২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বিচার বিভাগ সংস্কারে নাগরিক চিন্তা

- প্রতীকী ছবি

ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের পর রাষ্ট্র সংস্কার খুব জরুরি বলে উচ্চারিত হওয়ায় বিচার বিভাগের সংস্কারের বিষয়টি সামনে এসেছে। ইতোমধ্যে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, বিচার বিভাগ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টাও পরিষ্কার করেছেন, আইন, বিচার ও প্রশাসন সংস্কার করেই তবে নির্বাচন হবে। সিভিল সোসাইটির সম্মানিত ব্যক্তিবর্গও সমস্বরে বলেছেন, পুলিশ ও নির্বাহী বিভাগের পাশাপাশি বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার প্রয়োজন। ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও ধীরে ধীরে বিচার বিভাগ ইমেজ ক্ষুণ্নের শিকার হয়েছে। গত ১৬ বছরে বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার প্রদানে নজিরবিহীনভাবে ব্যর্থতার সঙ্কটে নিপতিত হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এবং অত্যাচারিত নিপীড়িত মানুষের আস্থার আশ্রয়স্থল বিনির্মাণের লক্ষ্যে বিচার বিভাগের একটি আশু সংস্কার অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সম্প্র্রতি সাবেক বিচারকদের ফোরাম বিচার বিভাগ সংস্কারে ১২ দফা পেশ করেছেন। কর্মরত বিচারকদের তরুণ অংশ স্বাধীন ও জনবান্ধব বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য আইন উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতি বরাবর একইভাবে ১১ দফা উত্থাপন করেছেন, যা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আইন গবেষকরাও লিখে যাচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমে বিচারক-আইনজীবী ও আইনজ্ঞরা এমনকি সাধারণ মানুষও একটি স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত বিচার বিভাগের স্বপ্ন নিয়ে নিজ নিজ মতামত তুলে ধরছেন। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বিচার বিভাগ সংস্কারের একটি রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই।

বিচার বিভাগ সংস্কারে বিচার বিভাগের মূল ভিত্তিতে কিছু ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক। সাধারণ বিচারপ্রার্থীসহ দেশবাসীর মনে বিচার বিভাগের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে দেশবাসীর ম্যান্ডেট প্রাপ্ত হয়েছে। ফলে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনাভিত্তিক সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ণের আবশ্যকতা নিয়ে তারা কাজ করতে পারেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ খুব লম্বা না হলেও আগামী ১ মাসের মধ্যে আশু সংস্কারের একটি পরিকল্পনা বা রোডম্যাপ জাতির সামনে উপস্থাপন করা দরকার। এ লক্ষ্যে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ‘বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন’ তৈরি করতে হবে, যাতে বিচার বিভাগের ৩টি অংশে (অধস্তন আদালত, হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ) কর্মরত কমপক্ষে ৩ জন বিচারক এবং উচ্চাদালতের অবসরপ্রাপ্ত এক বা একাধিক বিচারপতিসহ এবং অন্যান্য নাগরিক সদস্য অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। তারা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে বিস্তারিত কর্ম পরিকল্পনা তুলে ধরবেন, যা দেশের মানুষের মতামত প্রদানের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। অতঃপর উন্মুক্ত আলোচনাসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন সাপেক্ষে উপদেষ্টা পরিষদে চূড়ান্ত অনুমোদনের মাধ্যমে ছয় মাস মেয়াদে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। আমরা সংস্কার কার্যক্রমকে কয়েকটি মৌলিক ভাগে বিভক্ত করে উপস্থাপন করতে চাই।

১। সাংবিধানিক সংস্কার : বিচার বিভাগ মৌলিক সংস্কারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও পৃথকীকরণের জন্য সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৬ সংশোধনপূর্বক বিচার বিভাগ পরিচালনার জন্য যাবতীয় ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে অর্পণ করতে হবে। প্রয়োজনে বিধিবিধান প্রণয়নপূর্বক রেজিস্ট্রার কার্যালয়কে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় ঘোষণা করতে হবে এবং আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগ বিলুপ্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমগ্র বিচার বিভাগের বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে। আয় বিনির্মাণের লক্ষ্যে কোর্ট ফি-সহ আদালতে প্রাপ্ত অন্যান্য অর্থ জমা থাকবে। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আইনজীবী প্রার্থীদের একটি নির্দিষ্টসংখ্যক (কমপক্ষে ৩০টি দেওয়ানি/ফৌজদারি/সাংবিধানিক) মামলার নিষ্পত্তিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অধস্তন আদালতের প্রার্থী বিচারকদের ক্ষেত্রে বিচারিক কর্মকালের সর্বশেষ কমপক্ষে পাঁচ বছর বিচারকাজে নিয়োজিত থাকার শর্ত সংরক্ষণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। ষোড়শ সংশোধনী মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে বিচার বিভাগের তিনটি অংশে (অধস্তন আদালত, হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ) কর্মরত বিচারকদের অপসারণের জন্য কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের সমন্বয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তৈরির বিধান সংযুক্ত করতে হবে। বিচার সহজলভ্য করার জন্য বিভাগীয় সদরে উচ্চ আদালতের আসন স্থাপন করে অনুচ্ছেদ ১০০-এর বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি বছর উচ্চ আদালতের বিচারকদের সম্পদ বিবরণী প্রধান বিচাপতি বরাবর জমা দেয়ার বিধান প্রবর্তন করতে হবে।

২। উচ্চ আদালতের রায়ের বাস্তবায়ন : স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য মাসদার হোসেন মামলায় ইতঃপূর্বে ১২ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়াও আপিল বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত গ্রেফতার, রিমান্ড, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, তদন্ত, প্রসিকিউশন, হাজতিদের মর্যাদা সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট আইনসহ উচ্চ আদালতের রায়ের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। মোবাইল কোর্ট সম্পর্কিত পেন্ডিং আপিল মামলা নিষ্পত্তিপূর্বক নির্বাহী বিভাগের বিচারিক ক্ষমতা লাভের আকাঙ্খা দূর করতে হবে। তা ছাড়া মর্যাদা সম্পর্কিত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিক্রমে বিচার বিভাগের সাথে অন্যান্য বিভাগের ক্ষমতার মর্যাদাপূর্ণ ভারসাম্য আনয়ন করতে হবে।
২(১) : তদন্ত নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত করার জন্য স্বাধীন তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
২(২) : সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনার জন্য স্বাধীন প্রসিকিউশন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৩। বিচারাধিকার : বিচার বিভাগের প্রতিটি স্তরে মামলা বা আরজি দাখিলের আগে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা, মীমাংসা বা সালিসি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য সরকারি আইনগত সহায়তার ব্যাপকভিত্তিক ব্যবহার চালু করতে হবে।

৪। অবকাঠামো : সর্বস্তরের আদালতগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধাসংবলিত এজলাস, সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিস্তৃত কক্ষসহ আদালত ভবন প্রস্তুত করতে হবে। বিচারপ্রার্থীদের অসুবিধা লাঘবের জন্য পর্যাপ্ত বৈঠকখানা, নারী ও শিশুদের নিরাপদ কক্ষ, সাক্ষীদের বিশ্রামাগার স্থাপন করতে হবে। অধস্তন আদালতের কাঠামোর মধ্যে জেলাপর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি পৃথক অধিবেশন ব্যবস্থা করতে হবে। জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তদারকির জন্য বিভাগীয় জজ নিয়োগসহ বিভাগীয় দফতর স্থাপন করতে হবে, যেখানে জেলা আদালতের বিশেষ আপিল বা রিভিশন শুনানির ব্যবস্থা থাকবে এবং জেলাপর্যায়ের বিচারকদের মধ্যে সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে স্থানীয়ভাবে বদলির ব্যবস্থা থাকতে হবে। অন্যান্য সিনিয়র বিচারকদের বদলির ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ে সংযুক্ত থাকবে। নবসৃজিত আদালতগুলোর প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করতে হবে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে যাবতীয় নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে।

৫। বিচারক/কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মান উন্নয়ন : যেকোনো সংস্কার কার্যক্রম সফল করার জন্য বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মান উন্নয়ন অপরিহার্য। বিচারকদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধনের জন্য পর্যাপ্ত বেতনভাতা, দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ, দেশে-বিদেশে চিকিৎসা, পরিবহন, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরি বিচার বিভাগে ন্যস্ত করা এবং প্রয়োজনীয় সুবিধাদি প্রবর্তন করতে হবে। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। সার্বক্ষণিক পরিবহন সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য পৃথক পরিবহন পুল ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি বছর তাদের সম্পদবিবরণী সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ে জমা দেয়ার বিধান প্রবর্তন করতে হবে।

৬। বিজ্ঞ আইনজীবীদের পেশাগত মান উন্নয়নের জন্য বার কাউন্সিলকে রাজনীতিমুক্ত করে এর তত্ত্বাবধানে সারা দেশের বার অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের মধ্যে বিচারপ্রার্থীদের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতি বছর তাদের সম্পদবিবরণী বার কাউন্সিলে জমা দেয়ার বিধান প্রবর্তন করতে হবে।

সর্বোপরি একটি মানবিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সার্বিকভাবে ন্যায়বিচারে সক্ষম একটি বিচার বিভাগ গড়ে তোলাই হবে এই সংস্কার কার্যক্রমের লক্ষ্য।


আরো সংবাদ



premium cement