০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১,
`

গণবিপ্লবের স্বপ্ন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ

- প্রতীকী ছবি

ভাবতেও গা শিউরে ওঠে ‘আয়নাঘরে’ আটকে রাখার মতো নিরীহ মানুষ কিভাবে প্রতি মুহূর্তে পলে পলে মৃত্যুপুরীর বধ্যভ‚মিতে নিয়তির সাথে অভিসারে কাল কাটিয়েছেন! এরা যে কেবল দুঃশাসক স্বৈরাচারের সমালোচক ছিল তা-ই নয়; এরা এ দেশে ভারতের জবর দখলেরও ঘোরতর বিরোধী ছিল। অবাক লাগে, একটি প্রতিবেশী বড় দেশের চরণে স্বৈরাচার তার রাষ্ট্রসত্তাকে এমন নির্লজ্জভাবে পেতে দিয়েছিল যে, এ দেশে কে মুক্ত থাকবে আর কে গুম, খুন, হয়রানির শিকার হবে বড় দেশটি সেটাও ঠিক করে দিতো।

ছোট দেশটির বড় বড় দলের নেতারা যখন অত্যাচারকে অদৃষ্টের পরিহাস বলে মনে করেছে তখন তরুণ প্রতিবাদকারীরা একেক জন আবু সাঈদ হয়ে শত-হাজারে বুকে বুলেট বরণ করে স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত করেছে। কত নিরপরাধ সেনাকর্মকর্তাকেও হতে হয়েছে আয়নাঘরের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার। রাশিয়ায় নিষ্ঠুর শাসক নিকোলাসের দণ্ডাজ্ঞায় এভাবেই হাজার হাজার রুশ ভিন্নমতাবলম্বীকে সাইবেরিয়ার বরফ নির্যাতনে জ্যান্ত লাশ হতে হয়েছিল; পুশকিনের মতো দেশবরেণ্য কবিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল। তফাতটা এখানেই যে, সাইবেরিয়ার নির্বাসনে মৃত ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন অমর নির্যাতন মহাকাব্যিক গ্রন্থ ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট।’ আমাদের দেশে কেউ আজ পর্যন্ত লেখেনি দিল্লি-ঢাকা শাসকচক্রের নির্যাতন স্মৃতি আলেখ্য- লেখকদের হয়তো স্মরণেও নেই, বাংলাদেশের আয়নাঘরের দুর্বিষহ নির্যাতন স্মৃতিও হতে পারে বিশ্বসাহিত্যের কিছু অমর সাহিত্যের খোরাক।

রাশিয়ায় বিপ্লব হয়েছে। দস্তয়েভস্কির লেখা পেয়েছে নতুন প্রাণ, পুশকিন পেয়েছে মরণোত্তর স্বীকৃতি। কিন্তু কী ক্ষমাহীন দারিদ্র্য আমাদের, পিলখানায় ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারকে ঠাণ্ডামাথায় খুন করা হলেও সমকালীন বাংলা সাহিত্য ও রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিচর্চায় আজো লেখা হয়নি সে ইতিহাস কিংবা শোকসাহিত্য। হায়দার হোসেন অত্যন্ত আবেগ নিয়ে বিডিআর গণহত্যার ওপর একটা গান লিখেছিলেন। গানের কথা, সুর ও গায়কী তার নিজের। স্বৈরাচারী হাসিনা ওই শোকগীতিটি বন্ধ করে দেয়।

ঠিক এভাবেই সুদানের স্বৈরশাসক ওমর আল-বশির নির্দেশ দিয়েছিল বিপ্লবী সুদানি গায়িকা আতা সালেহর গাওয়া গণ-অধিকার সঙ্গীত, যা ছিল সুদানের গণ-জাগরণের জাগরণী গীতিকা। পর্তুগালে ৪৮ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের ভিত টলিয়ে দিয়েছিল ২৪ ঘণ্টার ছাত্র-জনতার গণজোয়ার, সেই মহা-জাগরণের প্রেরণায় ছিল কয়েকটি পর্তুগিজ গণসঙ্গীত। পতন ঘটেছিল পর্তুগিজ একনায়ক অ্যান্টোনিও ওলিভার সালাজারের নিষ্ঠুর দুঃশাসন।

১৯৮৫ সালে পাকিস্তানে জনসভায় নেতারা বক্তব্য রাখার আগে কালো সালোয়ার পরা একজন অখ্যাত গায়িকা কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের লেখা একটি কবিতা গান আকারে পরিবেশন করেন। ওই গানের গভীর অন্তদর্শন এবং গায়িকার দরদি গায়কী গোটা সভাস্থলকে পরিণত করে প্রতিরোধের রণাঙ্গনে। আমাদের দেশে ২০২৪-এর জুলাই মহা-জাগরণে প্রেরণামন্ত্র হয় মৌসুমির গাওয়া ‘ও দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো ছলাকলা/কিছু বললেই ধরছো টিপে জনগণের গলা।’ কিংবা ‘কী করেছে তোমার বাবা, কী করেছে স্বামী/ সে সব কথা তোমার চেয়ে কম জানি না আমি?’ এই সব জাগরণী গান। পাকিস্তানের ওই গায়িকার নাম ইকবাল বানু। ব্রাজিলে গীতিকার কোয়েলহোকে ১৯৭৪ সালে গুম করা হয়। তার অপরাধ তিনি প্রতিবাদী গায়ক দল (এলিস রেজিনা, রিটালি এবং রাউল সিক্সাসের জন্য) গীতিকবিতা লিখে দিতেন।

এই বিপ্লবী গানগুলো ব্রাজিলে স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদকে দিয়েছিল গীতিরূপ। এভাবে দেশপ্রেমিক গায়ক-গায়িকারা ১৯২০-এর দশকে পূর্ব জার্মানিতে, ১৯৭০-এর দশকে ল্যাটিন আমেরিকায়, ১৯৮০-১৯৯০ দশকজুড়ে চীনে তখনকার এক নায়কদের গণবিরোধী শাসনের প্রতিবাদে জনগণকে উজ্জীবিত করেন প্রতিশোধের গানে, প্রতিবাদী কবিতা, নাটক, উপন্যাস এবং চিত্রাঙ্কনের মধ্য দিয়ে।

সাহিত্যের বুলেট দিয়ে চিন্তার রণাঙ্গনে দুঃশাসকদের বিরুদ্ধে মানসিক যুদ্ধের প্রতীক কর্মের মধ্যে রয়েছে ১৯৪৯ সালে বের হওয়া জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস ১৯৮৪ এবং আলদাউস হাক্সলির লেখা Brave New World.

আর্কাইভের স্টুডিও টেপ বা ফিতার স্পুলে আজও অক্ষয় অব্যয় হয়ে আছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের যে উজ্জয়নী গানগুলো তার মধ্যে স্মরণীয় হলো হিটলারের নাৎসিবাদের ওপর ‘Eak-e-Mouse’এর গান, জোসেফ স্ট্যালিনের ওপর Lousiana Red, ক্রুশ্চেভের ওপর Red’s Dream; প্রতিবাদী ব্যান্ডদল স্টেপেন ওলফ John Kay; পূর্ব জার্মানিকে নিয়ে লেখা Renegade, আর্চি রশের Take the Children Away; ইদি আমিনের ওপর গান - Cult with No Name; তুতসি গণহত্যার শোকগীতি Down in Rwanda; Dub Syndicate; টম রবিনসন ব্যান্ডদলের Power in the Darkness; নেগেটিভল্যান্ডের Christianity is Stupid, টড রান্ডগ্রেনের Tin Foilt Hat; ক্রাসের পরিহাসগীতি Bloody Revolutions; হোজিয়ারের অ্যালবাম Nina Cried Power, চিকোবার্ক ও মিলটন ন্যাসিমেন্টোর Calice; বিটল্সের অমর গান Revolution-1, উইনান পেজেপিনের Let My People Go; ক্যাথেরিন গ্রেইনডর্জের The Dictator, মেলোডিয়ানসের River of Babylon; মার্ক নফলারের Done with Bonaparte; পোল্যান্ডের অমর দেশাত্মবোধী গান We will meet you in Poland; মার্ক লিম্বার্টের Tomorrow Belongs to me; উডি গুথরির Tear the Fascists Down; র‌্যান্ডি নিউম্যানের Putin; জেনিস আয়ানের God and the FBI প্রভৃতি। তবে সর্বকালের সব ইতিহাসে অনৈক্য, জাতিভেদ, সমাজপতিদের শোষণ, লুণ্ঠন, নিপীড়ন এবং ঔপনিবেশিক দখলদারির বিরুদ্ধে সাম্য ও মানবিকতা, মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার অমর অজেয় সুর ও বাণীর মহাতরঙ্গের স্রোতমুখ হলেন বাংলা সাহিত্যের বাদশাহ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তারপরই আসে কবি ফররুখ আহমদের নাম।


বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমরা দেখেছি পাবলো নেরুদার কবিতা কিভাবে তার দেশসহ আরো কয়েকটি দেশে বিপ্লব ও জাগরণের বারুদ হিসাবে কাজ করেছে। তার কাব্য-অস্ত্রের বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে চিলির একনায়ক গ্যাব্রিয়েল গনজালেজ ভিদেলার ক্ষমতার মসনদ (১৯৪৭)। এজন্য গ্যাব্রিয়েল নেরুদাকে জেলে পোরে, ঠিক যেমনটা করেছিল ব্রিটিশরাজ নজরুলকে।

বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদের একটা কবিতার একটা লাইন ১৯৭১ পরবর্তী মুজিবীয় দুঃশাসন এবং দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদলিপি হয়ে রইবে অনন্তকাল (ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো!)।

স্বৈরাচারের বছরগুলোয় মানুষ বোবা কান্না কেঁদেছে বাংলাদেশে। সেই অব্যক্ত রোদনের অভিব্যক্তি গভীরভাবে ফুটে উঠেছে কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেনের কান্নাবিজড়িত গানে (বিডিআর গণহত্যার স্মারকগীতি ‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার/বুকের ব্যথা বুকে চাপাইয়া নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার/কতটুকু অশ্রæ গড়ালে হৃদয় জলে সিক্ত/কত প্রদীপ শিখা জ্বালালে জীবন আলোয় দীপ্ত/কত ব্যথা বুকে চাপাইলে তাকে বলি আমি ধৈর্য/ নির্মমতা কত দূর হলে জাতি হবে নির্লজ্জ?’

স্বৈরাচার ১৮ কোটি ব্যথাতুর মানুষের এই বোবা কান্নাকেও নিষিদ্ধ করেছিল। তবে জুলাই-আগস্টের তরুণ কণ্ঠের প্রতিবাদী গান নিষিদ্ধ করার আগেই দেশ থেকে স্বৈরাচার নিজেই হয়ে গেল নিষিদ্ধ! তারুণ্যের এই প্রতিবাদী স্লোগান, গান, দেয়ালচিত্র, বাণীলিপি, গ্রাফিতি, কুরআনের অমর বাণীর গ্রাফিতি, যেগুলো জাতির হৃদয় প্রাচীরে চিরদিন অমলিন শোকলিপি হয়ে বিরাজ করবে সেগুলো দেখে মুগ্ধ হন এবং বিস্ময় প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সেই উৎকলিত লিপিমঞ্জুরি দেশের এই অজেয় তারুণ্য (জেনারেশন-জি) এর ব্যতিক্রম এবং তাদের অপরিমেয় দেশাত্মবোধের প্রকাশ।

সে রকমই বেশকিছু গানের লেখক, সুরকার এবং গায়ক হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারশা মাহজাবিন। তার অসাধারণ গান ‘চলো ভুলে যাই’ জুলাই ছাত্র-জনতা-সৈনিকদের গণ-বিপ্লবের অর্কেস্ট্রায় অমর হয়ে থাকবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে তার লেখা ও গাওয়া এ ধরনের প্রতিবাদী গানগুলো কালজয়ী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হয়ে থাকবে। ২৮ জুলাই গানটি নিয়ে তিনি হাজির হন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইউটিউবে। সাথে সাথে ভাইরাল! এসব জাগরণী গান শুধু দেশবাসীকেই নয়, দেশের জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার মন্ত্রণা জুগিয়েছে লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশীকেও। তার ফলাফলও জাতি প্রত্যক্ষ করেছে হাতেনাতে। এবারের দেশ জাগানো, দুনিয়া কাঁপানো ছাত্র-যুবক-সিপাহি গণজাগরণে অন্যতম প্রধান অংশীদার বা স্টেকহোল্ডার ছিলেন বৈদেশিকমুদ্রা যোদ্ধা এই সব প্রবাসী ভাইবোনেরা, যারা সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন এই জালিম স্বৈরাচারকে উৎখাত করে দেশকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এবং একটি নতুন ও বাসযোগ্য বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতে এবং দেশপ্রেমের এক নতুন বিন্যাস রচনা করতে।


আরো সংবাদ



premium cement