অধ্যাপক আবদুল গফুর : কিংবদন্তি ভাষাসৈনিক
- এমদাদুল হক চৌধুরী
- ০১ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৪৫, আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৫৮
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বীজ রোপণ করেছিলেন ভাষাসৈনিকেরা। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল গফুর। ১৯২৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ীর দাদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তি পুরুষ অধ্যাপক আবদুল গফুর।
ভাষা আন্দোলন, তমদ্দুন মজলিস ও আবদুল গফুর
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অথচ তিনি ম্যাট্রিকুলেশন ও ইন্টারমিডিয়েটে স্ট্যান্ড করা ছাত্র। অধ্যাপক আবদুল গফুর ১৯৪৫ সালে তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সমগ্র বাংলা ও আসামের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ফরিদপুরের ময়েজ উদ্দীন হাই মাদরাসা থেকে পাস করেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, বর্তমানে যেটা সরকারি কাজী নজরুল কলেজ থেকে ঢাকা বোর্ডের নবম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ফাইনাল অনার্স পরীক্ষার মাত্র দুই মাস আগে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে তমদ্দুন মজলিসের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। সে বছর তার আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। ১১ বছর পর ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’এর সহকারী সম্পাদক পরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তার সাহসী সাংবাদিকতায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কোপানলে পতিত হন, তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করা হয়। ভাষা আন্দোলনের শক্তিশালী মুখপাত্র হিসেবে ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ ছিল সর্বমহলে প্রশংসিত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনায় জনমনে দেখা দেয় তীব্র ক্ষোভ। তখন ‘সৈনিক’ পত্রিকাটি রক্তরাঙা অক্ষরে বিচার ও প্রতিরোধের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের বেদনাকে পৌঁছে দেয় বিপুল সংখ্যক পাঠকের হাতে। পুলিশ তমদ্দুন মজলিসের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করতে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের বাসায় তমদ্দুন মজলিসের অফিসে হানা দেয়। অধ্যাপক-পত্মীর বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে তারা গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন।
অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সাপ্তাহিক ‘প্যানোরমা’য় প্রকাশিত এক স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যে নির্বাচন হয় তাতে তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাশেম তমদ্দুন মজলিসের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। অপর দিকে অধ্যাপক শাহেদ আলী, আবুল হাসেম সাহেবের খেলাফতে রব্বানী পার্টি থেকে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তবে পূর্ববঙ্গের পরিষদে মোহন মিঞা প্রমুখ সদস্যের মারামারিতে শাহেদ আলী নামক এক সংসদ সদস্য ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যান। এ ছুতোয় তখনকার সামরিক বাহিনীর প্রধান আইয়ুব খান দেশে সামরিক আইন জারি করলে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম আপাতত তমদ্দুন মজলিসের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে তমদ্দুন মজলিসের সদস্যদের নিয়ে ক্যাম্প করা বন্ধ হয়ে যায়। তমদ্দুন মজলিসের নেতাকর্মীরা নানাভাবে বঞ্চনা ও আর্থিক দৈন্যের শিকার হয়। আবদুল গফুর ও শাহেদ আলীও আর্থিক অনটনের কবলে পড়েন। এমন সঙ্কটময় সময়েও আবদুল গফুর তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি মজলিসের কর্মীদের সাথে যোগাযোগের সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।
অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেছেন, এমন সঙ্কটময় অবস্থায় আবদুল গফুর তার আবুজর গিফারী কলেজে যোগ দেন। আবুজর গিফারী কলেজ তখন নয়াটোলা থেকে মৌচাক মার্কেটের বিপরীতে স্থানান্তর হয়েছে। এর বছর খানেক পরে ‘দারুল উলুম ইসলামিক একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা হয়, যেটা পরে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনে’ পরিণত হয়। তখন তিনি কলেজের চাকরি ত্যাগ করে ইসলামিক একাডেমির ডাইরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে অধ্যাপক শাহেদ আলীও এখানে যোগদান করেছিলেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর তমদ্দুন মজলিসে যোগদানের পর তমদ্দুন মজলিসকে নিজের সন্তানের ন্যায় লালন-পালনে সদা তৎপর থাকতেন। ব্যক্তিগত আয় থেকে মজলিসের নেতাকর্মীদের আর্থিক সহযোগিতা এবং সৈনিক প্রকাশে পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাপ্তাহিক প্যানোরমায় প্রকাশিত স্মৃতিচারণে বলেন, আবদুল গফর সৈনিকের প্রকাশক হিসেবে ডিক্লারেশন নিতে গিয়ে জানতে পারেন আবুল কাশেম সাহেবের এক ছেলে তার নামে ডিক্লারেশন নিয়ে ফেলেছে। এতে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। (সাপ্তাহিক প্যানোরমা/৩১তম পর্ব/আগস্ট-২০২৩ সংখ্যা)।
অধ্যাপক আবদুল গফুরের কর্মময় জীবন
১৯৬২ সালে এম এ পাস করার আগে তিনি সাপ্তাহিক সৈনিকে’র সহকারী সম্পাদক ও পরে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তিনি চট্টগ্রামের ‘আজাদী’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার হিসেবে এক বছর চট্টগ্রামে চাকরি করেন। এরপর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন। পরে রাজেন্দ্র কলেজ সরকারি কলেজের তালিকাভুক্ত হলে, অধ্যাপক আবদুল গফুর সে চাকরি ছেড়ে দেন। কারণ, তিনি ভাষা আন্দোলনের সময়ই স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আর কখনো সরকারি চাকরি করবেন না। তিনি যদি চাইতেন অন্য দশজন ভাষাসৈনিকের মতো সচ্ছল ও আরাম আয়েশে দিন গুজরান করবেন, তাহলে তা ছিল একেবারেই সহজলভ্য। তিনি সানন্দ্যচিত্তে দারিদ্র্যবরণ করেছেন তবুও সরকারি চাকরির সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তমদ্দুন মজলিসের সাথে যুক্ত হয়ে আমি তাকে স্নেহশীল উদার হৃদয়ের মানুষ হিসেবে পেয়েছি। গফুর স্যারকে মনে হয়েছে এক বটবৃক্ষের মতো। তার জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে পাঠ করার পর অনুধাবন করেছি, সমস্ত বিপরীত স্রোতের মুখেও তিনি ছিলেন অবিচল, স্নেহশীল এক উদার হৃদয়ের মানুষ। যখন তিনি দক্ষিণ শাহজাহানপুরে থাকতেন তখন বেশ কয়েকবার আমি সেখানে গিয়েছি। গিয়েছি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেও। একবার তিনি আমাকে তমদ্দুন মজলিসের সেক্রেটারি করার জন্য তার বাসায় ডেকে নিয়েছিলেন। তখন তার সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। যাহোক, পরে কোনো এক অজানা কারণে আমাকে সে দায়িত্ব দেয়া হয়নি।
১৯৮৬ সালে অধ্যাপক আবদুল গফুর তখনকার সময়ের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইনকিলাবের সাথে যুক্ত হন। অসুস্থ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি পাক্ষিক জিন্দেগী পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে দৈনিক মিল্লাত ও ১৯৫৮ সালে দৈনিক নাজাতের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে আদর্শিক সহযাত্রী মুরুব্বিদের বিশেষ অনুরোধে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যোগ দেন। ১৯৮৯ পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৫ সালে অধ্যাপক আবদুল গফুরকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। দীর্ঘ জীবনে তিনি নানা বিষয়ের ওপর গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : বিপ্লবী উমর, সমাজকল্যাণ পরিক্রমা, কোরআনি সমাজের রূপরেখা, খোদার রাজ্য, ইসলাম কী এ যুগে অচল, ইসলামের জীবনদৃষ্টি, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, শাশ^ত নবী, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলাদেশ আমার স্বাধীনতা, স্বাধীনতার গল্প শোন, আমার কালের কথা, রমজানের সাধনা, আসমান জমিনের মালিক ইত্যাদি।
সরকারের প্রতি বিশেষ দাবি
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অধ্যাপক আবদুল গফুরের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের হাত ধরেই এ দেশে একটি সুস্থ রাজনীতির বিকাশ হয়েছিল। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে দেশ ও জাতির জন্য তিনি নানামুখী অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনে। আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ ও দৃঢ়চিত্তের এই ব্যক্তিত্ব সরকারি চাকরির লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, শুধু দেশ ও জাতির জন্য।
সর্বশেষ কথা
১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনকে বলা হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সূচক আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আসে ’৬২ ও ৬৯ গণ-আন্দোলন। এই গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ সবের মূলে ছিল তমদ্দুন মজলিস এবং অধ্যাপক আবদুর গফুরের মতো আত্মত্যাগী মনীষীরা। তাদের আত্মত্যাগের কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তিনি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। বার্ধক্যজনিত কারণে তাকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে, সেখানে তাকে কোনো আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়নি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার দাফন হয়নি। এমনকি মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার দাফনের অনুমতি দিতেও কর্তৃপক্ষ নানা টালবাহানা শুরু করে। শেষপর্যন্ত দিতে বাধ্য হয়। ২০০৫ সালে একুশে পদক পেলেও তিনি স্বাধীনতা পদকেরও হকদার। দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসনে সরকারি রোষানলে পড়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খেতে হয়েছে। অধ্যাপক আবদুল গফুরের আর্থিক ও শারীরিক অবস্থার কথা সরকারের লোকদের অজানা ছিল না। অথচ কেউ এগিয়ে আসেনি, দেয়নি কোনো সহায়তা।
দেশে যেমন অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা গজিয়ে উঠেছে তেমনি ভুয়া ভাষাসৈনিকের কমতি ছিল না। আমরা দেখেছি অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসৈনিক সরকারি সম্মান ও সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ তিনি প্রকৃত একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসৈনিক হওয়ার পরও তার মর্যাদা ও সম্মান দুর্দিনে না পাওয়াটা সত্যিই দুঃখজনক, হতাশাজনক ও ক্ষোভের।
অধ্যাপক আবদুল গফুর ছিলেন জাতির আদর্শিক আইকন। ছিলেন জাতির অভিভাবকতুল্য। তাকে আমরা যেন কোনোভাবেই ভুলে না যাই। আমরা মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা কলেজে তার নামে একটি চেয়ার প্রবর্তন করা উচিত। সেই সাথে তার নামে ঢাকার কোনো প্রধান সড়কের নামকরণ করা হোক।
লেখক : নির্বাহী সদস্য, তমদ্দুন মজলিস
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা