১৪ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ট্রাস্ট আইন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

- প্রতীকী ছবি

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ট্রাস্ট আইন একটি পুরনো এবং জটিল আইন। ট্রাস্ট আইন প্রণয়নে ২০১৭ সালে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে চেয়ারম্যান করে অধ্যাপক ড. শাহ আলম এবং বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরকে সদস্য করে গঠিত আইন কমিশনের সুপারিশ ও বিলের খসড়া প্রস্তাবনাতে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে প্রচলিত ট্রাস্টসংক্রান্ত মূল আইনটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট-১৮৮২ প্রায় ১৩৫ বছরের পুরনো। সামান্য কিছু সংশোধনসহ ওই আইনটিই প্রাইভেট বা ব্যক্তি উদ্যোগমূলক ট্রাস্ট সৃষ্টি ও পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিচালিত। অন্য দিকে সরকারি ও জনকল্যাণমূলক ট্রাস্ট গঠন ও পরিচালনার জন্য একক কোনো বিশেষ আইন নেই।

কমিশনের সুপারিশ বলা হয়েছে, ট্রাস্ট আইন-১৮৮২ ট্রাস্টের বিষয়ে সরকারি ও জনকল্যাণমূলক তেমন কোনো সুস্পষ্ট বিধানের উল্লেখ না থাকায় সরকারি অর্থে জনকল্যাণমূলক ট্রাস্ট গঠন করতে প্রতিটির জন্য পৃথক আইন প্রণয়ন করতে হয়। যার ফলে, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশে সৃষ্ট ১৫টি পাবলিক ট্রাস্টের তালিকা পাওয়া যায়। যা ভিন্ন ভিন্ন ট্রাস্টের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন হিসেবে প্রণয়ন করা হয়েছে। কমিশনের মতে, উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের পূর্ব থেকে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে বিভিন্ন প্রকার ট্রাস্টের ব্যবহার আছে। অস্পষ্টতার কারণে বা আইন না বোঝার কারণে বেসরকারি ট্রাস্টের ক্ষেত্রে প্রায়ই পক্ষগণের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয় যা নিষ্পত্তির জন্য দেওয়ানি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে মামলার জটিলতা সৃষ্টি হয় যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং হয়রানিমূলক প্রক্রিয়া। ফলে পক্ষগণ ট্রাস্টের যথাযথ সুবিধাভোগ করতে পারে না। ফলে ট্রাস্ট গঠন ভালো উদ্যোগ হলেও অনেকেই জটিলতার কারণে নিরুৎসাহিত বোধ করেন। তাই গঠিত আইন কমিশনের সুপারিশ ও বিলের খসড়া প্রস্তাবনায় ব্যক্তি উদ্যোগ ট্রাস্টকে যুগোপযোগী এবং সর্বজনিক বা সরকারি ও জনকল্যাণমূলক ট্রাস্ট আইন- এই তিনটিকে আলাদা প্রবর্তন করার প্রস্তাব রয়েছে। এতে যেকোনো প্রকার ট্রাস্ট গঠন ও পরিচালনা-সংক্রান্ত অনেক জটিলতার অবসান এবং একই সাথে ব্যক্তিগত, সরকারি ও জনকল্যাণমূলক ট্রাস্ট আইনের অনেক অসামঞ্জস্যতাও দূর হবে।

বর্তমানে ১৮৮২ সালের আইনটি নিজের বা অন্যের উপকারার্থে কোনো সম্পত্তির দায়িত্ব অন্যের উপর ন্যস্ত করা এবং সম্পত্তির মালিক বা যে ট্রাস্ট সৃষ্টি করে তাকে আস্থা স্থাপনকারী বা ট্রাস্ট প্রবর্তক বলা হয়েছে। ট্রাস্ট গঠন করা হয় সাধারণত সম্পত্তি হস্তান্তর ও উত্তরাধিকার আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ১৫ ধারাতে বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড অব ট্রাস্ট থাকবে এবং ওই বোর্ডের সদস্যদের একজন সদস্য বোর্ড অব ট্রাস্টের সভাপতি হবেন।’ এ ছাড়া আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ‘বোর্ড অব ট্রাস্টের ক্ষমতা ও দায়িত্ব’ দেয়া আছে। ইউজিসির অফিস আদেশে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের লক্ষ্যে বোর্ড অব ট্রাস্টের কোনো সদস্যের নাম তিন জনের প্যানেলে প্রস্তাব করা যাবে না এবং বোর্ড অব ট্রাস্টের কোনো সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লিখিত তিন পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না। ৬(১) ধারাতে বলা হয়েছে- ‘সাময়িক অনুমতির জন্য প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার উদ্দেশ্যে অনধিক ২১ কিন্তু অন্যূন ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠন করতে হবে।’ তার মানে ২১ জন সবাই বোর্ড সদস্য (?) আইনের কোথাও ট্রাস্ট কিভাবে গঠিত হবে বলা না হলেও ট্রাস্ট আইন অনুযায়ীই নিবন্ধন করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-২০১০-এ ট্রাস্ট গঠন প্রক্রিয়া না থাকায় বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী বোর্ড অব ট্রাস্ট গঠন করে ট্রাস্ট অ্যাক্ট-১৮৮২ অধীনে চুক্তি বদ্ধ হয়ে ১৮৬০ সোসাইটি অ্যাক্ট অনুযায়ী জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধন নিতে হয় এবং সাব রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-২০১০-এর কোথাও উল্লেখ নেই। যে কারণে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ট্রাস্টের কাঠামো এবং তার পদসমূহ মানতে চান না। ট্রাস্ট শব্দের অর্থ- আস্থা, নির্ভরশীলতা, বিশ্বাস। কোনো তৃতীয় ব্যক্তির বা পক্ষের কল্যাণের জন্য যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির বরাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করে তাহলে তা জিম্মা বা ট্রাস্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। ট্রাস্ট তিনটি পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি অর্থাৎ- ১. দাতা বা ট্রাস্ট সৃষ্টিকারী : যিনি তার সম্পত্তি কোনো ভালো বা অসহায়দের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে তার সম্পত্তির কিছু অংশ একজন বা কাউকে বিশ্বাস করে তৃতীয় পক্ষের উপকার করার জন্য বিশ্বাস করে দান করেন তাকে বলা হয় ট্রাস্টকারী। ২. ট্রাস্টি : তিনি বা তারা যাকে বিশ্বাস করে সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন তাকে বলা হয় ট্রাস্টি এবং ৩. সুবিধাভোগী : যারা ওই সম্পত্তির থেকে তাদের লাভ বা উপকার পাবে তাদের বলা হয় সুবিধাভোগী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুবিধাভোগী কে বা কারা? শিক্ষার্থীরা সুবিধাভোগী নয়, শিক্ষার্থীরা যে সার্ভিস পায় তার জন্য ফি দেন। যার ফলে, ট্রাস্ট আইন-১৮৮২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অস্পষ্ট। যারা একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট হিসেবে স্থাপন করতে চান, তারা জানেন ট্রাস্ট চালানো কোনো সহজ বা চাপমুক্ত কাজ নয়। একটি ট্রাস্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য যথেষ্ট সময় এবং পরিশ্রম বিনিয়োগ করার জন্য একজন ট্রাস্টির প্রয়োজন। একটি ট্রাস্ট যেভাবেই নিবন্ধিত হোক না কেন, ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী একজন ট্রাস্টির ট্রাস্ট-সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য সাধারণত পারিশ্রমিক পাবেন না, যদি সব ট্রাস্টি একমত হন তাহলে ভিন্ন কথা। তবে বিভিন্ন দেশে ট্রাস্ট সুরক্ষার জন্য পেশাদার ট্রাস্টিদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায় এবং পেশাদার ট্রাস্টিদের অর্থ প্রদানের ধারণা এখন অনেক বেশি বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। বর্তমান আইনে, পেশাদার ট্রাস্টিদের বা একজন ট্রাস্টি যদি ট্রাস্টের বাইরে অন্য কোনো পদে কাজ করেন, তার কোনো নির্দেশনা নেই। তাদের মেধার জন্য পারিশ্রমিক দেয়া না দেয়ার কথাও বলা নেই। ট্রাস্ট সুরক্ষা এবং ট্রাস্টের কাজের বাইরে ট্রাস্টের অন্য পদের কাজের জন্য পেশাদার ট্রাস্টিদের তাদের মেধার জন্য অর্থ প্রদান বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। ট্রাস্ট অ্যাক্ট-১৮৮২-তে ৫০ ধারায় যা বলা আছে তা কেবল ট্রাস্ট-সম্পর্কিত। একজন ট্রাস্টির তার ঝামেলা, দক্ষতা ও ট্রাস্ট কার্যকর করার সময় নষ্ট হওয়ার জন্য পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার নেই। এখানে ট্রাস্টের বাইরে পদের কথা বলা হয়নি। অথচ ৫০ ধারা সঠিকভাবে না বুঝে নিজস্ব অনুমান ও মতামতের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

সময়ের দাবি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্ট পরিচালনার জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা। অন্যথায় সমস্যা লেগেই থাকবে। সুস্পষ্ট লক্ষ ও উদ্দেশ্যে শিক্ষা অনুরাগীরা তাদের মেধা দিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, অর্থ প্রদান করেন, দায়-দায়িত্ব নিয়ে সার্বক্ষণিক সময়ও দেন। কিন্তু তারা ট্রাস্ট সুরক্ষার জন্য এবং ট্রাস্ট পরিচালনার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের পেশাদারিত্বের প্রয়োগ করতে সার্বক্ষণিক সময় দিতে পারবেন না, তা কিন্তু আইনে নেই। উদ্যোক্তা যদি শিক্ষার বিস্তারে ভ‚মিকা রাখতে না পারেন, তারা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কে কিভাবে বাস্তবায়িত করবেন! বেসরকারি উদ্যোক্তারা কেন এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবেন? এতে বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষার বিস্তার বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারক-বাহক ট্রাস্ট। শুধু আইন দিয়ে যদি প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চলত তাহলে আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এত সংবাদ প্রচারমাধ্যমে আসত না। শিক্ষা প্রসারের জন্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। দুর্নীতি রোধ করার জন্য উদ্যোগ এবং মেধাকে চাপিয়ে না রেখে যথাযথ আইনের এবং ইতিবাচক আচরণের মাধ্যমেই ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।

দেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে আসেন ট্রাস্টিরা। সরকারি আর বেসরকারির মধ্যে পার্থক্য কেবল অর্থায়নে। একটিতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আর অপরটিতে সরকার অর্থায়ন করে। এ ছাড়া আর সবই একই। তবে অনিয়মের কথা বলে কোনো সংস্থার নিয়ন্ত্রণ হলে তা হবে দুঃখজনক। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আর হাইস্কুলের কোনো পার্থক্য থাকবে না। সরকার যদি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ ব্যয়ের দায়িত্বও সরকারের নেয়া উচিত।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা ট্রাস্ট আইন করলে দেশের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা সঙ্কীর্ণতার হাত থেকে রেহাই পাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান পরিস্থিতি তদারকি করে একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত এবং স্বচ্ছ পরিচালনা পরিষদ বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টিজের ক্ষমতা, অধিকার, সম্মান, যথাযথ না হলে এক সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘বোঝা হয়ে দাঁড়াবে’। আস্থা হারিয়ে অর্থ সঙ্কটে পড়বে। যার কিছু লক্ষণ এখনই দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা ট্রাস্ট আইন না হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সক্ষমতা গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করা কঠিন হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি


আরো সংবাদ



premium cement