ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজার
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২১:৩২
লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে নিত্যপণ্যের বাজারদর। নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণীর ভোক্তা অস্বস্তিতে আছেন।
প্রতিদিন কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন ভোক্তা সাধারণ। আগস্টের শুরুতে অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন ও কাঁচাবাজারগুলোতে চাঁদাবাজি অনেকটা কমে আসে।
এতে ভোক্তারা ভেবেছিলেন, নিত্যপণ্যের দাম হয়তো কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আসবে। কিন্তু পণ্যের দাম না কমে উল্টো বেড়েছে। চাল, মাছ, গোশত, ডিম ও সবজিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের মধ্যে থাকছে না। জুলাই থেকে অক্টোবরে বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম অনেকটাই বেড়েছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্র্বর্তী সরকার এরই মধ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে, আমদানি শুল্ক কমিয়ে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সরকারের চেষ্টা থাকলেও তা খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না। অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে ভোক্তাদের আহ্বান বাজারে দ্রুত স্বস্তি ফেরানো হোক। বৃষ্টি ও বন্যার কারণে সরবরাহ সঙ্কটের অজুহাত দেখিয়ে বাজারে সব ধরনের সবজির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে কেজিতে ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। সবজির এই বাড়তি দামের কারণে সাধারণ মানুষ আমিষের দিকে ঝুঁকছে। এতে ডিম ও মুরগির ওপর বাড়তি চাপ পড়ায় বেড়ে গেছে এই দু’টি পণ্যের দামও। তবে ভোক্তারা এ ধরনের অজুহাত মানতে নারাজ। তারা মনে করেন, অন্তর্র্বর্তী সরকার সড়কে চাঁদাবাজি কমিয়ে আনলেও এখনো বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। নানা অজুহাত দেখিয়ে বাজার সিন্ডিকেট চাল, সবজি, ডিম ও মুরগির দাম বাড়াচ্ছে।
বিগত স্বৈরাচারী সরকারের দোসরদের কারসাজির কারণে এবং বাজারে প্রয়োজনীয় তদারকি না থাকার সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) জুলাই ও অক্টোবর মাসের বাজারদর পর্যালোচনা ও রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা ও মহাখালী কাঁচাবাজারের দর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত জুলাইয়ের তুলনায় অক্টোবরের খুচরা পর্যায়ে মোটা চাল ব্রি-২৮ ও পাইজাম প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১১ শতাংশ দাম বেড়ে মানভেদে ৬০ থেকে ৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিম ১৩ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে ৯ থেকে ১৬ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকায় উঠেছে। কিছু দিন আগে বন্যার পর বাজারে মাছের সরবরাহ থাকলেও ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে মাঝারি রুই মাছ প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এখন সব ধরনের সবজির দাম চড়া। গত জুলাই মাসের তুলনায় অক্টোবরে মানভেদে প্রতি কেজি বেগুন ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচের দামও ৩৩ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে ঢেঁড়স, করলা, চিচিঙ্গা, কাকরুল ও বরবটির মতো সবজিও এখন ৮০ থেকে ১০০ টাকার নিচে মিলছে না। কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতাদের ভাষ্যমতে- ‘পাইকারি বাজারে আগের তুলনায় কম সবজি আসছে। যার কারণে বেশি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে। যার প্রভাব খুচরা বাজারে পড়ছে।
এ দিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ১৬ সেপ্টেম্বর অন্তর্র্বর্তী সরকার ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দেয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বেঁধে দেয়া দামের সুফল পাচ্ছে না ভোক্তা সাধারণ। খুচরা পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি ডজন ডিম ২৮ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। সরকারের বেঁধে দেয়া দাম প্রতি ডজন ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। অথচ বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। যদিও এক সপ্তাহ আগে প্রতি ডজন ডিম ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
নিম্ন আয় ও স্বল্প আয়ের পরিবারে প্রাণীজ আমিষের বড় উৎস ডিম ও ফার্মের মুরগি। বাসায় কোনো মেহমান এলে ঘরে যদি কমপক্ষে ডিম, আলু আর ডাল থাকে তাহলে মনে একটু হলেও প্রশান্তি থাকে। সে ডিমের ডজন যখন ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা হয় তখন ভোক্তাদের মনে যে কষ্ট দানা বাঁধে, কে তা বুঝবে?
মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে লাগাম তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে সুদের হার বেড়েছে। মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে একটা জায়গায় স্থিতিশীল হয়েছে। কিন্তু সুদের হার ও ডলারের দামের কারণে নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়েছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সুদের হারে লাগাম তুলে নেয়ার পদক্ষেপ ঠিকই আছে। তাতে বাজারে টাকার সরবরাহ কমবে। পণ্যের চাহিদা কমবে। মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনাও আছে। অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের এটি অন্যতম পদক্ষেপ বটে, তবে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এই নীতি ততটা কার্যকর নয়। কারণ, সেসব পণ্যের চাহিদা সব সময়ই থাকে। বাজারে টাকার সরবরাহের ওপর ওই সব পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দাম ততটা নির্ভর করে না। এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার।
যেমন ধরুন ডিমের কথা। এর সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হলে পোলট্রি শিল্পের প্রতি নজর বাড়াতে হবে। পোলট্রি শিল্পের সাথে জড়িত কাঁচামাল, খাদ্যের দাম, পরিবহন ব্যবস্থাসহ বাজার ব্যবস্থাপনার সমস্যা চিহ্নিত করে পয়েন্ট টু পয়েন্ট সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে। মার্কিন ডলারের দাম বাড়তে থাকে। এর পরই সব পণ্যের দাম বাড়া শুরু হয়। অন্য দিকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়েছে, যা আবার শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিগত সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার কৌশল নিয়েছিল কিন্তু তা কাজে আসেনি। এখন অন্তর্র্বর্তী সরকারের পদক্ষেপও তেমন কাজে আসছে না। বাজারে কোনো জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। যে যার মতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। ৮০-১০০ টাকার নিচে তরকারি (সবজি) কেনা যায় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত আগস্টে দায়িত্ব নেয়ার পর মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়ার কৌশল বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর ফলে সুদের হার বেড়েছে। ডলারের দাম ১২০ টাকার আশপাশে মোটামুটি স্থির হয়েছে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ১০ শতাংশের কিছুটা কম হয়েছে। যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপরে। তবে আশা করা যায়, মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কিন্তু ততক্ষণে ভোক্তাদের অবস্থা কী হবে সেটিই ভাবনার বিষয়। দ্রব্যমূল্য কিভাবে কমানো যায়, তা জানতে অর্থনীতিবিদ, বাজার বিশ্লেষকদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। নিত্যপণ্যের দাম কেন বাড়ে, সমস্যা কোথায়- তা চিহ্নিত করে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে কিছু স্বল্পমেয়াদি ও কিছু মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। প্রথমত, চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও ডিমের শুল্ক-কর কমানো যেতে পারে। এতে দাম কমানোর সুযোগ তৈরি হবে এবং সরবরাহ বাড়বে। সরবরাহ ব্যবস্থায় সংস্কার করতে হবে। বাজার তদারকি সফল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দূর করতে পদক্ষেপ দরকার। দ্রব্যমূল্য মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখার স্থায়ী উপায় বের করতে হবে। এ জন্য দরকার কৃষির উৎপাদন আধুনিকীকরণ করা ও সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থাপনা। বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। এ ভর্তুকির সঠিক ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছতার সাথে মনিটরিং করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের সাথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিও গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা চাই।
দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে প্রবীণ ও অসুস্থ, রোগগ্রস্ত লোকজন সঙ্কটে দিনাতিপাত করছে।
নিম্ন আয়ের মানুষ যা আয় করছে তার পুরোটাই খাদ্য কিনতেই শেষ হয়ে যায়। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকছে না। যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরি জীবন কাটিয়েছেন, তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। কারণ চাকরি জীবনের একমাত্র সঞ্চয়, পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকা। তাদের অনেকে সঞ্চয়পত্র কিনে মাসে মাসে সেখান থেকে মুনাফা নিয়ে জীবন নির্বাহ করেন। ইদানীং সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও কমানো হয়েছে। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীসহ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করছে।
নিত্যপণ্যের এই ঊর্ধ্বমুখিতা থেকে জনগণ মুক্তি চায়। তাই এ থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির স¤প্রসারণ করা, গরিব ও অসহায়দের স্বল্পমূল্যের খাদ্য বিতরণ এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানো উচিত।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখিতা রোধ করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে, এমনটি সবার প্রত্যাশা।
ইমেল : main706@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা