২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
আওয়ামী ‘গুম’ কালচার

ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর সাক্ষ্য

- প্রতীকী ছবি

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। কোটা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে আমি গত ১৬ বছরের ‘আওয়ামী জাহেলিয়াতে’র ভুক্তভোগী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের ছাত্র অবস্থায় বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হিসেবে টানা ২২ মাস জেল খেটেছি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড আটকে দেয়া, ভর্তি কমিটির সুপারিশে অ্যাডমিট কার্ড ডাউনলোড করে টিএসসিতে বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার পরও ‘ভাইভা’ না ডেকে রহস্যজনকভাবে ভর্তির সুযোগ থেকে বাদ দেয়া, উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই চালিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়া, ২০১৮ সালের ঐতিহাসিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে হলছাড়া হওয়া, ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন, ২০১৯ সালে গুমের শিকার এবং সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি ঘোষণাসহ মাঠে থাকার শত সহস্র সুখ-দুঃখের স্মৃতি আমার মাথায়।

হল ছাড়া করেছিল ছাত্রলীগ
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি লেখালেখি, সাংবাদিকতা, বিতর্ক চর্চা, সাহিত্য চর্চার আন্তরিক চেষ্টা করেছি। টিএসসিতে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি’র পাশাপাশি হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে ‘মুহসীন হল ডিবেটিং ক্লাবে’ বিতর্ক চর্চা করতাম। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রিত রুমে থেকে ‘সাংবাদিকতা ও বিতর্ক চর্চা’ অনেকটা পানিতে নেমে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করার মতো।

হল প্রশাসনের কাছে বারবার আবেদন করেও হলে ‘সিঙ্গেল’ আবাসিক সিট বরাদ্দ না পাওয়ায় তৎকালীন ভিসি স্যারের সুপারিশে ২০১৭ সালে আমাকে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র হিসাবে একটি রুম বরাদ্দ দেয়া হয়। পরে সেটা পাল্টে আরেকটি রুম দেয়া হয়। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাধায় রুমে উঠতে পারিনি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত থাকায় ২০১৮ সালের ৪ মার্চ রাতে আমাকে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ৩৫১ নম্বর রুম থেকে মারধর করে বের করে দেয় ছাত্রলীগ নেতা তারেক হাসান নির্ঝর এবং মেহেদী হাসান সানীর সাঙ্গোপাঙ্গরা। তাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী স্যার আশ্বাস দেন, তার কাছে অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেবেন। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ প্রক্টর অফিসে অভিযোগ দিই। প্রক্টর স্যারের নির্দেশে মুহসীন হলের তৎকালীন প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্ত কমিটি ওই বছরের মার্চের শেষ দিকে আমার এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য রেকর্ড করেন। কিন্তু বারবার লিখিতভাবে আবেদন করলেও আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত রিপোর্ট পাইনি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হল প্রশাসন আমাকে বরাদ্দ করা রুমটিও বুঝিয়ে দিতে পারেননি। বাধ্য হয়ে আমাকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে।

আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকায় ছাত্রলীগের ‘টার্গেট’ ছিলাম
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০১৯ সালে মার্চ মাসে ডাকসু নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন, আগস্ট মাসে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের প্রতিবাদে আন্দোলন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার দাবিতে আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে জড়িত ছিলাম। কখনো কোনো রাজনৈতিক দলে যাইনি। তবে বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি, এখনো করছি। ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কোটা সংস্কার আন্দোলনের ‘আইন-আদালত’ সেলের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছি।

আমাকে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বেশ কয়েকবার পুলিশ এবং ছাত্রলীগ আটক করতে এসেছে। আমি বরাবরই সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে যেতে পারতাম। ফলে আটক করতে পারেনি। নুরুল হক নুরসহ সবাইকে প্রকাশ্যে মারধর করলেও ছাত্রলীগ কখনো আমাকে প্রকাশ্যে মারত না। গণমাধ্যমকর্মী বলে সব সময় অলিগলিতে নিয়ে মারত।

আন্দোলনের কারণেই ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্যাটাগরিতে কোটা বাতিল করে সরকার। কিন্তু তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতে কোটা সংস্কার না করায় আন্দোলন অসমাপ্ত রয়ে যায়।

অসমাপ্ত আন্দোলন সমাপ্ত করার তাগিদ
অসমাপ্ত কোটা সংস্কার আন্দোলন ‘সমাপ্ত’ করতে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের শুরুতে আন্দোলনের সহযোদ্ধা আল আমিন রাজু, চাকরির বয়স বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনকারী আইন বিভাগের ছাত্র শরিফুল হাসান শুভ, বাম ছাত্রনেতা আরমানুল হক, ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর প্রতিনিধি বাদল হাজং, প্রতিবন্ধী সমাজের প্রতিনিধি মিলন ঘরামী প্রমুখকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করি।
হামলা চালিয়ে, মামলা দিয়ে, জেলে বন্দী করে যখন আমাকে থামানো গেল না, তখন গুম করার সিদ্ধান্ত হয় বলে শুনেছি।

গোয়েন্দাদের গতিবিধি, গুমের আশঙ্কা
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে হাতিরপুলের একটি বাসায় থাকাকালীন কিছু গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাকে নিয়মিত ফলো করত। যেখানেই যেতাম, সেখানেই তারা আমাকে অনুসরণ করত।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ২০১৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর রোববার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পেছনে নাটমণ্ডলের গেটের সামনে বসার টেবিলে মাথা রেখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। মোবাইল অন রেখে পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছি, নির্জন স্থানে লুকিয়ে থাকলে কেউ আমাকে ফলো করতে আসে কিনা? কৌশলটি কাজে লাগে। কিছুক্ষণ পর তিনজন লোক এসে আমাকে বলেন যে, আপনি তো নাটমণ্ডলের কেউ না। আপনি এখানে কেন? বললাম, ‘তাহলে আমি কোন বিভাগের স্টুডেন্ট? তারা জানালেন, আপনি টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফির স্টুডেন্ট। বললাম, আমি কোন বিভাগের স্টুডেন্ট সেটা আপনারা কিভাবে জানেন? কোনো উত্তর নেই।
সেখান থেকে উঠে আমি কেন্দ্রীয় মসজিদের ভিতরে বারান্দায় গিয়ে রেস্ট নিই। তখনো গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাকে অনুসরণ করে। সেখান থেকে জোহরের নামাজের পর আমি দুপুরের খাবার খেতে হাতিরপুলের বাসায় চলে যাওয়ার সময় আরেকটি দল আমাকে ‘ফলো’ করে। তাদের একজন কালো বোরকা পরা মহিলা এবং সাদা পাঞ্জাবি টুপি পরা পুরুষ ছিল।

আমি তাদেরকে ‘ধোঁকা’ দিয়ে ‘বোকা’ বানিয়ে পরীক্ষা করার জন্য পিজি হাসপাতালসংলগ্ন রাস্তায় হঠাৎ ‘ইউটার্ন’ নিয়ে রোগীদের বসার জায়গায় বসে পড়ি। তারা পেছনে হাঁটা শুরু করে। আমি তখন নিশ্চিত, আমাকে গুম করার জন্য গোয়েন্দারা অনুসরণ করছে।

বিকেলে তৎকালীন ভিসি আখতারুজ্জামান, প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানীসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানালে তারা কোনো আশ্বাস দেননি। সন্ধ্যায় সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারের ইন্টারন্যাশনাল হলসংলগ্ন বাসায় গিয়ে ‘সম্ভাব্য’ গুমের কথা জানাই। তিনি আমাকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

গুম এড়াতে হলে অশ্রয় নিই
আমি তখনো হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের বৈধ আবাসিক ছাত্র। কিন্তু রুমে থাকতে পারি না। তখন ঢাকা শহরে ‘গুম’ এড়ানোর মতো একটা জায়গা খুঁজছি। কোথাও জায়গা না পেয়ে ভাবলাম হলেই থাকব। হল থেকে গুম করলে আবাসিক ছাত্র হিসেবে হল প্রশাসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায় থাকবে। তাই ২ সেপ্টেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ২০১১-১২ সেশনের বন্ধু, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মিলন ঘরামীর ৩ এর (ক) রুমে থাকার আবদার করি। সে আমাকে থাকতে দেয়।

৩ সেপ্টেম্বর সকালে আমাকে গোয়েন্দাদের অনুসরণের বিষয়টি আমার বিভাগের আমার ব্যাচের ‘সি আর’ এর মাধ্যমে স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার ইমরান স্যারকে জানাই। হলে অবস্থানকালে দুপুরের পর থেকে আমার মোবাইলের স্ক্রিনে একটি লেখা ভেসে ওঠে! ‘A car is riding around you’- (একটি গাড়ি আপনার আশপাশে ঘুরছে)। বুঝতে পারি, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমার ‘অবস্থান’ শনাক্ত করছে। এরপর মোবাইলে আমার কাছে অটোমেটিকালি অতীতের বিভিন্ন আজেবাজে রাজনৈতিক নিউজের লিঙ্ক আসে।

মূলত এভাবে আজেবাজে নিউজ পাঠিয়ে কোন ব্যক্তির অবস্থান শনাক্ত করা হয়। তাকে তথ্যপ্রযুক্তির ভাষায় বলা হয়, ‘ফিশিং’। সেদিন আসরের নামাজের পরেই ওই রুমে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা একের পর এক আসতে এবং যেতে থাকে। আমার সামনেই শিবিরের বিভিন্ন সাংগঠনিক বই, ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন বই রেখে যায় ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব। বিপ্লব হলো হল ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সানীর বন্ধু।

তখন আমার মোবাইলের নেটওয়ার্ক অচল। নেটওয়ার্ক অচল হওয়ার আগে ফেসবুকে ধারাবাহিক কিছু পোস্ট করি, যেখানে গুমের সম্ভাব্য বিষয়টি জানিয়ে দিই। ফলে আমার রাজনৈতিক সহকর্মী, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহযোদ্ধা ও গণমাধ্যম কর্মীরা বিষয়টি আন্দাজ করতে পারেন।

ছাত্রলীগ ও হল প্রশাসনের সহায়তায় গুম
ঠিক মাগরিবের নামাজের সময় তারা আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চায়। আমি হল থেকে বের হতে রাজি ছিলাম না। একপর্যায়ে তারা মুহসীন হলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী রাসেলকে নিয়ে আসে। তিনি আমাকে বলেন, ‘আপনাকে হল প্রশাসন ডাকছে।’

ইতোমধ্যে আমার মোবাইল, মানিব্যাগ নিয়ে যায়। পরে মোবাইল ফেরত দেয়া হয়। হল প্রশাসনের কথা বলায় আমি বের হতে রাজি হই। মাগরিবের আজানের সময় রুম থেকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের ছাত্র ও হল ছাত্রলীগ নেতা শাহরিয়ার মাহমুদ জিসান (পিতা আব্দুল বাতেন চৌধুরী, গ্রাম : ভাগলপুর, উপজেলা : সাভার, ঢাকা, হলে অনাবাসিক) এবং থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের ছাত্র মো: তরিকুল হক (পিতা: শামসুল হক, গ্রাম : আন্ধারমানিক, উপজেলা : মঠবাড়িয়া, জেলা : পিরোজপুর, হলে আবাসিক) এর নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী আমাকে বের করে নিয়ে যায়।
তারা যখন আমাকে মুহসীন হলের নিচতলায় সেলুনের কাছে নিয়ে আসে, তখন তাদের সাথে যোগ দেন হলের আরেক কর্মচারী শিবলু। এরপর শিবলুসহ আমাকে হলের গেস্ট রুমে নিয়ে আসে। গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়ার পরই আমার ‘মুখে এবং চোখে’ কাপড় বেঁধে মাথায় ইনজেকশন পুশ করে। ফলে আমার ‘ব্রেন’ টালমাটাল অবস্থায় চলে যায়। আমি তখন কাউকে চিনতে পারছি না।

হলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সাইফুল ইসলাম রিপনসহ কয়েকজন কর্মচারীর সহায়তায় ছাত্রলীগ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা গেস্টরুম থেকে নিয়ে আমাকে হলের গেটে আগে থেকে অপেক্ষারত পুলিশের গাড়িতে তোলে। তখন মুহসীন হলের গেট থেকে দক্ষিণ দিকে যতদূর দেখা যায়, ততদূর পর্যন্ত মোটরসাইকেলের মহড়া দেখা যায়। পুলিশ আমাকে বলে, ‘পেছনে সব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী। গুলি করলে তুমি মাথা নিচু করে এখানে (গাড়ির মেঝেতে) শুয়ে পড়বা।’

এরপর আমাকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় সার্জারি রুমে নিয়ে নানা প্রশ্ন করেন অজ্ঞাত লোকজন। শেষ প্রশ্ন ছিল, তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসো নাকি তোমার জীবনকে ভালোবাসো? বললাম, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসি।’ ‘এই তো সাবাস বেটা। ঠিক আছে তোর কথা উপরের লেভেলকে জানিয়ে দিচ্ছি।’

জিহ্বায় ইলেকট্রিক শক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারের বিছানায় শুইয়ে আমার জিহ্বায় ইলেকট্রিক শক দিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ করে ফেলে। বিছানার বালিশের পাশে দু’টি পয়সা রাখা হয়। আমার ব্রেন তখন টালমাটাল। ব্রেন একটু স্থির হলেই পয়সাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতাম। সেখানে মুহসীন হলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সাইফুল ইসলাম রিপন উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাকে শিখিয়ে দেন, তুমি বলো, ‘Go and stop’. এর কিছুক্ষণ পর নির্যাতনকারীরা তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে যায়।

আমার মস্তিষ্ক স্থির হলে আমার পরিচিত এলাকার দুই ছোট ভাইকে কল দিই। তাদের মধ্যে একজন শহীদ মিনারে ছিল। পরে আমার এলাকার তিনজন ছোটভাই এসে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি।

তখন একজন ছোটভাই আমাকে ফজলুল হক মুসলিম হলের এক্সটেনশন ভবনের নিচতলায় তার রুমে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে আমার বড়ভাই এসে আমাকে চট্টগ্রামে নিয়ে ডাক্তার দেখান। ১০ থেকে ১২ জন ডাক্তারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রায় দুই বছর চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি।

বিচার করেনি আওয়ামী প্রশাসন
আমি হলের তিনজন কর্মচারী এবং ছাত্রলীগের দু’জন নেতাকে চিনতে পেরেছিলাম। বাকিদের চিনতে পারিনি। আমার গুমের সঙ্গে জড়িত সবার শাস্তির দাবি জানিয়ে ২০২২ সালের জুন মাসে তৎকালীন উপাচার্য আখতারুজ্জামান স্যারের কাছে আবেদন করি। তিনি মুহসীন হলের প্রভোস্ট মো: মাসুদুর রহমানকে বিষয়টি ফরওয়ার্ড করে দেন। হল প্রশাসন তদন্ত কমিটি না করে উল্টো আমাকে হয়রানি করার জন্য ছাত্রলীগের ছেলেদেরকে দিয়ে আমাকে ‘জঙ্গি’ সাজিয়ে অভিযোগ আনার ব্যবস্থা করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আমি স্পষ্ট বলেছি, আমাকে কমিটির সভায় ডাকলে লিখিত চিঠি দিয়ে ডাকবেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে বিশ্বাস করি না। শেষ পর্যন্ত তদন্ত কমিটি আমার কাছে হার মানে। আমাকে লিখিতভাবে চিঠি দিয়ে ডাকে। আমার বক্তব্য নেয়। আজ পর্যন্ত এ রিপোর্ট আমাকে দেয়া হয়নি। ২০২৩ সালের নভেম্বরে নবাগত ভিসি এ এস এম মাকসুদ কামাল স্যারকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানোর জন্য গেলে তিনি গ্রহণ করতে রাজি হননি। পরে ডাকযোগে ‘এডি’সহ অভিযোগ পাঠিয়ে দিই। ১৯ ডিসেম্বর আমার কাছে চিঠির প্রাপ্তিস্বীকারপত্র আসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

বর্তমান প্রশাসনকে জানিয়েছি
আমাকে গুমের পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পরদিন গত ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান স্যারের কাছে গুমের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তথ্যসহ সার্বিক সহযোগিতা চেয়ে একটি দরখাস্ত দিয়েছি।

গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে অভিযুক্ত মো: তরিকুল হককে (ফেসবুক আইডি রিয়াজ তারেক) দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ স্যারকে মোবাইলে কল দিই। তিনি আমাকে প্রক্টরিয়াল ‘টিম’ পাঠানোর আশ্বাস দেন। কিন্তু পাঠাননি। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত পালিয়ে যায়।

শুধুমাত্র আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, তাদের পোষা দোসর ও দালালদের সাথে আমার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। গুমের মতো একটি ‘জঘন্য’ অপরাধের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক না করায় আমি অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদের শাস্তির দাবিতে গত ১১ সেপ্টেম্বর ভিসির কাছে লিখিত অভিযোগ দিই।

একসময় ঢাবির ডিবেটিং সোসাইটি ও কুইজ সোসাইটিতে ভালো ‘পারফরম্যান্স’ করতাম। গুম করে জিহ্বায় কারেন্টের শক দেয়ার কারণে এখন স্পষ্ট করে কথাও বলতে পারি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে গুমের বিষয়ে ন্যায়বিচার পেতে আমি আদালতের আশ্রয় নিতে চাই। অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাসহ গুমের সাথে জড়িত সবার শাস্তি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement