০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ৪ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

মানবিক সমাজ গঠনে শিক্ষাভাবনা

- প্রতীকী ছবি

গণতন্ত্র তখনই পূর্ণতা পায় যখন দেশের নাগরিকরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে মানবিক গুণাবলিরও অধিকারী হয়। সাধারণভাবে উচ্চশিক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জীবন উপভোগ করার শিক্ষা, যা কেবল পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং জীবন ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, ‘শিক্ষা শুধু জীবনের উপকরণ নয়, জীবন উপভোগ করার শিক্ষাও বটে।’ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল মুখস্থনির্ভর শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করছে।

শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে বাছাইকৃত প্রশ্ন মুখস্থ করে বা প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষকদের সহায়তায় পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। এই প্রতিযোগিতা তাদের জ্ঞান লাভের বিস্তৃত পরিসর সীমিত করে ফেলে। শিক্ষার্থীরা জীবনমুখী সুস্থ ধারার জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

আনন্দমুখী শিক্ষা লাভের সুযোগ হারিয়ে জ্ঞানার্জন বৃদ্ধির পরিবর্তে শিক্ষাবিমুখ হয়ে পড়ে। অভিভাবকের চাপ এবং ভবিষ্যতের রুটিরুজির চিন্তায় তারা এই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, ‘বাংলাদেশে যে উপায়ে শিক্ষা দেয়া হয়, তাতে আদর্শিক শিক্ষার ছায়াপাত সামান্যই।’ (প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি-২০২৪)

জার্মান সমাজতাত্তি¡ক ম্যাক্স ওয়েবার উল্লেখ করেছেন, ‘মানুষের কর্ম ও জীবনধারার ওপর সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে।’ শিক্ষাব্যবস্থা যখন সৃজনশীলতা ও মানবিকতার চর্চা থেকে দূরে সরে যায়, তখন সমাজে অমানবিকতা ও অসততা বিস্তৃত হয়।

শিল্প, সংস্কৃতি ও মানবিক শিক্ষা : শিল্প মানুষের আত্মাকে সমৃদ্ধ করে এবং তাকে নতুন চিন্তা ও অনুভ‚তির জগতে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মনের সুষ্ঠু বিকাশ।’ শিল্প, সঙ্গীত, নাটক, চিত্রকলা এবং সাহিত্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিকতার বীজ বপন করে।

শিক্ষার বাস্তবিক প্রয়োগ ও মনুষ্যত্বের বিকাশ : বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের পরিবর্তে শুধু পাস করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করে, যা তাদের সৃজনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধকে কমিয়ে দেয়। ফরাসি দার্শনিক জঁ-জ্যাক রুশো বলেছেন, ‘মানুষ স্বাধীন জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্র শৃঙ্খলিত।’

শিক্ষাব্যবস্থায়ও এই শৃঙ্খলা লক্ষ্য করা যায়, যেখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে শুধু সনদ অর্জনেই সীমাবদ্ধ থাকে।

মানবিক সমাজ গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ : মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভ‚তি এবং পরমতসহিষ্ণুতা শেখানো ও চর্চা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা যদি জীবনকে উপভোগ করার পাশাপাশি মানবিকতা ও নৈতিকতার চর্চায় সাহায্য করে, তবে শিক্ষাব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে সফল হবে।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা কি তাদের মতো হতে চাও, যারা কিতাব বহন করে কিন্তু বোঝে না।’ (সূরা আল-জুমুয়া-৫)

এখানে আল্লাহ তায়ালা ইঙ্গিত দিয়েছেন, শিক্ষা শুধু বাহ্যিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা বুঝতে এবং জীবনের সঠিক পথে পরিচালিত হতে হবে। হাদিসেও উল্লেখ আছে, ‘জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ-২২৪)

এই শিক্ষার মধ্যে কেবল বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নয়; বরং নৈতিকতা, মানবিক গুণাবলি এবং আধ্যাত্মিকতাও অন্তর্ভুক্ত।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত। যেখানে শুধু মুখস্থনির্ভর শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রকৃত মর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

ইসলামী চিন্তাবিদ ইবনে খালদুন তার ‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানী করে তুললেও মানবিকতা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির গুরুত্ব অপরিসীম।

শিক্ষাব্যবস্থা ও মানবিকতার বিচ্যুতি : ইসলামে শিক্ষার ব্যাপারে বলা হয়েছে, শিক্ষার মূলে আছে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা জ্ঞান দান করেন, আর যাকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাকে অনেক কল্যাণ দান করা হয়েছে।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৬৯)

তাই শিক্ষার প্রকৃত অর্থ হলো, নৈতিক শিক্ষা ও জ্ঞানের সমন্বয়। যখন শিক্ষাব্যবস্থা মানবিকতা ও সৃজনশীলতা চর্চা থেকে দূরে সরে যায়, তখন সমাজের মূল মূল্যবোধ দুর্বল হয়ে পড়ে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

গণতন্ত্র ও মানবিক শিক্ষা : ইসলামের শিক্ষা অনুসারে, মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ লাভ করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনি কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন এবং যা কিছু তোমরা জানতে না, তা শিক্ষা দেন।’ (সূরা বাকারাহ-২:১৫১)

এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক গুণাবলিসম্পন্ন করে গড়ে তোলা। শিক্ষা মানে শুধু তথ্য তত্ত¡ সংগ্রহ নয়; বরং জীবনকে উপলব্ধি করার এবং জীবন উপভোগ করার ক্ষমতা। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রকৃত মর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার গুরুত্ব : ইসলামিক স্কলার ইবনে কায়িম রহ: বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো আত্মার খাদ্য এবং অন্তরের প্রশান্তির মাধ্যম, যার মাধ্যমে মানুষ সঠিক পথ চিনতে পারে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।’ এই শিক্ষার গুরুত্ব আমাদের বর্তমান সমাজে অনেকাংশে উপেক্ষিত হচ্ছে।

নৈতিক শিক্ষাহীন শিক্ষার্থীর মন অর্জিত শিক্ষাসনদ বিত্তবৈভব অর্জন এবং ক্ষমতার মসনদ পাওয়ার উন্মত্ততায় মেতে ওঠে। নিজেকে সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাবতে থাকে। লাজলজ্জার তোয়াক্কা না করে অপপ্রতিরোধ্য গতিতে সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য গড়ার বাসনায় মানুষরূপী মন সারাক্ষণ উদগ্রীব হয়ে ওঠে। দানবীয় মেধার বিচ্ছুরণে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় রাষ্ট্রের সর্বত্র। মিথ্যা অহঙ্কার আর বিকৃত এই মানব দেশের বাইরে নিজ দেশের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থসম্পদ পাচার করে নির্দ্বিধায়।

এ যাবৎকালের অভিজ্ঞতা থেকে যদি শিক্ষা না নিতে পারি তাহলে আজকে ব্যক্তির কদর্যতা যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে পুরা রাষ্ট্রের কদর্যতাও বিশ্বে উন্মোচিত হবে এই ভাবনা কিন্তু অমূলক নয়। তাই জনগণকে প্রকৃত স্বাধীনতা উপভোগ করতে হলে তার চিন্তার স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। মানুষ মানুষের নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করতে পারে। কোনো পোশাকি শক্তি দিয়ে নিরাপত্তা নিñিদ্র করা যায় না। নিñিদ্র নিরাপত্তায় জীবন উপভোগ করার একমাত্র পথ সভ্য মার্জিত জীবন চর্চাকারী সংস্কৃতিবান নাগরিক তৈরির জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা।

আলোচ্য বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার সুবিধার্থে নিম্নে উল্লিখিত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে :
হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে মানুষকে উপকার করে এবং অন্যের কল্যাণে কাজ করে।’ কল্যাণময় শিক্ষার কথা কিন্তু সর্ব ধর্মে বলা আছে- যে শিক্ষা মানুষের কল্যাণ করে না সে শিক্ষা মূল্যহীন।

শিক্ষা শুধু কর্মসংস্থানের উপায় নয়, এটি জীবনের গভীর সৌন্দর্য ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানবিকতা, নৈতিকতা ও শিল্পের সৌন্দর্য চর্চা করাই একটি সুশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানবিকতা, নৈতিকতা এবং শিল্পের চর্চা করা একটি সুশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। তাই, বাংলাদেশে শিক্ষা সংস্কার অত্যন্ত জরুরি, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু কর্মমুখী ও পার্থিবজ্ঞান অর্জন করেই সীমাবদ্ধ না থাকে; বরং আধ্যাত্মিকজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে।

লেখক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
ই-মেইল : dipu.siddiqui@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement