বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লব ও নয়া দিগন্ত
- শিব্বির মাহমুদ
- ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১:০১
সাম্প্রতিক সময়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে বিপ্লব ধারণ করেছে তার সাথে ফরাসি বিপ্লবের (French Revolution) একটা অপূর্ব যোগসূত্র রয়েছে।
ফরাসি বিপ্লবের বিপ্লবী কাউন্সিলের যিনি সেক্রেটারি ছিলেন তার নাম ছিল জামুর। এ জামুর চট্টগ্রামে ১৭৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১১ বছর বয়সে দাস ব্যবসায়ীরা তাকে অপহরণ করে মাদাগাস্কারে নিয়ে যায়। মাদাগাস্কার থেকে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তাকে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হয়।
ফ্রান্সের পঞ্চদশ লুইকে (Louis The XV) উপঢৌকন দেয়া হয় তাকে। বিশেষ মেধার অধিকারী হওয়ায় জামুরকে তিনি তার উপপত্মী লেডি বেরিকে উপহার দেন। পরে লুই দ্যা ফিফ্টিনথ তাকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন।
লেখাপড়া শিখে জামুর সাহিত্য ও দর্শনে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে জামুর রেভোলিউশন কাউন্সিলরের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। দুর্ভাগ্যবশত পরে তাকে লেডি বেরির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে হয়। এতে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে লেডি বেরির শিরোশ্ছেদ ঘটে।
জামুরকে যখন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তখন তাকে আফ্রিকান বলে পরিচয় দেয়া হয়। এ সময় তিনি চিৎকার করে বলেন, I’m from Chattogram, Bengal, এই বেঙ্গল আজকের বাংলাদেশ। আমাদের সৌভাগ্য, বর্তমানে যিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তিনিও সেই চট্টগ্রামেরই সূর্যসন্তান। আমাদের আরো অনেক জ্ঞানী-গুণী আছেন যারা চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। আমি জানি না, চট্টগ্রামে কিভাবে এমন সাহসী ও মেধাবী সন্তানরা জন্মগ্রহণ করেন। বলা হয়ে থাকে, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের পূর্বপুরুষরাও চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা জাতীয় মুক্তিতে অনেক বড় অবদান রেখেছেন। এতে দেড় হাজারের বেশি শহীদ হয়েছেন, ৩০ হাজারের বেশি হয়েছেন আহত, যাদের বড় অংশ হাত-পা বা চোখ হারিয়েছেন। আমরা তাদের প্রতি সম্মান জানাই এবং যারা তাদের জীবন দিয়েছেন তাদের মাগফিরাত কামনা করি। যারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তাদের সুস্থতা কামনা করি। কিন্তু যে বা যারা এসব নির্মম বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদেরকে যেন আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত বিচার করা হয় এবং কোনোভাবেই যেন বিচার বিঘ্নিত বা বিলম্বিত না হয় সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে যে, Justice delayed is Justice denied অর্থাৎ বিচার বিলম্বিত করা মানে, ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করা। একটা অন্ধকার রাতের পর যখন রক্তিম আভা নিয়ে সূর্য ওঠে অথবা পূর্ণিমার চাঁদ ওঠার পর যখন আমরা জ্যোৎস্নার আলোয় চলছি তখনো অনেক বিভ্রম রয়ে গেছে। এখনো মনে হচ্ছে, আমরা কি আসলেই আলোতে হাঁটছি নাকি এখনো অন্ধকারেই আছি? এ জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে নিজে চিমটি কেটে দেখি, ঠিক আছি কি না।
নয়া দিগন্তের এক ক্রান্তিলগ্নে পুলিশ ও র্যাব এটির মূল সংগঠক মীর কাসেম আলীকে তুলে নিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে আমাকে পত্রিকার কার্যনির্বাহী পরিষদের চেয়ারম্যান ও এমডি হওয়ার জন্য প্রস্তাব করেন তিনি। আমি ব্যস্ততার কারণে এই দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করি; কিন্তু আমার অনাগ্রহ সত্ত্বেও পরিচালকরা বোর্ড মিটিং করে আমাকে এমডি হিসেবে কার্যক্রম চালাতে বলেন। বছর তিন আগে শাহ আব্দুল হান্নানের ইন্তেকালের পর আমি দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই এবং সেই থেকে আজও কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে যখন হেফাজতের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় তখন ওই সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ছোড়া একটি গুলি এক শিশুর চোখ ভেদ করে যাওয়ার দৃশ্যটি দিগন্ত টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। এ ঘটনার পর আধঘণ্টার মধ্যেই দিগন্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হয়। আমি সকালে উঠে দেখি দিগন্ত টেলিভিশনের চ্যানেলটি আর চলছে না। সত্যি কথা বলতে, ওই গুলিটা শুধু ওই শিশুর চোখে লাগেনি, গুলিটা একই সাথে দিগন্ত টেলিভিশনের কলিজার মধ্যেই লেগেছে। সে সময় দিগন্ত টেলিভিশনে কর্মরত আমাদের চার শ’ সংবাদকর্মী বেকার হয়ে যান। চরম দুর্দশার মধ্যে পড়ে তাদের অনেকে ইতোমধ্যে ইন্তেকাল করছেন, আবার অনেকে কর্মহীন রয়েছেন। কিছু সংবাদকর্মী অন্য চ্যানেলে চাকরি পেলেও অনেকে এখনো কর্মহীন।
আমি তখনকার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কাছে বারবার গেছি, দিগন্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার পুনরায় চালুর জন্য তাকে বিভিন্নভাবে অনুরোধ করেছি। আমাকে ইনু সাহেব বললেন, এই যে দেখেন এখানে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেল আছে; কিন্তু কোনো চ্যানেলই এটি সরাসরি সম্প্রচার করেনি, শুধু আপনাদের দিগন্ত টেলিভিশনই সরাসরি সম্প্রচার করেছে।
আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, এখনো সেই অবস্থাতেই আছি। দিগন্ত টেলিভিশন ২০১৩ সালের ৫ মে থেকে এখনো একই অবস্থায় আছে অর্থাৎ বন্ধই আছে। আমি জানি দিগন্ত টেলিভিশন এখনো বিপুলসংখ্যক দর্শক স্রোতার মনে জেগে আছে।
পরে আমরা নয়া দিগন্ত নিয়ে এগোতে থাকলাম এবং অনেককে বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছি; কিন্তু যখনই কেউ একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছে তখন সাথে সাথেই ইনু সাহেবের অফিস থেকে ফোন যেত। তিনি এত ইস্পাত কঠিন প্রতিহিংসাপরায়ণ, কোনোভাবেই তাকে ম্যানেজ করা যেত না। সর্বশেষ তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ে নয়া দিগন্তকে ব্লাকলিস্ট করে রাখেন। ওই সময়ে আমরা যেসব ব্যবসায়ী নয়া দিগন্তের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম তাদের প্রত্যেকের ব্যবসাবাণিজ্য অন্যায়ভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। যার ফলে এই মুহূর্তে আমার রফতানিমুখী ব্যবসাবাণিজ্য নেই বললেই চলে। যার জন্য আমি কৃষিকাজটা এখন নতুনভাবে শুরু করেছি।
আসলে আমাদের দেশটা হলো জোয়া-ভাটার দেশ। জোয়ার-ভাটার দেশের মানুষের অঙ্কজ্ঞান খুব ভালো। আমরা যখন গ্রামে যেতাম তখন একটা বিষয় লক্ষ করতাম যে, সাধারণ মানুষ বলে দিতে পারতেন কখন জোয়ার আসবে কখন ভাটা হবে। আমাদের দেশে সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রধানত মাটি, পানি ও দক্ষ জনশক্তি। কর্মক্ষম মানুষ সহজে অনেক কিছু শিখে ফেলতে পারেন যেহেতু তারা অঙ্ক ভালো জানেন।
আমি যে এলাকার মানুষ সেখানে পানিটা হানি নামে পরিচিত। এ জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ওই এলাকার মানুষ হোটেলকে পোটেল বলে। তাহলে মধু ইংরেজিতে হলো হানি, বাংলায় মধু। কিন্তু সত্যি আজকে আমি বলতে পারি, আমাদের পানিটা মধুই। বাংলাদেশের মতো এরকম পানি আফ্রিকাতেও পাওয়া যাবে না। অন্য কোনো দেশে তো পাবেনই না। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও এই রকমের পানি পাবেন না। পৃথিবীতে কয়েকটি দেশ আছে মিঠা পানির।
আর বাংলাদেশের মাঠে তো যাই ফলাতে চান তাই ফলে। যারা ব্যাংককে গিয়েছেন তারা জানেন যে, সেখানে অনেক কাঁঠাল পাওয়া যায়। তারা একটা প্লাস্টিকের মধ্যে পলিথিনে মুড়ে পাঁচ থেকে সাতটি কাঁঠালের কোষ প্যাকেটজাত করে। কিন্তু একটি কোষও নষ্ট হয় না। আমি যখন থাই এয়ারে ট্রাভেল করেছি দেখলাম যে ওখানে কলার পিঠা খাওয়াচ্ছে।
আমি জীবনের প্রথম দিকে লন্ডনে ছিলাম বেশ কিছু দিন। সেখানে দেখতাম কিছু ব্যবসায়ী বিশেষ করে পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান, ওরা বিমান চার্টার করে আম নিয়ে আসত। কখনো ভেনিজুয়েলা থেকে, কখনো আফ্রিকা থেকে, কখনো কেনিয়া থেকে। আর এগুলোকে এমনভাবে প্যাকেটজাত করা হয় কাগজ দিয়ে, যাতে একটা আমও নষ্ট হয় না।
সে জন্য আমার পরামর্শ আমাদের অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি হয়েছে অনেক কৃষিবিদ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে আমরা অ্যাগ্রিকালচার টেকনোলজিস্ট তৈরি করতে পারিনি। যারা কৃষিপণ্যকে ভালো প্যাকেটজাত করতে পারে, আকর্ষণীয় রাখতে পারে। যাতে সেসব নষ্ট না হয়। লন্ডনে পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া থেকে আচার যেত (ম্যাংগো আচার, জলপাই আচার)। বাংলাদেশে অনেক কনসালট্যান্ট আছে। আমার মনে হয়, এগুলোর দিকে একটু আমাদের মনোযোগ দেয়া দরকার।
বাংলাদেশে একজন কৃষি নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন যিনি দেখেছেন তিনি হলেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তার প্রচেষ্টায় এ দেশের জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পরে অনেক কৃষক ও কৃষিবিদ তৈরি হয়েছে। আর এই কৃষকদের সাহায্য করার জন্য ১৯৩৮ সালের দিকে Bengal Agriculture Institute গড়ে ওঠে। এর পরে এটি হয়েছে ইস্ট পাকিস্তান কৃষি ইনস্টিটিউট। তারপরে এটি হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট যা আজকের শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। আমার মনে হয়, ইউরোপে বাংলাদেশের দূতাবাসে কমার্শিয়াল এটাচে হিসেবে কৃষিবিদদের নিয়োগ করা উচিত। এতে কৃষি বিপণন এবং টেকনোলজিস্ট তৈরি হবে। কারণ শেষ পর্যন্ত কৃষিই হলো বাংলাদেশের প্রাণ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা