অলাভজনক মডেল : সামাজিক ব্যবসার ধারণা
- মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
- ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:০৯
উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত বিশ্বে দারিদ্র্য অন্যতম সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানাবিধ উদ্যোগ চলমান। দারিদ্র্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের একপ্রকার অক্ষমতা। যে অবস্থায় মানুষ ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। বিগত শতকের শেষে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে ব্যক্তিক পর্যায়ে ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিবিধ উদ্যোগের সূচনা হয়। ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প’ দেশে ব্যক্তিক পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অন্যতম উদাহরণ। বিগত ’৮০-এর দশকের প্রারম্ভে আমার গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি শাখা চালু করা হয়। এ প্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম বাল্যকালেই প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। এ ব্যাংক গ্রামীণ পর্যায়ে প্রান্তিক কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের পুঁজি সরবরাহের মাধ্যমে কিভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেছে, তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করি। ওই সময় দারিদ্র্যকবলিত মানুষগুলো পুঁজির সন্ধানে মহাজনদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াত। জমি বন্ধক, স্বর্ণ বন্ধক কিংবা অগ্রিম কৃষিজপণ্য বিক্রি বা দান প্রথার মাধমে মহাজনের কাছ থেকে চড়া মূল্যে পুঁজি সংগ্রহ করত। গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র্যপীড়িত ওই সব প্রান্তিক মানুষদের আত্মকর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখায় এবং অবাধ পুঁজি সংস্থানের নিশ্চয়তা প্রদান করে। তাদের মুক্ত করতে শুরু করে মহাজনের কবল থেকে।
বর্তমান বিশ্বসমাজ দু’টি মতবাদে বিভক্ত। যথা : ‘পুঁজিবাদ’ ও ‘সমাজতন্ত্র’। এ মতবাদ দু’টি চলমান বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মানচিত্রের নিয়ন্ত্রক। পুঁজির দাপটে পুঁজিবাদী সমাজ বিশ্বব্যাপী সুপ্রতিষ্ঠিত। যার পৃষ্ঠপোষক বণিকশ্রেণী, ধনকুবের ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। তাই বিশ্বসমাজে পুঁজিবাদ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। এ ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে সমাজতন্ত্র বা সমাজবাদ। এ মতবাদ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টন ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় যৌথ অংশীদারিত্ব। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধি-বিধান প্রণয়ন করা। বিশ্বে ধনবান ও শক্তিশালী মানুষের সংখ্যা অতি সীমিত। কিন্তু তারা অতিমাত্রায় সঙ্ঘবদ্ধ। যেকোনো মুহূর্তে সমাজ বা দেশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নেতৃত্ব গ্রহণে সক্ষম। অপর দিকে বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষ নিঃস্ব, ক্ষমতাহীন ও অসহায়। সমাজতান্ত্রিক মতবাদ বিশে^র বঞ্চিত মানুষের সামাজিক সুরক্ষা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী। কিন্তু এ মতবাদ ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিশ্বের দারিদ্র্যকবলিত গোষ্ঠী পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা টিকে থাকতেই নতুন ধারণা বা কৌশলের সন্ধান করে।
পুঁজিবাদ (Capitalism) পুঁজিবাদ হচ্ছে একধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদান এবং উৎসগুলো ব্যক্তিগত মালিকানায় নিয়ন্ত্রিত এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সংগঠিত হয়। শ্রেণী সংগ্রাম থেকে পুঁজিবাদ ধারণার উদ্ভব। দার্শনিক কার্ল মার্ক্স ১৮৬৭ সালে Das Capital শিরোনামে প্রকাশিত গ্রন্থে পুঁজিবাদ বিষয়ে তার ধারণা ব্যাখ্যা করেন। সমগ্র বিশ্ব আজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে যুক্ত। পুঁজিবাদের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হচ্ছে সমাজের অসহায়, প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষগুলো। এসব অসহায় মানুষের ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাদ গড়ে ওঠে। পুঁজিবাদ ধনী-গরিব বৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য ও আয়বৈষম্য সৃষ্টি করে। বিগত শতাব্দীর শুরুতে শ্রেণিবৈষম্য ও পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর লেলিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হয়। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুং এর নেতৃত্বে চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। সমাজতন্ত্রের মূলকথা : সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও নিয়মনীতির বিধান প্রবর্তন। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানা নেই। ব্যক্তি তার যোগ্যতা মোতাবেক কাজ করবে এবং প্রাপ্যতা অনুসারে পারিশ্রমিক পাবেন। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ আজ অপ্রতিদ্ব›দ্বী এবং অনিবার্য ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। এ ব্যবস্থার সাথে মানানসই নতুন ধারণা ও কৌশলে সমাজকে চলতে হবে।
এ প্রেক্ষিতে গত শতাব্দীর শেষভাগে দেশের বিপুল সংখ্যক দারিদ্র্যকবলিত ও প্রান্তিক মানুষের সুরক্ষায় ব্যক্তিগত উদ্যোগের সূচনা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ দারিদ্র্য নিরসনের জন্য ব্যক্তিক প্রচেষ্টায় ব্রতী হন। তিনি ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভিত্তিহীন মানুষের মাঝে জামানতহীন পুঁজি সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এটি দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। ড. ইউনূসের ধারণা দরিদ্র্যের শিকার মানুষগুলো মূলধন স্বল্পতার কারণে সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারছে না। ১৯৮০ সালে টাঙ্গাইল ও চট্টগ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের ২৪টি পরীক্ষামূলক শাখা খোলা হয়। ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (IFAD), ইউনিসেফ (UNICEF) ও ফোর্ড ফাউন্ডেশন (FORD FOUNDATION) এ প্রকল্পে অর্থ সহায়তা করে। ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ জারি করা হয় এবং এ ব্যাংক একটি বিশেষ অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ ব্যাংকের মূল দর্শন হচ্ছে গ্রামীণ দারিদ্র্যকবলিত নারী-পুরুষদের মাঝে ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা। মানুষ ব্যাংকের কাছে যাবে না বরং ব্যাংক মানুষের কাছে যাবে। ‘নিম্নআয়, নিম্নসঞ্চয়, নিম্ন বিনিয়োগ-নিম্ন আয়’ দারিদ্র্যের এ দুষ্টচক্রকে ব্যাপক ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে মোকাবেলা করা। প্রদত্ত ঋণ সরবরাহের মূল লক্ষ্য ভ‚মিহীন দরিদ্র মানুষকে স্বাবলম্বী করা, আত্মকর্মসংস্থান সৃজন ও মহাজনের শোষণ হতে মুক্তি।
পুঁজিবাদী বিশ্বে ব্যবসাবাণিজ্যে পুঁজির জোগান নিশ্চিত করার জন্য সৃষ্টি হয় ঋণ বাজার ব্যবস্থাপনা। যেমন : বিশ্বব্যাংক,আইএমএফ, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ইত্যাদি। এসব অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো বিশ্বের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় সার্বিকভাবে সফল হয়নি। বর্তমান বিশ্বের অনেক সামাজিক সমস্যার সরব উপস্থিতি পুঁজিবাদের ভ্রান্ত নীতির কুফল। প্রচলিত ব্যবস্থায় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রকৃত লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ পরিমাণ ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন। এতে মানুষের ভ‚মিকা ধার্য করা হয়েছে এক মাত্রিক রোবট হিসেবে, যে রোবট টাকা ছাড়া আর কিছু চেনে না। চলমান অর্থনৈতিক মতবাদ থেকে বের হয়ে ‘সামাজিক ব্যবসা’ নামে নতুন ধারণার উদ্ভব ঘটে বাংলাদেশে।
‘সামাজিক ব্যবসা’ বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপিত এক নতুন অর্থনৈতিক মডেল। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস প্রবর্তিত এ মডেল এক অলাভজনক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। তিনি ২০০৭ সালের শেষ ভাগে ‘সামাজিক ব্যবসা’ ধারণাটি প্রবর্তন করেন। যার মূল লক্ষ্য মুনফার পরিবর্তে মানবকল্যাণ। যা দারিদ্র্যবিমোচন ও আয়বৈষম্য নিরসনে ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করবে। সামাজিক ব্যবসা ও সনাতন ব্যবসার মধ্যে পার্থক্য কেবল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে। সনাতন ব্যবসা শুধু মুনাফামুখী কিন্তু সামাজিক ব্যবসায় কোম্পানি নিশ্চই মুনাফা করবে, তবে এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী মুনাফা ফেরত নিতে পারবে না; কেবল মূলধন ফেরত নিতে পারবে। এতে একটি কোম্পানি বা সংগঠন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। যার মালিকানা একক কোনো ব্যক্তির নয় বরং সংগঠনের সবাই এর মালিক। বর্তমান বিশ্বে চলমান বিবিধ সামাজিক সমস্যা সমাধানের বিশেষ লক্ষ্য হিসেবেও এ ‘সামাজিক ব্যবসা’র প্রবর্তন। শক্তি-ড্যানোন বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসার প্রথম দৃষ্টান্ত। যার অন্যতম লক্ষ্য শিশুদের জন্য কম দামে উন্নতমানের টিফিন সরবরাহ, যাতে শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয়। এ উদ্দেশ্যে একটি দই উৎপাদন কারখানা স্থাপন করা হয়, যার বাণিজ্যিক নাম শক্তি দই।
‘সামাজিক ব্যবসা’ ধারণার প্রবর্তক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মতে, মানুষ একই সাথে স্বার্থপর ও নিঃস্বার্থপর। তিনি নিঃস্বার্থপর মনোবৃত্তি থেকে সামাজিক ব্যবসার কনসেপ্ট উপস্থাপন করেছেন। এ সামাজিক ব্যবসার প্রেষণা হলো, ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার পরিবর্তে মহৎ কিছু করার আকাক্সক্ষা। বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসা ধারণা বাস্তবায়নের জন্য ‘ইউনূস সেন্টার’ সোশ্যাল বিজনেস ডিজাইন ল্যাব পরিচালনা করছে। এ ল্যাব যারা সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়তে আগ্রহী এবং সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করতে চায় তাদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। সামাজিক ব্যবসা ধারণা পুঁজির টেকসই বিকাশ ও উন্নয়নে সহায়ক। বিশ^াঙ্গনে সামাজিক ব্যবসা ধারণার দ্রæতই প্রসার ঘটছে। দেশের সামাজিক ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক ব্যবসার চর্চা শুরু করুক। সামাজিক ব্যবসা হোক সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ ও আয়বৈষম্য নিরসন এবং দারিদ্র্যবিমোচনের এক নতুন হাতিয়ার।
ই-মেইল : newaz.usso@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা