২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের বঞ্চনা

- প্রতীকী

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। তারা নানা বঞ্চনার শিকার। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জেনেও এখনো গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান দিতে পারেননি। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।

একসময় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণীর (নন-গেজেটেট) পদমর্যাদার অধিকারী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে দাবি ছিল, তাদের যেন প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়; কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও এর সপক্ষে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও সর্বসাধারণের সমর্থন রয়েছে।

১৯৮৩ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদালয়ের শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব করা হলেও শিক্ষকরা তা গ্রহণ করেননি। তাদের যুক্তি ছিল- প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন তারা। সুতরাং এটি শিক্ষকদের পদমর্যাদা বাড়াবে না। তখন ওই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে ফের প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদার দাবি তোলা হয়। দীর্ঘ দিন ধরে একই দাবি থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। অবশেষে ২০১২ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এন্ট্রিপদ দশম গ্রেড বা দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদা ঘোষণা করা হয়। শিক্ষককরা তাতেও রাজি হননি।

এন্ট্রিপদ নবম গ্রেড না করে ২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালায় সিনিয়র শিক্ষক পদ সৃষ্টি করে তা সংশোধন করা হয়। সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারী শিক্ষক পদে অন্তত আট বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকবে হবে- এ শর্তে ২০২১ সালের ৩০ জুন কোনো প্রকার আর্থিক সুবিধা ছাড়া সিনিয়র শিক্ষক পদে প্রথম পদোন্নতি দেয়া হয়। কিন্তু এরপর সিনিয়র শিক্ষক পদে আর কোনো পদোন্নতি দেয়া হয়নি। ২০২১ সালে ৩০ জুন যে গ্রেডেশন তালিকার ভিত্তিকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়, সেখানে সবার যোগদান থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হলেও শুধু ২০১১ সালে যারা যোগদান করেছেন তাদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে জন্মতারিখ ধরে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষকদের একটি বড় অংশ আদালতের শরণাপন্ন হন। তাদের দাবি ছিল- সবার ক্ষেত্রে একই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। শুধু এই জটিলতায় আজও ২০১০ ও ২০১১ সালের নিয়োগপ্রাপ্ত দুই সহস্রাধিক শিক্ষক পদন্নতিবঞ্চিত রয়েছেন। যাদের কারো চাকরির বয়স ১৪-১৫ বছর বা তারও বেশি।

আদালতে চলমান মামলা ইস্যু করে শিক্ষকদের পদোন্নতি জটিলতা আরো দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। আদালতের দোহাই দিয়ে পদোন্নতি জটিলতা বছরের পর পর জিইয়ে রাখা হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা নির্ণয়ে এ ধরনের আরো নানা জটিলতা রয়েছে। সাধারণ শিক্ষকদের প্রশ্ন- একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের পর যদি নিজের অধিকার রক্ষায় একের পর এক আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়, কেউ যদি গায়ের জোরে অন্যের অধিকার হরণ করেন, তাহলে ওই কর্তৃপক্ষের কি কোনো দায় নেই? যদি কর্তৃপক্ষ এটিকে নিজেদের ব্যর্থতা বা অবহেলা মনে করেন, তাহলে মাধ্যমিক নামে স্বতন্ত্র অধিদফতরের কথা বলছেন না কেন? আমরা মনে করি, আদালতে বিদ্যমান মাধ্যমিকের জটিলতা নিরসনে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার অন্তর্বর্তী সরকারের। এ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় নজর দিতে পারে। তাহলে সহজে সব জটিলতা কেটে যাবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। অবাক করা বিষয় হলো, বহু শিক্ষকের বকেয়া টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড আটকে আছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধিকারের প্রশ্নে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর কেমন জানি ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করেছে।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ৩২ থেকে ৩৩ বছর সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি করেও পদোন্নতিবঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। অনেকে একই পদে থেকে অবসরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। যদি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এন্টিপদ নবম গ্রেড ধরে চার স্তরবিশিষ্ট একটি পদসোপান তৈরি করা যেত, তাহলে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই বঞ্চনার কিছুটা হলেও অবসান হতো।

৫ আগস্ট ২০১৯ কর্মকর্তা ও কর্মচারী (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর) নিয়োগ বিধিমালা-১৯৯১ সংশোধনীর মাধ্যমে সিনিয়র শিক্ষক পদ থেকে ৫০ শতাংশ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদায়ন দেয়ার গেজেট প্রকাশিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগ্রহী সিনিয়র শিক্ষকদের কাছে আবেদন চাওয়া হলেও এক বছরের বেশি সময় ক্ষেপণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর ওই পদে পদায়ন করাতে পারেনি। সম্প্রতি সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের মাধ্যমিক অফিসার পদে শতভাগ চলতি দায়িত্ব গ্রহণের বিষয় নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হলেও ৪ আগস্ট ২০২৪ সিনিয়র শিক্ষকদের কাছে আবেদন চাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ পদে নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। স্মরণযোগ্য যে, সেসিপ প্রকল্প থেকে আসা বহু অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজার অনেক মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের চলতি দায়িত্ব পালন করছেন, যা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। এসব মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে যদি সিনিয়র শিক্ষকদের পদায়ন করা হয়, তাহলে তারা নিজেদের জন্য সমস্যার কারণ মনে করছেন। তাই তারা মাঠে নেমেছেন রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তির জন্য।

সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসাররা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য নিয়োগ বিধি মোতাবেক সিনিয়র শিক্ষকদের পদায়নের জন্য ৫০ শতাংশ পদ ছেড়ে দিতে একেবারে নারাজ। অন্য দিকে সেসিপ প্রকল্প থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত একাডেমিক সুপারভাইজার পদে যারা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে এখনো বহাল রয়েছেন, তারা রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে লেগেছেন। রাজস্ব খাতে তারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারলে সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদগুলোতে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক পদ থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ৮০ শতাংশ ও সরাসরি নিয়োগের ভিত্তিতে ২০ শতাংশ নিয়োগের কথা থাকলেও সেখানে পদোন্নতি দেয়া হয়নি। বিসিএস রিক্রুটম্যান্ট রুলস, ১৯৮১ সংশোধন না করায় পদোন্নতির জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এটির কারণ হিসেবে শিক্ষকরা কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাকে দায়ী করছেন।

ইতোমধ্যে এ বিষয়গুলো ঘিরে ঢাকায় মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সেসিপ প্রকল্পে কর্মকর্তা ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে হাতাহাতি ও লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে। এর জেরে, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মানববন্ধন ও কর্মবিরতি পালন করেন। এ নিয়ে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মাধ্যমিক অফিসের কর্মকর্তাদের সাথে এক ধরনের বৈরিতা তৈরি হয়েছে। এটি চলতে থাকলে, শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একধরনের নৈরাজ্য দেখা দেবে।

দুঃখজনক হলো- মাধ্যমিকের জন্য নেয়া প্রকল্পগুলোয় কার্যত মাধ্যমিক শিক্ষকদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে নায়েম প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেখানে মাধ্যমিক শিক্ষকদের কোনো পদ রাখা হয়নি। এনসিটিবিতে মাধ্যমিকের শিক্ষকের কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। অথচ তাদের রয়েছে বাস্তবিক অভিজ্ঞতা। শিক্ষা বোর্ডগুলোতে পরীক্ষক হওয়া ছাড়া মাধ্যমিকের শিক্ষকদের আর কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।

মাধ্যমিকের স্বার্থ রক্ষায় মাধ্যমিকের শিক্ষকরা কাজ করতে না পারলে কখনো মাধ্যমিকের এই দুর্গতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। মাধ্যমিকের দায়িত্বশীল পদে বসে যারা মাধ্যমিকের কলকাঠি নাড়ছেন, তারা মাধ্যমিকের কেউ নন। এটিই মাধ্যমিকের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য।
লেখক : সাহিত্যিক ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement