১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১, ৯ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

প্রাথমিক শিক্ষা, তাকিয়ে দেখা

- ফাইল ছবি

[বছর চল্লিশের ওয়াসারকফ আঠারো বছর পর স্কুলে ফিরে গিয়ে ছাত্রজীবনে দেয়া সমুদয় টিউশন ফি ফেরত চায়। তার যুক্তি, স্কুলে সে এমন কিছুই শিখতে পারেনি, যা দিয়ে জীবনে কিছু করা সম্ভব। এর দায় স্কুল আর স্কুলের শিক্ষকদের। হাঙ্গেরীয় নাট্যকার ফ্রিটজ করিন্থির নাটক রিফান্ড-এ এমন ঘটনা আছে]

করোনার সময়টি বাদ দিয়ে বিবেচনার কথা বলছি। বলছি যে, প্রতি বছর এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার ফলাফল দেখে কী কখনো ভেবেছেন, অকৃতকার্য হচ্ছে
কারা এবং কী তার কারণ? কয়েক বছর লক্ষ করার পর চেষ্টা করে জানলাম, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের নব্বই ভাগই গণিত আর ইংরেজিতে খারাপ করে। এটি সেই অর্থে কোনো পরিসংখ্যান নয়, তবে কতগুলো স্কুল থেকে নেয়া রেকর্ডদৃষ্টে বলা। এর মধ্যে গ্রাম ও শহর, দুই প্রান্তের স্কুল আছে। ছাত্রকালে শুনেছি, শহরের ছেলেমেয়েরা অঙ্কে ভালো নয়। গ্রামের ছেলেমেয়ে ইংরেজিতে দুর্বল। আমার দেখায় শহরের ছাত্রছাত্রী অঙ্কে দুর্বল, সেটি হুবহু মেলেনি, তবে ইংরেজিতে ভালো। আর গ্রামের ছাত্রছাত্রী অতীতে কী ছিল জানি না, তবে এখন ইংরেজি বা অঙ্ক, একটিতেও ব্যতিক্রম ছাড়া সমানতালে এগিয়ে নেই। কেন এমন হচ্ছে?

একদা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন দেখে ভালো লাগত না। পরে দেখলাম, ওখানে একটা কাজ হচ্ছে, ইংরেজিভীতির নিরাকরণ; যার প্রভাবটা হাইস্কুলে লক্ষণীয়। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় খাতের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা কী? ইংরেজি আর গণিতের যে-ভয় বাসা বাঁধে বালককালে- আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সেটা দূর করছে কী?

জেলা প্রশাসক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে বললেন, এত-শত প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নেয়া তো দুরূহ; সব কাজই যে আটকে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার বললেন, আস্থা রাখুন, হয়ে যাবে। পাঠক, শিক্ষায় অগ্রসরমান একটি জেলা। প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার মৌখিক বোর্ড। সে যায়, সে যায় না, সে কি যায়, সে কি যায় না; এরকম বাক্যের ইংরেজি বলা এবং এমনতর অন্য প্রশ্ন প্রার্থীদের জন্য। আর দশমিক থেকে সাধারণ ভগ্নাংশে এবং সাধারণ ভগ্নাংশ থেকে দশমিকে রূপান্তর কিংবা ভগ্নাংশের ছোট ছোট যোগ-বিয়োগ। এই রকমের ছোটখাটো প্রশ্ন। দশজনে একজনও পারছিল না। জেলা প্রশাসক প্রচণ্ড বিরক্ত, পারলে আমায় উঠিয়ে দেন বোর্ড থেকে। ডিপিও বিব্রতÑ দুই কারণে; এক, উঠিয়ে দিলে এই পরীক্ষা শেষ করা কঠিন হবে। দুই, প্রার্থীরা এইসব সাধারণ প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছে না। বোর্ডের সভাপতি রেগে বললেন, করছেন কী, এরা কমপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক পাস, অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েট এবং স্নাতকোত্তর আর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। বললেন, এ তো বাচ্চাদের প্রশ্ন। বললাম, একটু ধৈর্য ধরুন, দেখুন, স্যার। জনাবিশেকের মধ্যে দু’জনও যখন এই বাচ্চাদের প্রশ্নই পারছিল না, তখন বোর্ডের প্রধান মাথায় হাত দিলেন। বললেন, এতটা খারাপ অবস্থা? জি, মহোদয়। আপনি শেষ কবে স্কুলে গিয়েছেন জানি না, কিন্তু আমি এক-রকমের প্রতি সপ্তাহেই স্কুলে যাই। ততক্ষণে আমার অফিস কক্ষ থেকে থ্রি-ফোর-ফাইভের গণিত ও ইংরেজির বই চলে এসেছে; জেলা প্রশাসকের সামনে মেলে ধরলাম, বললাম, চাকরি পেলে এসবই তাদের শেখাতে হবে কোমলমতি শিশুদের। জেলা প্রশাসক মৌখিক পরীক্ষার ক’দিনে এক-রকমের চুপই ছিলেন। বুঝলাম, ইঞ্জিনিয়ার, ভালো ছাত্র ছিলেন। নিজের সন্তান ইংরেজি স্কুলে পড়ছে। মানলাম, এই দৃশ্যে তিনি কষ্ট পেয়েছেন।

এর চেয়েও খারাপ পেয়েছি উত্তরের একটি হাওর জেলায়। এখানে বলতে হবে, প্রাথমিকের শূন্যপদ পূরণ করা যাচ্ছিল না ইপ্সিত সংখ্যায় লিখিত পরীক্ষায় পাস করছে না বলে। প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার পাস নম্বর হ্রাস করা হয়েছে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসকদ্বয়ের বারবার অনুরোধের পর। বর্তমান যে নম্বরে পাস করে মৌখিক পরীক্ষায় উতরে যাওয়া যায় সেটি এক-সময় পঞ্চাশ ছিল। সুনামগঞ্জে একটা অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়েও বাংলাদেশের বাংলায় ছেলেমেয়েদের শেখানো হয় না।

ইউনিসেফের অনুষ্ঠানে ফাইভে পড়ুয়া একটি মেয়ের (বাইরে থেকে আসা) অভিযোগ থেকে এটি জানা যায়। এমনটি অন্যত্রও থাকতে পারে। প্রাথমিকের কর্তাব্যক্তিদের এই ধারণা না থাকার কথা নয়। কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি?

সুযোগ হয়েছিল রাজশাহী ও রাজশাহীর শহরতলি, সিলেট ও সিলেটের শহরতলি, যশোর ও যশোরের শহরতলি, রংপুর ও রংপুরের শহরতলি, খুলনা শহর, বরিশাল শহর ও শহরতলি, টাঙ্গাইল ও চুয়াডাঙ্গার সমগ্র জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখার। বরাবরই প্রাথমিক শিক্ষা আগ্রহের বিষয়। কিন্তু কী দেখেছি?

থ্রি-ফোর-ফাইভের চিত্র; নিচের দিকে বড় বেশি দেখার দরকার নেই। তবে প্রাক-প্রাথমিকের শ্রেণীকক্ষের সাজসজ্জার একটা ব্যাপার আছে, সেসবও দেখতে হয়। দেখেছি কেবল ইংরেজি আর গণিত। তর্ক করতে রাজি আছি যে, এই তিন শ্রেণীতে কেবল গণিত আর ইংরেজিটুকু শিখিয়ে দিলেই হয়; সাথে বাংলা লিখতে-পড়তে জানা। তাহলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে বিন্দুবিসর্গ সমস্যা দেখা দেবে না। বিজ্ঞান-সমাজ-ধর্ম; বলছি, নবম শ্রেণীতে শুরু হলে জাতির কোনো ক্ষতি হবে না।

বছরের মাঝামাঝি সময়ে, জানা আছে এই সময়ে বইয়ের কতটুকু শেষে করবার কথাÑ ইংরেজি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে দশটি শব্দ অর্থসহ লিখতে দিয়ে দেখেছি; এক থেকে দশটি ঠিকমতো লিখতে পেরেছে এমন একটি স্কুলও পাওয়া যায়নি। অর্থসহ পাঁচটি পেরেছে এমন স্কুলও পাওয়া যায়নি। স্কুলগুলোর অবস্থান উপরে বলেছি। প্রতিটিতে সাথে হয় ডিপিইও, নয় উপজেলা শিক্ষা অফিসার ছিলেন। ছিলেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক। একই চিত্র পরের চতুর্থ আর পঞ্চম শ্রেণীতেও। ছাত্রছাত্রী কমবেশি তিরিশ। গণিতেও ভিন্ন চিত্র মেলেনি। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে ভগ্নাংশ আর দশমিকের পঠন শেষ করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে এসব ব্যবহার করে নানা অঙ্ক করতে হয়। কিন্তু তিরিশজন ছেলেমেয়ের পাঁচজনও সঠিক ধারণা নিয়ে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুতে পারছে না। প্রশ্ন ছিল, একটি অধ্যায় তিরিশজনের পাঁচজনও শিখল না, তাহলে পরের অধ্যায়ে যান কী করে? জবাব পাওয়া যায়নি। মুখ শুকিয়ে এসেছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের। হাঁ করে তাকিয়ে ছিল প্রায় সব স্কুলে।

আপনার জানা থাকার কথা, পাঠ্যক্রম কিভাবে করা হয়। তৃতীয় শ্রেণীর বইয়ে যে ক’খান ইংরেজি শব্দ থাকবে, সেসব শব্দ চতুর্থ শ্রেণীর বইয়েও থাকবে। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণীতে যুক্ত হবে আরো কিছু নতুন ইংরেজি শব্দ। এসবের অর্থ আর ব্যবহার। কিন্তু প্রথম পৃষ্ঠার শব্দ লিখতেই পারছে না। অর্থ আর ব্যবহার তো দূর-অস্ত। গণিতও তাই। এই অধ্যায় না পারলে পরের অধ্যায়ে আটকে যেতেই হবে। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণীর গণিত না বুঝলে চলবে কেন! তো এসএসসিতে ইংরেজি আর গণিতে বেশি সংখ্যায় অকৃতকার্য না হওয়ার কী কী কারণ অবশিষ্ট আছে, বলবেন কেউ?

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা তুলনায় সর্ববৃহৎ। সারা দেশে এই সেক্টরের যতটি পাকা ভবন আছে, তা আর দশটি মন্ত্রণালয়েরও নেই। শিক্ষকের সংখ্যাই সাড়ে তিন লাখ। পঁয়ষট্টি হাজার বিদ্যালয়। বাষট্টি-তেষট্টিটি ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান। উপজেলায় দু’টি করে অফিস। সেই অর্থে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর সরকার মনোযোগ দিচ্ছে কি!
তিন-চারজন শিক্ষকের তেইশ-চব্বিশ হাজার রেজিস্টার্ড বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে। এটি সরকারের একটি সাহসী ও যুগান্তরকারী পদক্ষেপ বলেই মান্যতা দিই। কিন্তু সেই বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকের মান জানা থাকলেও শিক্ষক সমন্বয় এখনো হয়নি। দেখেছি, একটি স্কুলে গণিতের বা ইংরেজির দু’জন শিক্ষক আছেন। কিন্তু দেড়-দুই কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে ইংরেজি বা গণিত শেখানোর একজনও নেই। প্রয়োজনীয় সমন্বয় হচ্ছে কি? ফলে খুব সংখ্যক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই ছেলেমেয়েদের ইংরেজি ও গণিতের দুর্বলতা দূর করতে সক্ষম হচ্ছে। উচ্চবিদ্যালয়গুলো জানে, প্রাথমিকের এই দুর্বলতা নিয়ে এসেছে। তারাও শুরু করবে ষষ্ঠ শ্রেণীর বই দিয়ে। একটি স্কুলের সভাপতি থাকাকালে এই অবস্থা দেখে ষষ্ঠ শ্রেণীতে দুই-তিন মাস থ্রি-ফোর-ফাইভের অঙ্ক-ইংরেজি পড়াতে বাধ্য করে ভালো ফল পেয়েছি এবং ভালো পড়ান যারা, তাদেরকে দিয়েই সিক্সে শুরু করিয়েছি। আমাদের দেখা, যিনি ভালো পড়ান, তিনি নবম-দশম শ্রেণীতে ক্লাস নেন। এটি ভুল। নিচের ক্লাসের দুর্বলতা উপরের দিকে ভালো শিক্ষকের দ্বারা দূর করা যায় না।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহস্র শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণ নিয়মিত প্রক্রিয়া; পড়ানোর মতো সক্ষমতা নিয়ে কতজন আসছে? অথচ এদের হাতেই গোটা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। এই সেক্টরে নানা সমস্যাও আছে। সহকারী শিক্ষকের বেতনকাঠামো, পদোন্নতি, নতুন পদসৃষ্টি, বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ওপরের পদে নিয়ে আসা-সমস্যা অনেক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য আলাদা নির্মাণ অধিদফতর, বিভাগে পরিচালকের পদ সৃজন কিংবা আলাদা কারিকুলাম বোর্ড, শিক্ষা বোর্ড এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে ভিন্ন অধিদফতর হওয়া; সবটাই যুক্তিগ্রাহ্য। হয়তো হয়েও যাবে। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে কথা হচ্ছে না কেন? পিইডিপি-১-২-৩ এর অধীনে হরেক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ফলটা কী? ওই গণিত আর ইংরেজির অবস্থার পরিবর্তন কতটা হয়েছে?

শ্রেণীকক্ষের ওই পরিদর্শন বছর দশেক আগের। আমার দেখা বদলে গেছে কি! এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখলে নেমে পড়ি; আমি কিন্তু ইংরেজি-গণিতের অগ্রগতি দেখছিনে। কিছু কিছু স্কুল থাকতেই পারে। বলছি, জানাবেন, খুব দূরে না হলে নিজ খরচে দেখে আসতে চাই; সাথে ওই শিক্ষা পরিবারের যে কেউ থাকতে পারেন।

বলছি, সরকারি প্রাথমিকের তো এই অবস্থা- মাধ্যমিক এবং আরো ওপরের অবস্থা কী? খুব ভালো কিছু ঠাহর হচ্ছে না। এখন আবার বিশ^বিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখছি, দেখছি, একদম নিকট থেকে। অতটা বিদ্যা নেই, কিন্তু অবস্থা যে মোটেই ভালো না, সেটা মনে হয় বুঝতে পারি। আগামীতে এই নিয়ে আলোচনা হতেই পারে-সমস্যা হলো, লজ্জা লুকানো কঠিনই হবে সেক্ষেত্রে।

লেখক : সাবেক অতিরিক্ত সচিব


আরো সংবাদ



premium cement