২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

স্বৈরতন্ত্র : এরশাদকে হাসিনার ছাত্র হতে হবে

- ফাইল ছবি

তিন জোটের আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তখন ইত্তেফাক পত্রিকায় চিঠিপত্র বিভাগে জনৈক পাঠক একটি গল্প লেখেন এভাবে : ‘আসাদ নামে একজন বাস ড্রাইভার বাসে প্যাসেঞ্জার ভর্তি করে ঢাকা অভিমুখে রওনা দিয়েছেন। ড্রাইভার দক্ষ হাতে গাড়ি চালালেও তার বৈধ লাইসেন্স ছিল না। প্যাসেঞ্জারের মধ্যে খালেদ ও হাসান নামে দুই ব্যক্তি চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। তারা যাত্রীদের বোঝাতে থাকে ড্রাইভারের লাইসেন্স নেই। লাইসেন্সওয়ালা ড্রাইভার চাই। কেউ কেউ মৃদু স্বরে দ্বিমত করে বলেন, ড্রাইভারের লাইসেন্স না থাকলেও গাড়ি তো ঠিক মতো চালাচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জার খালেদ ও হাসানের পক্ষ নেয়। শেষে আসাদকে বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে খালেদকে ড্রাইভারের আসনে বসিয়ে দেয়া হয়। এরপর খালেদ দ্রুত গতিতে বাস চালাতে থাকে। খানাখন্দ কোনো কিছুই তোয়াক্কা করছে না। বাসের ধাক্কায় একটি রিকশা ছিটকে গিয়ে খাদে গিয়ে পড়ে। প্যাসেঞ্জাররা হইচই শুরু করে দেয়। মহিলারা কান্নাকাটি করতে থাকে। তখন খালেদ ড্রাইভার হুঙ্কার দিয়ে বলতে থাকে, চুপ করে বসে থাকো। আমার বৈধ লাইসেন্স আছে।’ এখন অনেকে প্রশ্ন করা শুরু করেছেন, স্বাধীনতার বৈধ লাইসেন্সধারী শাসকরা আমাদের কী উপহার দিলেন? এরশাদ সরকারের (১৯৮২-৯০) শাসনামলে ১৯৬ জন, বিএনপির (১৯৯১-৯৬) শাসনামলে ১৭৪ জন, আ’লীগ (১৯৯৬-২০০০) শাসনামলে ৭৬৭ জন, বিএনপি (২০০১-২০০৭) শাসনামলে ৮৮৬ জন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৮) শাসনামলে ১১ জন, আ’লীগ ( ২০০৯-২০১৩) শাসনামলে ৫৬৪ জন, আ’লীগ ( ২০১৪-২০১৮) শাসনামলে ৯৯৬ জন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আ’লীগ (২০১৮ -২৪) শাসনামলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রায় দুই হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে। এই দুই হাজার মানুষের মধ্যে রয়েছে জুলাই মাসের শেষ ১৪ দিন প্রায় ৮৭৫ জন এবং ৫ আগস্টের আগে ও পরে আরো ৯ শতাধিক মানুষের মৃত্যু (সূত্র : বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)। আহত হয়েছে প্রায় ৩১ হাজারের বেশি মানুষ। (এখানে একটি কথা উল্লেখ্য, শাসকের হাতে যে রকম অস্ত্র থাকবে নৃশংসতাও সে রকম হবে)।

‘৭৩ সালে স্বাধীন দেশের সংবিধান রচিত হয়। বহু বিশেষজ্ঞের মুখে শোনা যেত- এটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধান। সমন্বয়করা প্রথম থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে আসছেন। তারা আরো বলেছেন, সংবিধানের মধ্যে ফ্যাসিবাদের বীজ লুকায়িত রয়েছে। সমন্বয়ক সারজিস আলম একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, এই সংবিধান বজায় রেখে তাকেও যদি প্রধানমন্ত্রী বানানো যায়, তাহলে তিনিও ফ্যাসীবাদী হতে বাধ্য। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছেন। তারা তিন মাসের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করবেন। আমরা প্রায় ১২ বছর যাবৎ একাধিক সরকারব্যবস্থা, স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ও প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলে আসছি। একই কথা বারবার লেখাতে কোনো কোনো পত্রিকা বিরক্তি প্রকাশও করেছে। আমরা শুধু পত্রিকায় লিখেই ক্ষান্ত হইনি। সংস্কারের ডিজাইনটি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ বহু রাজনীতিকের সাথে সরাসরি দেখা করে পৌঁছে দিয়েছি। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিন জোটের রূপরেখা গৃহীত হয়। সেটি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কোনো সরকারই বাস্তবায়ন করেনি। গত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কারোর মুখে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা শোনা যায়নি; বরং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সব এমপি ও আমলারা সচেষ্ট থেকেছেন। সে ক্ষেত্রে এরশাদকে কী করে স্বৈরাচারী বলা যায়! তিনি তো আন্দোলন ছাড়াই মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করেন, উপজেলাব্যবস্থা চালু করেন, ছয়টি হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করেন। তা ছাড়া জাতীয় ঔষধ নীতি, গুচ্ছগ্রাম, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, ঢাকার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন (কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়) সহ প্রায় ১০০টি ব্যতিক্রমী কাজ শুরু করেন। তার কর্মকাণ্ডে সমর্থন দেয়ায় আ স ম রবকে দালাল আখ্যা দেয়া হয় এবং তার তাত্ত্বিক গুরু সিরাজুল আলম খানকে সিআইএ’র এজেন্ট আখ্যা দেয়া হয়। এখন প্রমাণ হয়েছে, তাদের মতো আরো কয়েকজন দালাল পাওয়া গেলে তার কাছ থেকে প্রদেশব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাসহ বহু কিছু আদায় করা সম্ভব ছিল। অথচ তৎকালীন সময়ে প্রিয় রাজনীতিকদের অনুসরণ করে আমরা স্লোগান দিতাম, এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি। এ বিষয়ে চিত্রনায়ক সোহেল রানা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'এরশাদকে ৯ বছরের স্বৈরশাসক বলা হয়। আমি বলি, যদি উনাকে স্বৈরশাসক বলা হয়, তাহলে গত ১৬ বছরের ক্ষমতায় থাকা কথিত সরকারের স্কুলে এরশাদ সাহেবকে ভর্তি করতে হবে; সেটিই শিখতে যে, স্বৈরতন্ত্র কী, স্বৈরশাসন কাকে বলে, সেটি কিভাবে করা উচিত এবং স্বৈরশাসনের অবস্থানটা কী!

লেখক : স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক
ই-মেইল: musha.pcdc@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement