিস্থিতির যাতে অবনতি না হয় তজ্জন্য স্থানীয় প্রশাসন হস্তক্ষেপ করে। ইতোমধ্যে পুলিশ দু’জন সঙ্গীত পরিবেশনকারীকে আটক করেছে। তবে পূজা কমিটির পক্ষে তাদের দাওয়াত দিয়ে ওখানে যিনি নিয়ে যান সেই সজল দত্তের খোঁজ নেই।

ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পতিত স্বৈরাচার দেশে ও দেশের বাইরে প্রধান যে ন্যারেটিভটি দাঁড় করিয়েছিল সেটি হলো ইসলামী মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। এর দ্বারা তারা মূলত জামায়াত-শিবিরকে বুঝিয়ে থাকলেও বিএনপিকেও তাদের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে দেখানো হয়ে আসছিল। পশ্চিমাদের ইসলামভীতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এটি ছিল তাদের প্রধান অস্ত্র। এ দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী শক্তির ভারতবিরোধী অবস্থানের কারণে প্রতিবেশী দেশটিও পতিত শক্তিটিকে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় দেখতে চেয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনের পরও তাদের অনুসারীরা পশ্চিমাদের কাছে এ দেশের পটপরিবর্তনকে একটি ইসলামিস্ট অভ্যুত্থান হিসেবে দেখানোর জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনীতিকরা ও মিডিয়া দেশের সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনকে বিশ্বের কাছে একই ধারায় চিত্রায়িত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য, এভাবে যদি নতুন সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বকে বৈরী করে তোলা যায়।

সন্দেহ নেই, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন এই বাংলাদেশে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তি এখন অনেক শক্তিশালী অবস্থানে আছে। কিন্তু এর মানে ত এই নয় যে, এখানে আইএস বা তালেবান ধাঁচের কোনো শক্তির ক্ষমতায়ন হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার ও তাদের পৃষ্ঠপোষক ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ এ ধরনের একটি ন্যারেটিভ তৈরির যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা এখন পর্যন্ত সফল না হওয়ার প্রধান কারণ বিশ্বজুড়ে ড. ইউনূসের পরিচিতি। তিনি যে একজন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব তা সর্বজনবিদিত।

উপরন্তু তার নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা স্থান পেয়েছেন তারাও প্রায় সবাই একই চরিত্রের। দ্বিতীয় যে কারণে এখন পর্যন্ত এই ক‚টকৌশলটি সফল হয়নি তা হলো- এ ধরনের একটি ন্যারটিভ তৈরির চেষ্টা আগে থেকে চলে আসায় দেশের ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তি পটপরিবর্তনের পর শুরু থেকেই দেশে যেন কোনোরকম সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক ছিল।

নেতৃত্ব পর্যায়ে সতর্কতা ও সচেতনতা সত্তে¡ও সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের অনেকেই বিষয়টি ঠিক ওভাবে বুঝে উঠতে না পারাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ কারণে পূজামণ্ডপে ইসলামী ধাঁচের সঙ্গীত পরিবেশনের ঘটনাটি কি স্রেফ ব্যক্তিগত পর্যায়ের নির্দোষ হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির প্রকাশ, নাকি গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদ, সে প্রশ্ন এসেই যায়। ওরা বুঝেই করুক আর না বুঝেই করুক, ওই ঘটনা যে পতিত স্বৈরাচার ও তাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী পৃষ্ঠপোষকদের হাতে এ দেশের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নিবর্তনের গল্প ফাঁদার নতুন একটি হাতিয়ার তুলে দিলো সেটি তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে তারা যে এই অস্ত্রের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের জন্য কাছা মেরে নেমে পড়েছে সেটি তো বুঝাই যাচ্ছে। তবে, দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো- আন্দোলনের শরিক কিছু শক্তিকেও তাদের জামায়াত-শিবির ফোবিয়া থেকে এই প্রোপাগান্ডায় শরিক হয়ে পতিত স্বৈরাচার ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের পারপাস সার্ভ করতে দেখা যাচ্ছে।

এ দেশের সামগ্রিক স্থিতি ও প্রগতির জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সবসময় চাইবে এখানে অস্থিরতা ও বিভক্তি জিইয়ে রেখে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে। কাজেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে তারা ভবিষ্যতে বিভিন্ন কায়দায় এ ধরনের আরো ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা যে করবে না তা বলা মুশকিল। সুতরাং এ ব্যাপারে সবাইকে আরো সতর্ক এবং সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement