২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও ভূরাজনীতি

- ফাইল ছবি

জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠক করেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। একই সাথে এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য বিরল সুযোগ। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নেয়ার বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে এটিকে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠক সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে এ ধরনের বৈঠক বিরল ঘটনা। কারণ জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে তো এমন বৈঠক বিরল।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক একাধিক কূটনীতিকের মতে, চিরাচরিত প্রথা ভেঙে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক প্রতীকী অর্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত হলেও দুই নেতার বৈঠক এই বার্তাই দিচ্ছে যে, হোয়াইট হাউজ বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনকে আগামী দিনগুলোতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ভবিষ্যতে বৈঠকটি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সস্পর্ককে নিঃসন্দেহ নতুন উচ্চতায় উন্নীত করবে। বৈঠকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্যিক সুবিধা, গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণ ও অন্তর্র্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার পদক্ষেপসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৈঠক অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে।

তবে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কতটুকু বাংলাদেশ আদায় করতে পারল তা দেখতে নিশ্চয় আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো, অবৈধ পন্থায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার মতো বিষয়ে সহযোগিতা পেলে নিঃসন্দেহে সুফল পাবে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠক নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউজ। বিবৃতিতে বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা জানানো হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং বাংলাদেশে তাদের আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে প্রায় ২০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তারও ঘোষণা দিয়েছে।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বহু আগে থেকেই বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন ও বারাক ওবামার সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন। অধ্যাপক ইউনূস ১৯৬৫ সালে একজন ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৭১ সালে ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করে মিডল টেনাসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। তখন থেকেই প্রতিবেশী রাজ্য আরকানসাস (লিটল রক) কিংবা শিকাগো নগরীতে তার নিত্যনৈমিত্তিক আসা-যাওয়া ছিল এবং তখন থেকেই বিল ক্লিনটন, তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কিংবা বারাক ওবামার সাথে ক্রমে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। তার পর বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু নানাবিধ ব্যস্ততায়ও যুক্তরাষ্ট্রে তার আসা-যাওয়া বন্ধ হয়নি, বরং বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ততার কারণে অনেক বেড়ে গিয়েছিল। দিনে দিনে পশ্চিমাদের কাছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা ও আন্তরিকতা একটা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছায়।

জাতিসঙ্ঘে ড. ইউনূসের বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উচ্ছ¡সিত ভঙ্গিমার প্রচুর ছবি দেখা গেছে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের জাতিসঙ্ঘে উপস্থিতির পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যে উচ্ছ¡সিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশও যেমন সহযোগিতার বার্তা পেয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ইতিবাচক বার্তা পেয়েছে।

প্রসঙ্গত, কয়েক বছর ধরে গণতন্ত্র ও নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপড়েন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। টানাপড়েনের সূচনা হয়েছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এলিট ফোর্স র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে। পরে ২০২৩ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন সামনে রেখে ভিসানীতি ঘোষণা করে, যা তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে নজিরবিহীন চাপে ফেলে দেয়। ওই সময় পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নিজে ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা দিনরাত যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ বা ওই এলাকায় সামরিক ঘাঁটি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, এমন বক্তব্যও তারা দিয়েছেন, যা যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। এর পরও গত জানুয়ারিতে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও গত মে মাসে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা এবং দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণ দেখিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়। ফলে দেশ-বিদেশে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়। যদিও নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতেও আস্থা কিংবা উষ্ণতার ঘাটতি অনেকের কাছে দৃশ্যমান ছিল।

বাংলাদেশ ইস্যুতে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে প্রতিবেশী দেশ ভারতও এখানে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। এমন পরিস্থিতিতে গত জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি একপর্যায়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। তার পদত্যাগের পর ড. ইউনূস অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিলে পশ্চিমারা তাকে সবার আগে স্বাগত জানায়।

এ কথা স্পষ্ট, নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবেলা করেই দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ন্যায্য অধিকারবঞ্চিত জাতি রক্ত দিয়ে রাজনৈতিক মুক্তি পেলেও অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে দেশটির বিরুদ্ধে চলছে দেশীয় ও প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ মুষ্টিমেয় কিছু আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চক্রান্ত। তারা গণতন্ত্রের নামে এ দেশে একদলীয় স্বৈরশাসকের পক্ষ অবলম্বন করে বিভিন্নভাবে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বারবার আঘাত করছে। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের সমর্থন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে নিঃসন্দেহে শক্তিশালী করবে। একই সাথে বাংলাদেশে সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আগামীর গণতান্ত্রিক সরকারকে সুসংহত করবে। বাংলাদেশ ও আমেরিকার গভীর সম্পর্ক ভবিষ্যতে ভারত উপমহাদেশের ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের ভ‚রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে। একই সাথে সামনের দিনগুলোতে আর কেউ যেন বাংলাদেশকে তাদের ভ‚রাজনীতির দাবার ঘুঁটি বানাতে না পারে সে দিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ইতোমধ্যে নানা কারণে আলোচনা সমালোচনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন কেন সোচ্চার সেটি নিয়েও আছে কৌত‚হল। ভৌগোলিক গুরুত্ব, অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদের আধার, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামগ্রিক উন্নয়ন, বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র অর্থনীতি ও ভ‚রাজনৈতিক গুরুত্বের জন্যই দিনে দিনে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই বাড়ছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে যোগাযোগে বঙ্গোপসাগরের ভূমিকা, ভূরাজনৈতিকভাবে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা, চীনের অন্যতম বাণিজ্যিক পথ মালাক্কা প্রণালী, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে বঙ্গোপসাগরের সংযোগ, ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যের স্থিতিশীলতা, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং সর্বোপরি দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ হিসেবে এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে বলেই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে। এক দিকে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান; অন্য দিকে চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, মাঝে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর যুক্তরাজ্য- ভূরাজনীতিতে বিশ্বের সব বলয়ের সাথে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

ভূরাজনীতিতে বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশ নিজেদের সক্ষমতা সৃষ্টি করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক শুধুই দ্বিপক্ষীয় নয়; এ সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা ও বিভিন্ন স্তর আছে। আছে কৌশলগত দিক। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য, শক্তিশালী বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও বাংলাদেশ এক নির্ভরযোগ্য বন্ধু। আমরা প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পূর্ণ সমর্থন বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে কার্যকর প্রভাব বিস্তার করবে। আমাদের আরো স্মরণ রাখতে হবে, বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের জন্য আমেরিকা একটি বিরাট একক বাজার, রয়েছে রফতানির প্রচুর সুযোগ-সম্ভাবনা। প্রতি বছর বেড়ে চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশী তৈরী পোশাকের চাহিদা ও জোগান। একটু কৌঁসুলি হলে, বাণিজ্য সুবিধা আরো সহজ করে দিলে, পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ আরো উন্নত ও নিরাপদ হলে অন্য যেসব দেশ থেকে তারা পোশাক কেনে, যেমন- ভিয়েতনাম, ব্রাজিল বা চীন তাদের বাদ দিয়ে মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশের প্রতি আরো আকৃষ্ট হবে। যদি এ সুযোগ সর্বাত্মকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে দুই দেশের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক ক্রমেই দৃঢ়তর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক : কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement