০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১, ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বিরাজনীতিকরণ

- প্রতীকী ছবি

গত পনেরো বছরেরও অধিক সময়কাল অবৈধভাবে সরকার পরিচালনা করে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে রেখে গেছে। এ সময়ে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ পৌঁছেছে কমবেশি ১০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। সরকারের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তাদের পদলেহীরা ১৫০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। স্বৈরাচারী সরকার কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ কোটি টাকা ছাপিয়ে দেশের মুদ্রাস্ফীতিকে ডাবল ডিজিট ফিগারে নিয়ে গেছে। দেশে কোনো নাগরিক সুবিধা এখন সহজলভ্য নয়। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনধারণ করাই এখন দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসীন হলে, মানুষ তাদের অবস্থা পরিবর্তনের বিষয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এই অবস্থা থেকে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনা কি খুব সহজ? মোটেও না। বাংলাদেশটাকে এমনভাবে শুষে নেয়া হয়েছে যে এদেশটাকে পূর্বের অবস্থায় ফেরত নিয়ে যাওয়াটাই প্রায় অসাধ্য, আর বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত অবস্থায় নেয়া তো প্রায় অসম্ভব। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম যেখানে ছিল তিন টাকার মতো, তা এখন স্ল্যাব বিশেষে ১৫ টাকার কাছাকাছি। ওয়াসার পানির দামও একই হারে বেড়ে গেছে কিছু মানুষের অদম্য লোভের কারণে। সব ব্যবসায়ে সিন্ডিকেট করে জনগণের পয়সা লুটে নেয়ার কারণে দেশে উৎপাদিত/আমদানিকৃত সব ভোগ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। দেশে এখন একটি প্রতিষ্ঠানও নেই যা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়েনি। এ কারণেই অনেকে মনে করছেন যে দেশে বিরাজনীতিকরণ করা হলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।

বিরাজনীতিকরণের ধারণাটা এ দেশে নতুন না। পাকিস্তানি শাসনামলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হাতেই বেসিক ডেমোক্র্যাসি নামক এক সার্কাসের মাধ্যমে আইয়ুব খানের ১০ বছরের শাসনকাল নির্বিঘ্ন এবং একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি হলেও জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরবর্তীতে গণতন্ত্রের জন্য এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও শেখ মুজিবের শাসনামলেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের দ্বারা ওই বিরাজনীতিকরণ করারই চেষ্টা হয়েছিল।

শেখ মুজিবের বিয়োগান্ত পরিণতির পর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থাকে বাতিল করে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার আগেই ঘাতকের বুলেট রাষ্ট্রপতি জিয়াকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। তারপর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করে ৯ বছরকাল স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চালান। এরপর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতন হলে দেশ আবার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ এ তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে যখন একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভের পথে, তখন বিএনপি নেতৃত্বের একটি ভুলকে পুঁজি করে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ দেশে এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক শাসন নেমে আসে এ দেশের ভাগ্যে।

২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্ববধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেই সেই পুরনো খেলা অর্থাৎ বিরাজনীতিকরণের উদ্যোগ নেয়। তারা প্রথমে ‘মাইনাস-২’ ফর্মুলার মাধ্যমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে তাদের পছন্দমতো লোকদের নেতৃত্বে এনে দু’টি দলকেই নতুনভাবে সাজিয়ে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে একটি পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় এনে তার মাধ্যমে অনির্ধারিতকাল ক্ষমতাকে হাতে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু দেশবাসী সে পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। আর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন মনোভাবের কাছে পরাভব মেনে সে সরকার ভারত ও পাশ্চাত্যের পরাশক্তির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী একটি প্রায় নিখুঁত পরিকল্পনা ও তার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনে নিজেরা বিদায় নেয়।

এরপর গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামল তো প্রকৃতপক্ষে ছিল একদলীয় শাসনব্যবস্থা। এই সময়কালে দেশে সরকারি দল ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নিয়মিত কার্যকলাপ চালানো তো দূরের কথা, ছোটখাটো রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করাও দুঃসাধ্য ছিল। এ সময়ে শুধু বিএনপিরই ৪২৩-এর অধিক নেতাকর্মীকে গুম, প্রায় ১৬০০ নেতাকর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর বিচারিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীকে প্রায় নেতৃত্বশূন্য করে ফেলা হয়েছে। এই সময়কালে প্রায় এক লাখ গায়েবি/ভুয়া মামলায় বিএনপির প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করে তাদেরকে আদালতপাড়ায় বন্দী করে রেখেছিল।

ভাবা যায়, বিএনপির একজন নেতার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৫০০ এর অধিক ছিল? দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের বিরুদ্ধে ১০২-টারও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছিল? সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আওয়ামী লীগ যে প্রায় সাড়ে ১৫ বছর দেশ চালাল, তাদেরও প্রকৃত অর্থে কোনো রাজনীতি ছিল না; এমনকি দল হিসাবে আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় ছিল না। ক্ষমতায় ছিল শেখ পরিবার ও তাদের মদদপুষ্ট একটি লুটেরা গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হলো যে কোনো প্রকারে ক্ষমতায় থাকা এবং অর্থ উপার্জন করা। ক্ষমতাসীনরা এই দুটো কাজেই সফল হয়েছে, প্রয়োজনমাফিক নতুন নতুন রাজনৈতিক বয়ান সামনে এনে। কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, কখনো যুদ্ধাপরাধ, কখনোবা বিএনপি আমলের কথিত দুর্নীতিকে সামনে এনে তাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যস্ত রেখে। বস্তুত এই কাজটি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব দেশকে বহু ভাগে বিভক্ত করে মন্ত্রী, এমপি বা বড় আমলাদের হাতে তুলে দিয়ে দেশের সব উন্নয়নকাজ থেকে ও অপরাধ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। এ কারণেই আমরা আজিজ, বেনজীর বা জাভেদের মতো নিকৃষ্ট চোরদের দেশের শীর্ষ পদগুলোতে দেখতে পেয়েছি। আর তাই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের পলায়নের সাথে সাথে দেশের সব মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী, এমনকি বিচারকরা পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হলো দেশের সবচেয়ে বড় দলের দাবিদার এই দলটির কার্যালয়ে বাতি জ্বালানোর মতো কেউ এখন আর দেশে নাই।

স্বৈরাচারী আমলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেকটা জেলখানায় পরিণত হয়েছিল। যে অপরাজনীতি আবরার ফাহাদের মতো মেধাবী ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করে, তার ফিরে আসা কোনোভাবেই এ দেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। স্বৈরাচারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন ছাত্রদের হলে থাকা নির্ভর করত ছাত্রলীগের অনুমোদনের ওপর, যা পাওয়া যেত ছাত্রলীগের মিছিল বা কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার মাধ্যমে।

বাংলাদেশের জনগণ বিরাজনীতিকরণের প্রয়াসকে কোনোদিন মেনে নেয়নি এবং ভবিষ্যতে যে মেনে নেবে, সে আশা অলীক কল্পনা। আমাদের দেশে রাজনীতিচর্চাকে অবাধ ও অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে দেশের মানুষদের আরো রাজনীতি সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে কোনো দল তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে জনগণ ও দেশের কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

বিরাজনীতিকরণের ধারণাটা পুরনো হলেও এই শতাব্দীর শুরু থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক ও জাতিসঙ্ঘ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামরিক, বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার পক্ষে সুপারিশ করে আসছে। তাদের যুক্তি হলো এর মাধ্যমে দেশগুলোর আমলাতন্ত্রের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে, যা এই দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক ঋণ লাভের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে এবং তা পরিশোধের সক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশের সা¤প্রতিক অভিজ্ঞতা এই ধারণাকে সমর্থন করে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে আমরা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এর সাথে যোগ করতে পারি।

এ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির ভয়াল রূপ আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি। ১৯৭৩ সালের ‘বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স’ তার কাক্সিক্ষত ভ‚মিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এটিকে সংশোধন করে যুগোপযোগী করতে হবে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব পান। দেশের ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতি সচেতন হতে কোনোকিছুই যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকটা লক্ষ্য রাখতে হবে। ভুললে চলবে না, এ দেশের সব বড় অর্জনের পেছনে ছাত্রদের ভ‚মিকা ছিল। ছাত্র-শিক্ষকদের বাকস্বাধীনতা তথা স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষমতাকে ক্ষুন্ন করে এমন কোনো কিছুকে মেনে নেয়া যাবে না। আর এই বিষয়গুলোতে শুধু আইন পাস করলেই হবে না, এ জন্য প্রয়োজন এই ইস্যুতে প্রতিনিধিত্বশীল সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য, যা নিশ্চিত করতে হবে- এই সরকারকেই।

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement