০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

এখন প্রয়োজন ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যমঞ্চ

এখন প্রয়োজন ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যমঞ্চ - প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ এখন যেন চাপা অস্থির সময় পার করছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী গণমানুষ শঙ্কা আর আশার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যমান কিছু দেখতে চায় তারা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ ইতিমধ্যেই দু’মাস হয়ে গেছে। এর ভেতরে ফ্যাসিবাদের দোসর অনেকেই সরকারে যুক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। নানা দিক থেকে বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের চেষ্টা চলছে দাবি দাওয়া পূরণের নামে- সরকারকে বিব্রত করতে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, হাজারো তরুণের বুকের রক্তের দামে পাওয়া। কারো দয়ার দান নয়। দেড় দশক ধরে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের সফল সমাপ্তি ঘটিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন। এটা এখন পরীক্ষিত; স্বৈরাচার বা স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাদের বিদায় জানাতে গণ-ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ লুটপাট আর পাচার করে শূন্য করে ফেলেছে দেশের অর্থনীতি। সর্বত্র বিরাজমান রয়েছে ১৫ বছর ধরে পদায়িত স্বৈরাচারের দোসরেরা। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এখনো তাদেরই দখলে। তাই এই সরকারকে ব্যর্থ করতে সব সময় সচেষ্ট আছে তারা। গণমানুষের মনে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নানা কর্মকাণ্ড দেখে।

যেমন-
ক. কি হচ্ছে সরকারের ভেতর?

খ. কারা নিয়োগ পাচ্ছেন সরকারে? বিতর্কিত বাম, নাস্তিক, ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধীরা হরে-দরে নানা কমিটিতে যুক্ত করছেন কারা এবং কেন, কী উদ্দেশ্যে?

গ. বাজার ব্যবস্থাপনার এমন বেহাল দশা কবে ঠিক হবে? নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ নেই কেন?

ঘ. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কবে পরিপূর্ণ স্বাভাবিক হবে? গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর উপর হামলার পরও কোনো বিচার না হওয়া কিসের ইঙ্গিত?

বহু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। মোটাদাগে কয়েকটি বিষয়ের আশু নিশ্চয়তা ভীষণ জরুরি। তারমধ্যে অন্যতম-

১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া। থানাগুলো পরিপূর্ণ কার্যকর হওয়া।

২. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য দ্রুততম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। ফ্যাসিবাদী আমলের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজনে ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করতে হবে, মোটা অঙ্কের জরিমানা,জেলে পাঠানো লাগলে সেটাও করতে হবে। মজুতদারদের কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে।

৩. শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। স্বৈরাচারের দোসর শিক্ষকদের চিহ্নিত করা। আন্দোলন চলাকালে বহু শিক্ষক-শিক্ষিকা পুলিশের মতো নির্যাতন চালিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের উপর।

আমরা জানি, সরকার কাজ করছে। সারা দুনিয়া বাংলাদেশের পাশে আছে। কিন্তু প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান পরিষ্কার নয়। তারা আওয়ামী সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দানব বানিয়েছিলো। বিনিময়ে একতরফা সুবিধাও নিয়েছে ব্যাপক, নির্লজ্জের মতো। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রীতি-রেওয়াজের ন্যুনতম ভদ্রতার ধার ধারেনি। লুটপাটের মচ্ছবে তারাও শরিক হয়ে বাগিয়ে নিয়েছে অনেক কিছু। কোন গনতন্ত্রকামী দেশ এরকম একতরফা সুযোগ দেবে না। এই সরকারও দেবে না। তাই তারা ষড়যন্ত্র করবে, আওয়ামী পুনর্বাসনের জন্য এটাই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে আওয়ামী পুনর্বাসন পরিকল্পনাবিষয়ক সভার খবর এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। জনগণ মনে করে, তারই অংশ হিসেবে গণহত্যার কুশীলবদের ভারত আশ্রয় দিয়েই যাচ্ছে। বাংলাদেশের নয়া সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে- সংখ্যালঘু ইস্যু তৈরি করছে বিজেপি সমর্থিত মিডিয়াগুলো। বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের উগ্রবাদী হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে। আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলমান।

এই পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল দলের দায়িত্ব নিতে হবে দেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। সরকারকে সফল করতে, সরকারের এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়নে সহযোগিতা যেমন করতে হবে। তেমনি সরকারের ভুলগুলোও ধরিয়ে দিতে হবে। সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন 'সর্বদলীয় ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যমতের মোর্চা বা মঞ্চ।' সকল দল থেকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অগ্রসর নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করতে হবে। তাদের কাজ হলো- তারা সরকারের কাছে জবাবদিহিতা চাইবে।

ফ্যাসিবাদের দোসর, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সৈনিক, ধর্মবিদ্বেষী, রাষ্ট্রবিরোধী অনেকেই বহাল তবিয়তে আছে। অনেকের পদোন্নতিও হচ্ছে। কেউ কেউ সরকারেরও অংশ হচ্ছে। এসব যদি হয় তা হবে শহীদের রক্তের সাথে প্রতারণার শামিল।

আর এই দোষারোপ করেও রক্ষা পাওয়া যাবেনা। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর এই সঙ্গীন সময়ে দায়িত্ব নিতে হবে। জুলাই বিপ্লবে কার কী ভূমিকা ছিলো সেটাই এখন লিটমাস টেস্ট। একদল বিপ্লব তথা দ্বিতীয় স্বাধীনতার পক্ষশক্তি এবং অপরদল গণহত্যার দায়ে দায়ী।

সকল দলের অংশগ্রহণে 'ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য মঞ্চ' ওইসব দোসরের পরিচয় প্রকাশ করবে। সরকারে লুকিয়ে থাকাদের খুঁজে খুঁজে বের করে জনতার সামনে পরিচয় প্রকাশ করে দেবে। সংবাদ সম্মেলন করে তাদের কর্মকাণ্ড পেশ করবে জাতির সামনে। সরকারবিরোধী যেকোনো ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে থাকবে বদ্ধপরিকর।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের হাতকে আরো শক্তিশালী করবে এই মঞ্চ। তিনি এখন দলমত নির্বিশেষে সকল বিপ্লবী গণমানুষের নেতা। সেটা তাকে বোঝাবে এই ঐক্যমঞ্চ। ঐক্যমঞ্চ অনেকটা ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করবে। দ্রুততম সময়ে ঐক্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা না করলে সরকারকে ব্যর্থ করতে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করবে। পাহাড়ে অস্থিতিশীলতা, গার্মেন্টসে অস্থিতিশীলতা, কতিপয় মিডিয়ার কৌশলী প্রোপাগান্ডা, দ্রব্যমূল্যকে লাগামহীনভাবে বাড়ানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরস্পরবিরোধিতা বাড়াতে সকল শক্তি নিয়োগের চেষ্টা করবে। প্রায়ই ফোন কল ফাঁস হচ্ছে। ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা প্রকাশ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কোনো দল এককভাবে বা দলগুলো আলাদা আলাদা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যেমন যাবে না, তেমনি এই অভ্যুত্থান সফল করাও যাবে না। স্বৈরাচারের দোসররা গণমানুষকে বিভ্রান্ত করা শুরু হবে। যা খুবই আতঙ্কের। তাই ঐক্যমঞ্চ জাতীয় স্বার্থে ভীষণ জরুরি।

নির্বাচনের তারিখ ঘোষনা হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ঐক্যমঞ্চ থাকবে। তাতে বাংলাদেশে এক নয়া রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সেটা হলো নিজেদের ভেতরে মতভিন্নতা থাকলেও স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ইস্যুতে সবাই ঐক্যবদ্ধ। তারা দ্বিতীয় স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি। গণহত্যাকারী দল। চার-চারটি গণহত্যা করেছে তারা :

১. পিলখানায় পরিকল্পিত গণহত্যা,
২. শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের উপর গণহত্যা,
৩. দেশব্যাপী দেড় দশক ধরে চালানো গুম, খুনের ধারাবাহিক গণহত্যা,
৪. জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার উপরে চালানো ভয়াবহ গণহত্যা।

এই গণহত্যাকারী দলকে সমর্থনকারী সকলকেই গণহত্যার দোসর হিসেবে সাব্যস্ত করে জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি করতে হবে। যাতে এই দেশে ভবিষ্যতে কোনো সরকার 'গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের' বিপক্ষে অবস্থান নিতে না পারে। তাই স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে গণমানুষের সামনে দৃশ্যমান করতে হবে।

আগামীর বাংলাদেশের নির্মাণের পাটাতন হবে আওয়ামী লীগকে ধিকৃত গণশত্রু হিসেবে উপস্থাপন করে। তাদের দোসর সকল সহযোগী, সংস্কৃতিজীবি, কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিদের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে।

এইসকল কর্মকাণ্ড করতে, গণঅভ্যুত্থানের সরকারকে সফল করতে, বৈষম্যহীন নয়া বাংলাদেশ গড়তে এখনই যেকোনো নামে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যমঞ্চ খুবই জরুরি। আশা করি, তারা বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হবে।

লেখক : ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement