২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ভাবনা

- প্রতীকী ছবি

বিশ্ব শিক্ষক দিবস আসন্ন। প্রতি বছর এই দিনে দীর্ঘ দুই যুগের শিক্ষকতা জীবনের নানা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায়। সেই ভাবনা থেকেই আজকের এই লেখা। লিখতে বসে প্রথম যে প্রশ্নটি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, সেটি হলো শিক্ষকতা কী? দুই যুগের পথপরিক্রমার অভিজ্ঞতা বলে, শিক্ষকতা কেবল জ্ঞানদান নয়। এর চেয়েও বেশি কিছু। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর নিরন্তর শক্তি জোগানোই শিক্ষকতা। আবার কখনো মনে হয়, শিক্ষকতা একটি কম্পাস বৈ কিছুই নয়। যে কম্পাস দিকভ্রান্ত জাতিকে দেয় সঠিক দিক-নির্দেশনা। কখনো মনে হয়েছে, শিক্ষকতা কাজী নজরুলের আজ ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতা: ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে/মোর মুখ হাসে, মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।’

কেননা, জগতের যত কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, আইনজ্ঞ, চিকিৎসাবিদসহ সব পেশাজীবী মানুষের সাফল্যের পেছনে রয়েছে তাদের অক্লান্ত শ্রম, মেধার বিনিয়োগ, নির্মাণশৈলী। মূলত তারাই শিক্ষক, যাদের কাছে এসে সবাই হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে বিনা স্বার্থে, বিনা শর্তে পরম শ্রদ্ধা আর গভীর মমতায় সম্মান নিবেদন করেন। তাদের পেশাটিই শিক্ষকতা।

এ মুহূর্তে যে প্রশ্নটি মনে আসছে তা হলো, শিক্ষক কে বা শিক্ষক কাকে বলে? শিক্ষকের কাজ তো বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, আর উত্তর দেয়া। আমারও মন অস্থির এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। যে উত্তর পাওয়া গেল তা দেখা যেতে পারে।

শিক্ষক একটি মোমবাতি। মোমবাতি যেমন নিজেকে পুড়িয়ে চারপাশে আলো ছড়ায় তেমনি শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিজেকে নিয়োজিত করেন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার, কুসংস্কার, অনাচার, দূর করে আলোকিত সমাজ বিনির্মাণকারীরাই শিক্ষক। বলা যায়, শিক্ষক প্রকৃতির এক অকৃত্রিম ঝর্ণাধারা। ঝর্ণা যেমন অবিরাম স্বচ্ছ, সুপেয় মিষ্টি পানির প্রবাহ বয়ে নেয় তেমনই শিক্ষক হলেন অনুপ্রেরণার এক অফুরান উৎস। সদাসর্বদা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করাই তার ব্রত। শিক্ষকের অনুপ্রেরণার যে স্রোত তা থামাতে পারে না এমনকি মৃত্যুও। তাই তো, প্রায়ই আমাদের আলোচনায় উঠে আসে মরহুম অনেক শিক্ষকের প্রসঙ্গ।

বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য দু-একটি উদাহরণ টানা যাক। আমরা শিক্ষণের জনক বলি সক্রেটিসকে। তার দেহাবসান হয়েছে কত হাজার বছর আগে। কিন্তু তার চিন্তাধারা, দর্শন, শিক্ষাদান প্রক্রিয়া তাকে অমর করেছে? খুব সাম্প্রতিক উদাহরণ ভারতের মরহুম রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম। ২০১৫ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু আমাদের আলোচনায় আমরা প্রায়ই তার বিভিন্ন শিক্ষা ও অনুপ্রেরণাদায়ক উক্তিগুলো আলোচনা করি। এভাবেই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, আর এভাবেই শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের জগতে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে বহমান থাকেন। তার একটি উক্তি উল্লেখ করি। তিনি বলেছেন, ‘যদি কোনো দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয় এবং সবার মধ্যে সুন্দর মনের মানসিকতা গড়ে ওঠে, আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি সেখানকার সামাজিক জীবনে তিন রকম মানুষ থাকবে, যারা পরিবর্তন আনতে পারেন। তারা হলেন- পিতা, মাতা ও শিক্ষক।’

কেন জানি মাঝে মাঝে মনে হয়, শিক্ষকতা একটি শিল্প। শিক্ষকগণ মানুষ গড়ার শিল্পী। ছোটোখাটো নন, জগতের শ্রেষ্ঠ শিল্পী তারা। এর প্রমাণ মেলে কবি ওমর খৈয়ামের নিচের কয়েকটি পঙ্ক্তিতে,
‘ধূসর মরুর ঊষর বুকে
বিশাল যদি শহর গড়
একটি জীবন সফল করা
তার চাইতে অনেক বড়।’

একজন শিক্ষক তার শৈল্পিক কারুকাজ দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনের সরস মাটিতে সুকুমারবৃত্তির বীজ বপন করেন। সে বীজ থেকে নৈতিকতার চারা গজায়। সৃজনশীলতার ফুল ফোটে। জ্ঞানের ডালপালা গজায়। ফলে দেশে তৈরি হয় সুনাগরিক, জাতি পায় কবি, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিবিদসহ বিভিন্ন গুণের মানুষ। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকরাই মানব সন্তানের সুপ্ত মেধা এবং লুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে থাকেন।

শিক্ষকরা আসলে জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারক। কেননা, ‘Education is the passport to future.’ তাই শিক্ষকদের জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারক বলা যেতেই পারে। নিচের অনুচ্ছেদটির দিকে আলোকপাত করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে:
‘Education is the backbone of the Nation. No Nation can prosper without education. Ignorance means darkness. So, the light of education is needed for the soceity.’

কালের আবর্তে সব কিছুই পরিবর্তনশীল। সে পরিবর্তন যদি হয় ইতিবাচক, উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে ধাবমান তবেই জাতির কল্যাণ। এই ইতিবাচক পরিবর্তনের মূল নিয়ামক শক্তি শিক্ষক। এজন্যই বলা হয়-A good teacher can change everything.

শিক্ষক মাত্রই মহানুভব। মহাত্মা। কারণ, অন্যের সন্তানকে মানুষ গড়ার জন্য, ভালো ফলাফল অর্জন করানোর জন্য যিনি নির্ঘুম রাত কাটান, শেষ রাতের প্রার্থনায় চোখের জল ঝরান তিনিই শিক্ষক। অন্যের সন্তানের সফলতায় মানব মনে হিংসার দানা বাঁধে। পক্ষান্তরে অন্যের সন্তানের সফলতায় যিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হন, গর্ববোধ করেন তিনি শিক্ষক।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের দেশে এ মহান পেশাটি নিগৃহীত। আমাদের শিক্ষকরা ন্যায্য পাওনাবঞ্চিত। শিক্ষকদের প্রতি এই রাষ্ট্রীয় প্রবঞ্চনার কারণে শিক্ষকগণ আজকের সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। কেবল তাই নয়। আজ শিক্ষক কেবল প্রহৃত নয় খুনও হয় শিক্ষার্থীর হাতে।

বোধ হয় এজন্যই মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা বিমুখ। কোনো শিক্ষার্থীই শিক্ষক হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে না। সেজন্যেই এখানে শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে কটাক্ষ করার অবকাশ সৃষ্টি হয়। এটা জাতির জন্য অশনিসঙ্কেত।

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে আগেই। আমরা পারিনি শিক্ষকদের যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে। এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ড. সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ‘শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করে দিন, ১০ বছরের মধ্যে এর সুফল পাবেন।’

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেছেন, ‘একটি বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কেমন হবে তা প্রধানত সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের মানের ওপরই নির্ভর করে। আর শিক্ষকের মান কেমন হবে তা প্রধানত শিক্ষকদের বেতন ও সম্মানের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে শিক্ষকদের মান কেমন সেটা বুঝতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সাথে অন্যান্য ক্যাডারের তুলনা করলেই টের পাবেন।

তাই আমাদের দরকার সব শ্রেণীর শিক্ষকের জন্য একটা উন্নত স্বতন্ত্র বেতন স্কেল। শুনলাম একজন সচিবের পাঁচক ভাতা ১৬,০০০ টাকা যা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের চেয়ে ৫০০০ টাকা বেশি। শুধু তাই নয়, অষ্টম শ্রেণী পাস সরকারি অফিসের গার্ডের বেতন ১২তম গ্রেডে আর স্নাতক পাশ প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন একধাপ নিচে ১৩তম গ্রেডে। তাহলে বুঝুন কেমন দেশে বাস করি। এই বৈষম্য কবে দূর হবে? বাংলাদেশের সব সমস্যার মূল হলো শিক্ষা আর আমাদের সব সরকার যুগ যুগ ধরে শিক্ষাকেই সবচেয়ে বেশি অবহেলা করে আসছে।

বৈষম্য অবসানের অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত হয়েছে বতর্মান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জাতি গভীরভাবে প্রত্যাশা করে বৈষম্যমুক্ত, মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা এবার নিশ্চিত হবে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আমরা সে সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক : কবি, শিক্ষক


আরো সংবাদ



premium cement

সকল