সশস্ত্রবাহিনীর ভাবমর্যাদা জাতীয় নিরাপত্তার চাবিকাঠি
- কমোডর (অব:) জসীম উদ্দীন ভূঁইয়া
- ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:৩৪
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলার মানুষের কাছে ভরসা এবং বিশ্বাসের জায়গা দখল করে আছে। ছাত্রদের আন্দোলনের সময় যখন কারফিউ জারি করা হয়েছিল, তখন সেনারা নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করেনি; বরং তারা জনগণের পাশে থেকেছে। ১৯৯০ সালেও আমরা এক স্বৈরাচার সরকারের পতন দেখেছি, সেখানেও সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতি এরশাদকে সমর্থন করেনি; বরং এরশাদকে রাজনৈতিকভাবে সঙ্কট মোকাবেলার পরামর্শ দিয়েছিল। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান আর এই বিপ্লবের শেষ মুহূর্তে সশস্ত্রবাহিনীর তথা তিন বাহিনীর প্রধানরা সবচেয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা দেখেছি বিশেষ করে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরাসরি বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থিত দাবির পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছে। সেনারা নিরস্ত্র লোকদের ওপর গুলি চালাতে পারে না, কারণ এটি যুদ্ধক্ষেত্রেও সামরিক নৈতিকতার বাইরে।
সেনাবাহিনী যদি পুলিশের মতো আচরণ করত, তাহলে আরো রক্তপাত ঘটত, দেশে গৃহযুদ্ধের সূচনা হতে পারত, যা দেশকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের উচ্চ স্তরের সামরিক চরিত্রগুলো রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে এবং নৈতিকভাবেও কলুষিত হয়েছে। ফলে এটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারত। যার ফলে দেশে বহিঃশক্তির আক্রমণ হতে পারত। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনী সে সময়ে কোনো একক গোষ্ঠীর হয়ে কাজ না করে দেশ এবং দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করে নিজেদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। সশস্ত্রবাহিনীর প্রথম ও সর্বপ্রধান দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষাসহ বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এবং যেকোনো অভ্যন্তরীণ সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজনীয় শক্তি ও জনবল সরবরাহ করা।
সিংহ বনের রাজা হওয়া সত্ত্বেও সেনা ইউনিটগুলোতে প্রতীক হিসেবে কিন্তু সিংহ নয়, বাঘের ছবি রাখা হয়। কারণ বাঘ হলো সিংহের চেয়েও অনেক বেশি হিংস্র, লড়াকু, আক্রমণাত্মক, অজেয় শক্তি, ক্ষিপ্রতা, বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রতীক। ইন্দোনেশিয়া আর্মির সরকারি লোগোতে হিংস্র বাঘের ছবি থাকলেও পশ্চিম জাভার একটি সেনানিবাসের সামনে হাস্যোজ্জ্বল বাঘের মূর্তি ছিল, যা ২০১৭ সালে অনলাইনে ভাইরাল হয়ে হাসির উদ্রেক ছড়ায়। যা সেনাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী সেই হাস্যোজ্জ্বল বাঘের মূর্তি ভেঙে ফেলে। বাঘের যেমন হাস্যোজ্জ্বল চিত্র সম্মানজনক নয়, তেমনি আমাদের সেনাবাহিনীকে অধিক সময় ধরে পুলিশের কাজে ব্যবহার করার ফলে তারা যদি পুলিশের মতো আচরণ করে তাতে তাদের সামরিক চরিত্র হারাবে, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, ভরসার জায়গাটা হারাবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যখন সেনারা বেসামরিক প্রশানকে সহায়তায়র জন্য পুলিশ বা র্যাবের সাথে যৌথ বাহিনীর দায়িত্ব পালন করে তখন সেনাদের সামরিক চরিত্র হারানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে।
দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমন, বিশেষ অস্ত্র অভিযান, আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তিদের সুরক্ষা, অন্যান্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং তাৎপর্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষার উদ্দেশ্যকে সফল করতে ‘বাংলাদেশ আমার অহঙ্কার’ এই নীতিবাক্যকে সামনে রেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০০৪ সালে ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, আনসার ও ভিডিপি, বিজিবি, কোস্টগার্ড এবং পুলিশ সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় চৌকস বাহিনী র্যাব এবং ১৪ এপ্রিল তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
ক্ষমতা ও অর্থ এই দু’টির লোভ যেকোনো (সামরিক-বেসামরিক) মানুষকে যেকোনো সময় বিপথে পরিচালিত করতে পারে। তাই দুর্নীতি যেন পেয়ে না বসে এ জন্য কোনো সদস্য বড়জোর দুই বছরের বেশি র্যাবে দায়িত্ব পালন না করে তার নিয়ম করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা সব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি; বরং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত চৌকস একটি বাহিনীকে ক্ষমতা ও প্রমোশনের লোভ দেখিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা শুরু হলো। নিয়মবহির্ভূত করে সামরিক সদস্যদের চার থেকে সাত বছরের বেশি সময় ডেপুটেশনে র্যাবে যুক্ত করায় বিপজ্জনকভাবে দুর্নীতি বাড়তে থাকল।
এর ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, চার থেকে সাত বছর পর সামরিক সদস্যরা যখন তাদের স্থায়ী কর্মস্থলে ফেরত আসেন তারা সমস্ত নিয়ম এবং নৈতিকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথেও অন্য রকম আচরণ করতে শুরু করেন। যার কারণে সামরিক বাহিনীর নীতি-নৈতিকতায় আঘাত শুরু হয়। যার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত র্যাবে কিছু কিছু কর্মরত অফিসার সামরিক বাহিনীর চরম ক্ষতি করেছেন। অনেক অনেক টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর ভাবমর্যাদা নষ্ট করেছেন। হজরত আলী রা: ছিলেন শক্তিশালী ও সাহসী বীর। তার তেজস্বিতা, অসীম সাহস ও শৌর্যবীর্য সর্বজনবিদিত ছিল। হজরত আলীর আর্মিকে নিয়ে একটি মন্তব্য হলো- সেনাবাহিনীকে সাধারণ জনগণের দৃষ্টির বাইরে রাখতে হবে, কারণ তাদের ভূমিকা লড়াইয়ে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, মহিলাদের দ্বারা সেনাদের তিরস্কার হতে, এর মধ্যে ক্যাপ্টেন আশিকের ধৈর্য ধারণের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে বীরত্বের পরিচয় দেয় কিন্তু ঘটনাটি অন্যরকমও হতে পারত।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সশস্ত্রবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ায় উভয় সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। নৈতিকভাবে পুলিশের চেইন অব কমান্ড এবং যে মনোবল ভেঙেছে, সেটি ঠিক হলে সাথে সাথে তাদের তুলে নেয়া উচিত। না হলে ভাবমর্যাদা নষ্ট হওয়ার অনেক সম্ভাবনা আছে। যেমন- দু-একটি শাস্তিমূলক ঘটনার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ তা-ই প্রমাণ করে। দীর্ঘদিন এ ক্ষমতা থাকলে তাহলে সশস্ত্রবাহিনী দেশের মানুষের আস্থা হারাবে।
সশস্ত্রবাহিনীর সেনাদের একটি সামরিক ভূমিকা রয়েছে এবং দেশরক্ষায় বাঘের মতো ক্ষিপ্রতা, লড়াকু মনোভাব, অজেয় শক্তি, সাহসিকতা তাদের সবসময় অন্তরে ধারণ করা বাধ্যতামূলক। তাদের কাজে, দায়িত্বে শারীরিক বা মানসিক দুর্বলতার কোনো স্থান নেই। দিনে দু’বার ভাত খাওয়ানোর ফলে কর্মদীপ্ত করার বিপরীতে অলস করে তুলছে কি না তা-ও ভাবার অবকাশ আছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সবসময় তাদের ফিট থাকা জরুরি।
সেনারা যদি ক্ষিপ্র হয়ে উঠতে অক্ষম হয়, তবে তারা তাদের প্রাথমিক লক্ষ্যেই ব্যর্থ যা একটি দুর্বল শক্তি হিসেবে যুদ্ধকে নিরুৎসাহিত করে। সুতরাং, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা সামরিক বাহিনীকে দেশের জনগণের সংস্পর্শে বেশি সময় রাখলে তারা দুর্বল হতে পার। একটি দুর্বল সামরিক বাহিনী যুদ্ধ করতে সক্ষম হবে না। তাই বাঘের মতো খেলার ভঙ্গি বজায় রাখতে তারা যেন শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজস্ব ভাবমর্যাদা রক্ষা করতে পারে সে দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে। শক্তিশালী জাতীয় নিরাপত্তা একটি শক্তিশালী সামরিক চরিত্রের ওপর নির্ভরশীল, যা লড়াইয়ের শক্তিকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে সশস্ত্রবাহিনীর মনোবলের প্রভাব নিশ্চিত করে। একজন যোদ্ধার মেজাজ অর্জন করা সহজ বিষয় নয়। এটি করতে শক্তি লাগে। এটি একটি বিপ্লব।
আলেকজান্ডার ছিলেন যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সৈনিক, সামনে থেকে যুদ্ধ করেছেন, প্রতিটি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার সেনারা বুঝতে পেরেছিল যে, আলেকজান্ডার কখনোই তার লোকদেরকে এমন কিছু করতে বলবেন না বা কোথাও যেতে বলবেন না যা তিনি নিজে করতে চান না। নৈতিকতা ছিল মুখোমুখি লড়াইয়ের সব কিছু। তার ব্যক্তিগত সাহসে ও নৈতিকতা দিয়ে তাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। যুদ্ধে তাদের কোনো ভয় ছিল না। ভাগ্য আলেকজান্ডারকে মহান করেনি; বরং সাহস এবং নৈতিকতা তার জন্য একটি সাম্রাজ্য এনে দিয়েছিল। একমাত্র নৈতিকতাই পারে সৈন্যদের শক্তিশালী করে যুদ্ধে জয়ী হতে।
দেশপ্রেমিক, মর্যাদাবান ও নৈতিকভাবে শক্তিশালী সৈনিক জাতীয় নিরাপত্তার চাবিকাঠি।
তাই সামরিক বাহিনীর একজন সাবেক সদস্য হিসেবে মনে করছি, কোনোভাবেই সশস্ত্রবাহিনীর ভাবমর্যাদা নষ্ট হতে দেয়া সমীচীন নয়। নীতিনির্ধারকদের অতি দ্রুত উচিত উপযুক্ত কৌশল প্রয়োগ ও বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপে সৈনিকের মর্যাদা, সাহস, দেশপ্রেম সমুন্নত রাখা এবং রাষ্ট্র দ্বারা তাদের সুরক্ষিত করা।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা