বিশ্বযুদ্ধ কি অত্যাসন্ন
- হামিদ মীর
- ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৪৫
যুদ্ধ ছিল তার জীবন। তিনি এ যুদ্ধের মধ্যেই যৌবন লাভ করেন। তিনি জীবনে যা কিছু পেয়েছেন, তা এ যুদ্ধের মধ্যেই পেয়েছেন। তিনি জীবনে যা কিছু হারিয়েছেন, তা এ যুদ্ধের মধ্যেই হারিয়েছেন। যুদ্ধই তাকে মৃত্যু দান করেছে, তবে এ মৃত্যু তার জন্য নতুন জীবনে পরিণত হয়েছে। ২৭ সেপ্টেম্বর হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল হাসান নাসরুল্লাহর শাহাদত বিশ্বকে এক বিশাল যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু হাসান নাসরুল্লাহকে শহীদ করার পর এক বক্তব্যে বলেন, তিনি শুধু অসংখ্য ইসরাইলি নাগরিক নয়; বরং কিছু আমেরিকান ও ফ্রেঞ্চ নাগরিকের মৃত্যুর বদলা নিয়েছেন। নেতানিয়াহু মনে করেন, হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া ও হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল হাসান নাসরুল্লাহর শাহাদৎ তার বিশাল বড় সফলতা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এত সফলতা সত্ত্বেও ইসরাইল আগের থেকেও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। ১৯৯২ সালে ইসরাইলি হেলিকপ্টার লেবাননে হামলা করে হিজবুল্লাহর তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আব্বাস আল-মুসাবিকে স্ত্রী ও পাঁচ বছরের পুত্রসহ শহীদ করে। তৎকালীন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক শামিরেরও ধারণা এমনই ছিল যে, ইসরাইল নিরাপদ হয়ে গেছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। আব্বাস আল-মুসাবির জায়গায় হাসান নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহর নেতৃত্বের হাল ধরলে ইসরাইলবিরোধী আন্দোলন আরো তীব্র হয়। ১৯৯৭ সালে হাসান নাসরুল্লাহর ১৮ বছর বয়সী পুত্র মুহাম্মদ হাদি নাসরুল্লাহ দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সময় শহীদ হন। মুহাম্মদ হাদির দেহ টুকরা টুকরা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ইসরাইল তার দেহের টুকরাগুলো হিজবুল্লাহকে প্রত্যার্পণের প্রস্তাব দেয়। হাসান নাসরুল্লাহ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর তার প্রতি জনসাধারণের সমর্থন বৃদ্ধি পায়।
ইসরাইল ১৯৮২ সালে দক্ষিণ লেবাননের বিশাল এলাকা দখল করে রেখেছিল। তারা সেখানে লেবাননি খ্রিষ্টানদের সহায়তায় সাউথ লেবানন আর্মি গঠন করেছিল। হাসান নাসরুল্লাহ লেবাননি খ্রিষ্টানদের সাথে সংলাপের সূচনা করেন। সাউথ লেবানন আর্মি ও ইসরাইলকে সহায়তা করা থেকে তাদের থামান এবং ইরানের সহায়তায় আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। অবশেষে ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরাইলকে পিছিয়ে যেতে হয়। সাউথ লেবানন আর্মির সেনাসদস্য ও কর্মকর্তাদেরও ইসরাইলে পালিয়ে যেতে হয়। সেটি ছিল হাসান নাসরুল্লাহর বিশাল বড় সফলতা। ২০০৪ সালে হাসান নাসরুল্লাহ ইসরাইলের সাথে বন্দিবিনিময় করেন। ওই বিনিময়ে ইসরাইল তাদের হাদির টুকরা টুকরা দেহাবশেষও ফেরত দেয়, যিনি ১৯৯৭ সালে শহীদ হন। এটি সেই বছরের কথা, যে বছর ইসরাইলি হেলিকপ্টার গাজায় হামলা করে এবং ফজরের নামাজ আদায়ের পর মসজিদ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় হামাসপ্রধান শেখ আহমদ ইয়াসিনকে শহীদ করে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শৌল মোফাজ আহমদ ইয়াসিনকে ফিলিস্তিনের উসামা বিন লাদেন আখ্যায়িত করে বলেন, আমরা এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করে ইসরাইলকে রক্ষা করেছি। ইসরাইল যখনই হামাস বা হিজবুল্লাহর কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হত্যা করেছে, তখনই ইসরাইলের নেতারা নিজেদের জনগণকে এ কথাই বলেছেন যে, আমরা আপনাদের নিরাপদ বানিয়েছি। কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কিছু। আজ যদি ফিলিস্তিন ও লেবানন অনিরাপদ হয়, তাহলে ইসরাইলও এতটা অনিরাপদ যে, কয়েকটি পশ্চিমা এয়ারলাইন ইসরাইলের জন্য তাদের ফ্লাইট স্থগিত করে দিয়েছে। বিশাল সংখ্যক ইসরাইলের জনগণ ইউরোপ ও আমেরিকায় পালাচ্ছে। ইসরাইলি বাহিনী জনশক্তি ঘাটতির শিকার। ইসরাইলের মূল শক্তি তাদের রাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশের সহায়তা। এই রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে ইসরাইল তার শত্রুদের সারিতে বিশ্বাসঘাতক সৃষ্টি করে। ওই সব বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় ইসরাইল তার শত্রুদের টার্গেট বানায়।
ইসরাইল ২০০৮ সালে হাসান নাসরুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ইমাদ ফায়েজ মুগনিয়াকে দামেস্কে হত্যা করে পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে, সিরিয়ার রাজধানীতে তাদের নেটওয়ার্ক যেকোনো সময় যা ইচ্ছা করতে পারে। ইমাদ ফায়েজ মুগনিয়া দামেস্কের ইরানের দূতাবাসের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। তার গাড়ি দূতাবাসের পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ইসরাইলি গোয়েন্দা তার গাড়ির টায়ার বদলে দেয়। নতুন টায়ার বারুদে ভরা ছিল। ইমাদ ফায়েজ মুগনিয়া ফিরে আসেন। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বিস্ফোরণ ঘটে। ২০২০ সালে বাগদাদে এক মার্কিন ড্রোন ইরানের আলকুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে টার্গেট বানায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জেনারেল কাসেম সোলেইমানির গতিবিধি সম্পর্কে আমেরিকা ও ইসরাইলকে তথ্য সরবরাহকারী ব্যক্তির নাম মাহমুদ মুসাবি। তাকে ইরানে ফাঁসি দেয়া হয়। ৩১ জুলাই, ২০২৪ তেহরানে হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়ার ওপর হামলা চালানো হয়। এ ঘটনার দ্বারা পুরো বিশ্ব জানতে পারে, ইসরাইল ইরানের রাজধানীর ভেতর এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। ইসরাইলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক শুধু ইরান, সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননে নয়; বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানেও ছড়িয়ে আছে। কয়েকটি মুসলিম দেশে ইসরাইলি নেটওয়ার্ক মুসলিম নেতাদের সরাসরি টার্গেট করার পরিবর্তে ওই দেশগুলোতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উসকে দেয়। যারা ধর্মীয় উগ্রতার আগুন উসকে দেয়, গোপনে তাদের সাহায্য করে। হামাস ও হিজবুল্লাহ মূলত ইসরাইলের উগ্র নীতির প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে।
ইসরাইল ১৯৮২ সালে লেবাননে হামলা না করলে হিজবুল্লাহ তৈরি হতো না। ফিলিস্তিনে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে হামাসও তৈরি হতো না। অথচ জাতিসঙ্ঘের ছায়াতলে ইসরাইল রাষ্ট্র ফিলিস্তিন থেকে লেবানন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। কোনো পশ্চিমা দেশ ইসরাইলকে সন্ত্রাসী অভিহিত করেনি। অপর দিকে হিজবুল্লাহকে আমেরিকা ও ইউরোপসহ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে রেখেছে। শুধু চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও সিরিয়া হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী মনে করে না। নিজেই ভাবুন, গাজা ও বৈরুতে যা কিছু হচ্ছে, এরপর কি বিশ্ব আগের চেয়ে বেশি অনিরাপদ হচ্ছে না? হাসান নাসরুল্লাহর স্থানে নাইম কাসেমকে হিজবুল্লাহর নতুন সেক্রেটারি জেনারেল বানানো হয়েছে। খুব অল্পসংখ্যক মানুষই জানেন, হাসান নাসরুল্লাহ বেঁচে থাকতেই নাইম কাসেমকে হিজবুল্লাহর আগামী নেতা হিসেবে সামনে আনতে শুরু করেছিলেন। নাইম কাসেম লিখিত গ্রন্থ ‘হিজবুল্লাহ’ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। গ্রন্থটির অধ্যয়ন বলছে, নাইম কাসেম ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরো বেশি কঠোর পলিসি গ্রহণ করার পক্ষে। আমি এ গ্রন্থটি ২০০৬ সালে বৈরুতে পড়েছি। আমি সেখানে জানতে পারি, হাসান নাসরুল্লাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে একটি রেডলাইনে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলেন, যাতে ইসরাইল লেবাননে এতটা বোমা বর্ষণ না করে যে, লেবাননের পুরো অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। নাইম কাসেম ইসরাইলের বিরুদ্ধে সেই হামলারই সমর্থক, যেমনটি হামাস ২০২৩ সালে অক্টোবরে করেছে। নাইম কাসেম তার গ্রন্থে লিখেছেন, শত্রুর শক্তিশালী বাহিনী ও বিমানশক্তির বিপরীতে একটিই সমাধান- আত্মঘাতী হামলা। যদি নাইম কাসেম হিজবুল্লাহকে সেই পথে ঠেলে দেন, যার ইঙ্গিত তিনি কয়েক বছর আগে তার গ্রন্থে করেছিলেন, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইরানের আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে টার্গেট করার পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছেন। নেতানিয়াহুর কাছে বিমানশক্তি ও মার্কিন ড্রোন রয়েছে। নাইম কাসেমের কাছে কয়েক হাজার আত্মঘাতী যোদ্ধা রয়েছেন। চিন্তার বিষয়, আমরা বিমানশক্তি ও আত্মঘাতী যোদ্ধার এক নতুন যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে স্থলবাহিনী খুব বেশি গুরুত্ব পাবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বৃহত্তর নতুন যুদ্ধ থামাতে সফল না হলে বিশ্ব হাসান নাসরুল্লাহকে ভুলে যাবে। বিশ্বাস না হলে হাসান নাসরুল্লাহর উত্তরসূরির ‘হিজবুল্লাহ’ গ্রন্থটি পড়ে নিন।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ হতে
উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা