১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ৬ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ডক্টর ইউনূসের রিসেট বাটন ও আওয়ামী লীগের গাত্রদাহ!

ড. ইউনূস - ছবি : সংগৃহীত

গত ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে একটি মন্তব্য করেছেন, যা নিয়ে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা চলছে। এ নিয়ে আওয়ামী উচ্ছিষ্টভোগীদের অভিযোগের অন্ত নেই। কেউ বলছেন ইউনূস সাহেবের নিয়োগ সংবিধান অনুযায়ী অবৈধ, কেউ বলছেন ইউনূস সাহেবের মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান নেই। বিস্তর অভিযোগ। এর পরদিন ২৭ সেপ্টেম্বর ভয়েস অব আমেরিকার সাথে আরেকটি সাক্ষাৎকারেও তিনি একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। কী তিনি বলেছিলেন সেই দুই দিনের সাক্ষাৎকারে?
আমেরিকায় অনুষ্ঠিত সেই সাক্ষাৎকারে উপস্থাপিকা ডক্টর ইউনূসকে প্রশ্ন করেন, একটি সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। এখন তিনি কিভাবে তার আরব্ধ কাজ শুরু করবেন। উত্তরে ডক্টর ইউনূস জানান, ছাত্র-জনতা এই গণ অভুত্থানের মাধ্যমে একটি রিসেট বাটনে চাপ দিয়েছে। এখন আর অতীতের বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার বা এ নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এখন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে, নতুনভাবে।

এই কথাটির মধ্যে এমন কী আছে যা আওয়ামী লীগারদের এত অসহিষ্ণু করে তুলেছে? অনেকে বলছে যে, ডক্টর ইউনূস কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে রিসেট করতে পারবেন। সমস্যা হলো- এই মানুষেরা খুবই অস্থির প্রকৃতির। তারা ইন্টারভিউটা সম্পূর্ণ শুনেছেন এমন মনে হচ্ছে না; কিংবা তারা বিতর্ক সৃষ্টির জন্যই এই বিতর্ক করছেন। কারণ সাক্ষাৎকারটি মন দিয়ে শুনলে তারা লক্ষ করতেন, ডক্টর ইউনূস ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা উচ্চারণ করেছেন, পাকিস্তান নয়। তার বক্তব্য শুনলে মনে হয় তিনি এমন একটি অবস্থা থেকে শুরু করতে চান, যে সময়ে বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে এবং দেশে একটি ঐকমত্য রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যে কাজগুলো করা উচিত ছিল (কিন্তু করা হয়নি), সেই কাজগুলো দিয়ে শুরু করে তিনি আমাদের এই দেশকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করতে চান। তিনি স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে যেসব নিবর্তনমূলক ও গণস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেসব দিকেই তিনি তার অঙ্গুলি তুলেছেন এবং বলেছেন ওই দিকে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগারদের সমস্যাটি সম্ভবত এখানেই।

রিসেট শব্দটা মূলত কম্পিউটারের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই বাটনটি ইমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে কম্পিউটারকে আবার আগের অবস্থায় (ফ্যাক্টরি সেটিং বলা যেতে পারে) নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপা হয়। যখন কোনো কম্পিউটার তাকে দেয়া কাজগুলো যথাযথভাবে করে না বা করতে ব্যর্থ হয়, যাকে কম্পিউটারের ভাষায় ‘হ্যাং’ হয়ে যাওয়া বলে, তখন এই বাটনটি কাজে আসে। এই সমস্যাটি সাধারণত ঘটে যখন কোনো কম্পিউটারকে খারাপ বা পরস্পরবিরোধী কমান্ড দেয়া হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই ঘটনাটিই ঘটেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যখন শেখ মুজিব দেশ পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নিলেন, তখন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অসচেতন থেকেই চিরাচরিত পন্থায় রাষ্ট্রপরিচালনার কাজটি শুরু করলেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে একটি নব্য স্বাধীন দেশের জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেই। সে সময়ে বাংলাদেশে ভারতের উপ-হাইকমিশনার ও পরবর্তীতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জে এন দীক্ষিতের ভাষ্যমতে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাযুদ্ধকালে দেশে অনুপস্থিত থাকার কারণে সবসময় হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। সে জন্য তিনি কখনো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কথা শুনতে আগ্রহী ছিলেন না। একই বিষয় তাজউদ্দিন আহমদসহ মুক্তিযুদ্ধের অন্য নায়কদের ভাষ্য থেকেও জানা যায়। এমনকি তার নামে নামকরণ করা মুজিবনগরেও (মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথপুর গ্রাম) তিনি কোনো দিন যাননি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার শপথগ্রহণ করেছিল।

তিনি ক্ষমতায় এসেই মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কহীন পাকিস্তান অনুগত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন শুরু করেন। তিনি এমনকি দণ্ডিত দালালদেরও মুক্ত করে তার সাথে বিদেশ সফরে নিয়ে গেছেন। তার আমলেই পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আত্মীকরণ করে নবসৃষ্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অস্থিরতার জন্ম দেয়া হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে অসংখ্য সেনা বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। তিনি ক্ষমতা সংহত করার পর স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বেশ কয়েকজনকে (তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল ওসমানীসহ) তার মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন। এসব ঘটনা ছিল গণপ্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলোকে পাল্টে দিয়ে এ দেশের মানুষের আকাক্সক্ষার বিপরীতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিতর্কিত বিষয়কে দেশের মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। বস্তুত আমাদের সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের চার মূলনীতি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর দেশ পরিচালনার ঘোষিত মূলনীতির নকল, যেমনটি তার অনুসারীদের দেয়া উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’ও (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুকরণে) নকল।

শেখ মুজিবের শাসনামলেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়। চোরাচালান ও মজুদদারির কারণে ১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়, যাতে দেশের প্রায় ১.২৫ লাখ (মতান্তরে ১০ লাখ) মানুষ মৃত্যুবরণ করে। যে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু, তিনি সেই গণতন্ত্রকেই কবর দিয়ে দেশে ‘বাকশাল’ নামক একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেন। দেশে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয় শেখ মুজিবের শাসনামলেই। তার শাসনামলেই দেশে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য তিনি ‘রক্ষীবাহিনী’ নামে এক খুনি বাহিনী সৃষ্টি করেন, তার মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে যারা প্রায় ৩০ হাজার জাসদ ও সর্বহারা পার্টি কর্মী-সমর্থক প্রতিবাদী তরুণকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। প্রশাসনিক অদক্ষতা, স্বজনতোষণ ও দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতাই তার বিয়োগান্তক পরিণতির কারণ বলে মনে করেন J N Dixit, যা তিনি তার Liberation and Beyond : Indo-Bangladesh Relations শীর্ষক বইয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।


ফিরে আসি ডক্টর ইউনূসের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে। ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি ডক্টর ইউনূসের কাছে জানতে চান ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের শেখ মুজিবের বাড়ি (যা পরবর্তীতে জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছিল) বিনষ্ট করা এবং দেশজুড়ে শেখ মুজিবের মূর্তি ও ম্যুরাল ভেঙে দেয়া প্রসঙ্গে। এ বিষয়ে প্রফেসর ইউনূস আগেই অপর এক সাক্ষাৎকারে পরামর্শ দিয়েছিলেন, এ বিষয়ে শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করতে। ‘তিনি কী করেছেন যে, এ দেশের মানুষ তার পিতার মূর্তি ও ম্যুরাল ভেঙে ফেলল?’ খুবই চমৎকার জবাব ছিল এটি। এবার অবশ্য ডক্টর ইউনূস এ বিষয়টিকে পুরনো দিনের কথা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হওয়া উচিত এই গণ অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থানে যেসব সম্ভাবনাময় তরুণের প্রাণ ঝরে গেছে, তাদেরকে কেন্দ্র করে। তিনি আরো বলেন, এখন তার সরকার এই গণ অভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মর্মান্তিক পরিণতির পরে কিন্তু তার বাসভবন আক্রান্ত হয়নি এবং তার মৃত্যুর ২১ বছরের মধ্যে তার অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের মানুষ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। সবাই বিষয়টিকে অতীত মনে করে তাকে শান্তিতে থাকতে দিয়েছে। কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা যা করেছেন এবং করতে চেয়েছেন, তাতে গণমানুষের ক্ষোভ এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, এ দেশের মানুষ শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচারের প্রতিভ‚ হিসেবে দেখেছে। ফলে, এবার হাসিনার পতনের পর ছাত্র-জনতা শেখ মুজিব বা হাসিনা-সংশ্লিষ্ট যা কিছু সামনে পেয়েছে, তাকেই ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। তার পরও মাত্র ৩৬ দিনে ১৬০০ তরুণের জীবন ও অসংখ্য মানুষের দীর্ঘ দিনের ত্যাগের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতন ও লজ্জাজনক পলায়নের পর যেটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা তুলনামূলক বিচারে কোনো ক্ষতিই নয়। আর মূর্তি বা ম্যুরাল ইত্যাদি তো সরকারি অর্থেই নির্মিত, যা দেশের দরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যয় না করে এরকম একটি অনুৎপাদনশীল কাজে অবৈধভাবে ব্যয় করা হয়েছে। শেখ মুজিবকে কাল্ট ফিগারে পরিণত করার যে বাসনা শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন, তা ব্যাকফায়ার করার কারণেই এ অবস্থা।

এ কারণে ডক্টর ইউনূস রিসেট বাটন চাপ দেয়া নিয়ে যা বলেছেন, তা তার উদারতার পরিচয়। আমরা দেখেছি, গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের নেতারা শুধু বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বের দোষ খুঁজেছেন এবং সেই কল্পিত দোষের বর্ণনা দিয়ে দিয়ে দেশের মানুষের কান ঝালাপালা করে ছেড়েছেন। শেখ হাসিনা, তার আত্মীয়স্বজন ও দলীয় লোকজনের গণহত্যা, গুম, চুরি ও অর্থপাচারসহ অন্যান্য দুষ্কর্ম তো খোঁজার কিছু নেই, এগুলো একদম জাজ্বল্যমান। এর পরও সেই নিকট অতীত নিয়েও ঘাটাঘাটি না করে ডক্টর ইউনূস ‘রিসেট বাটন চাপা’র রূপক ব্যবহার করে আমাদের অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলোকে ভুলে গিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, তা আমাদের সম্মিলিত স্বপ্নে রূপান্তরিত হলে দেশটি প্রকৃতই অনেক দূর এগিয়ে যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনা বা স্বৈরাচারী আওয়ামী নেতৃত্ব তো সেটি চায় না। তারা এই দেশটিকে প্রতিবেশী দেশের একটি করদরাজ্য হিসেবেই দেখতে চায়। কিন্তু তা আজ আর সম্ভব নয়। কারণ দেশের মানুষ এখন ভয়কে জয় করতে শিখেছে। সে কারণে সব জায়গায় ভুলত্রুটি খোঁজার নামে সরকার বিরোধিতা করলে আখেরে তাদেরই ক্ষতি হবে এবং আওয়ামী দাসেরা যত দ্রুত এটি অনুধাবন করবে, তাদের জন্য ততই মঙ্গল।


লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement