২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

জেনারেল এরশাদ ও রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে যুক্তিতর্ক

- ফাইল ছবি

জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে সংবিধানের সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম সংশোধনী সাধিত হয়। ১৯৮৯ সালের ১১ জুলাই নবম সংশোধনীর মাধ্যমে উপরাষ্ট্রপতি পদ সৃষ্টি করে তা সরকারি জনগণের ভোটে নির্বাচনের বিধান করা হয়। এর মাধ্যমে এরশাদ যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি রানিংমেট হিসেবে একই সাথে নির্বাচনের পদ্ধতি চালু করতে সচেষ্ট হন।

দশম সংশোধনী সংসদে অনুমোদিত হয় ২৩ জুন ১৯৯০ সালে। এতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পরিবর্তন সংযোজন করা হয়। প্রথমত, জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য ৩০টি সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ আরো ১০ বছরের জন্য বর্ধিত করা হয়। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

সংবিধানের দুটো সংশোধনী সাধিত হয় ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদতবরণের পর ১৯৮১ সালের ১০ জুলাই সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী সংসদে অনুমোদন করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ১৯৯১ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক সাহাবুদ্দিনকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণে রাজনৈতিক দলগুলো অনুরোধ জানায়।

বিচারপতি সাহাবুদ্দিন ছিলেন একজন নির্লোভ ব্যক্তি। তার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস ছিল না। তিনি এ শর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি মেনে নেন যে, তাকে যেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর সুপ্রিম কোর্টে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিধান করা হয় যে, দেশের প্রধান বিচারপতিকে বিশেষ অবস্থায় উপরাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেয়া যাবে এবং রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হলে উপরাষ্ট্রপতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবেন এবং দায়িত্ব পালন শেষে তিনি প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যেতে পারবেন। এ বিধান অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শেষে সুপ্রিম কোর্টে ফিরে গিয়েছিলেন।

সামরিক আইনের বৈধতা ও সপ্তম সংশোধনী : ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী প্রবর্তনের মাধ্যমে ১৯৮২ সালের মার্চের পর থেকে সামরিক শাসনামলে প্রণীত সব ফরমান, আদেশ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, সামরিক আইন নির্দেশ, অধ্যাদেশ এবং অন্যান্য আইন অনুমোদিত ও সমর্থিত হয় এবং বৈধভাবে প্রণীত হয়েছে বলে ঘোষিত হয় এবং তৎসম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকটে কোনো কারণে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। উক্ত ফরমান বা অন্য কোনো ফরমান, আদেশ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, সামরিক আইন নির্দেশ, অধ্যাদেশ বা অন্য কোনো আইন হতে আহরিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে বা প্রয়োগ বলে বিবেচিত করে অথবা অনুরূপ কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করে বা প্রয়োগ বলে বিবেচনা করে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের প্রণীত কোনো আদেশ বা প্রদত্ত কোনো দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে রাষ্ট্রপতি বা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাগুলো, অথবা প্রণীত কৃত বা গৃহীত বলে বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাগুলো বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং তৎসম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

উপ-অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে বা প্রয়োগ বিবেচনা করে অথবা অনুরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বা প্রয়োগ বিবেচনা করে প্রণীত কোনো আদেশ বা প্রদত্ত দণ্ডাদেশগুলো কার্যকর বা পালন করতে প্রণীত কোনো আদেশকৃত কোনো কাজকর্ম বা গৃহীত কোনো ব্যবস্থা বা কার্যধারার জন্য বা এ ব্যাপারে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালে কোনো মামলা, ফৌজদারি কার্যধারা অথবা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা চলবে না।

অষ্টম সংশোধনী ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম : ১৯৮৮ সালের ৯ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি অন্যান্য সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া এ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টের ডিভিশনের বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। ঢাকা ছাড়াও দেশের আরো ৬টি স্থানে হাইকোর্টে ভিভিশন বেঞ্চ স্থাপন করা হয়। অষ্টম সংশোধনীর এ অংশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে দায়েরকৃত এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালনায় মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়ে যা সংযোজন করা হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণার আদৌ প্রয়োজনীয়তা ছিল কি না সে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। রাজনৈতিক মহল ও বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এরশাদ রাজনৈতিক বৈধতা সঙ্কটে ভুগছিলেন। তিনি ধর্মপ্রাণ মানুষের সহানুভ‚তি লাভে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার কৌশল গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার মাধ্যমে তিনি দেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর পক্ষ থেকে বিশেষ কোনো প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হননি। ইসলামী নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহারে এরশাদের ক‚টকৌশল বুঝতে পেরেছিলেন এবং সে জন্য তারা এ উদ্যোগে বিশেষ কোনো উৎসাহ প্রকাশ করেননি। জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জেনারেল এরশাদের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানায়নি। আওয়ামী লীগ সেকুলার দল হিসেবে স্বাভাবিক কারণে রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রবল বিরোধিতা করে। অবশ্য দলটি ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় ‘রাষ্ট্রধর্ম’ সংবিধান থেকে বাদ দেয়নি। এ কথাও সত্যি যে, বিশ্বে শুধু বাংলাদেশই নয় আরো অনেক দেশে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তিত করার নজির রয়েছে।

হাইকোর্টের বেঞ্চ বিকেন্দ্রীকরণ : অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্টকে বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের পৃথক পৃথক ৬টি স্থানে স্থাপন করা হয়। এর পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য ছিল। জনসাধারণের সুবিধা-অসুবিধার যুক্তিও ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, হাইকোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একটি ডিভিশন। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বোচ্চ আদালত রাজধানীতে স্থাপিত থাকে। বাংলাদেশে কোনো প্রদেশ নেই। ফলে হাইকোর্টের একাধিক বেঞ্চ তৈরি করা এবং তা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন সংবিধানের এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর চেতনার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্টের এরূপ বিকেন্দ্রীভূত বেঞ্চ প্রতিষ্ঠাকে বেআইনি ঘোষণা করে। ফলে জেনারেল এরশাদের এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

নবম সংশোধনী : ১৯৮৯ সালের ১১ জুলাই নবম সংশোধনীর মাধ্যমে উপরাষ্ট্রপতি পদ সৃষ্টি করে তা সরকারি জনগণের ভোটে নির্বাচনের বিধান করা হয়।

দশম সংশোধনী : ১৯৯০ সালের ৬ জুন তারিখে চতুর্থ জাতীয় সংসদে সংবিধানের দশম সংশোধনী বিল অনুমোদিত হয়। এ সংশোধনী অনুযায়ী সংসদে মহিলাদের জন্য ৩০টি আসন আরো ৫ বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখার বিধান করা হয়।

জেনারেল এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন বিতর্কিত শাসক। তিনি বন্দুকের নলের মাথায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তিনি শুরুতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেও প্রশাসনে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জেলা প্রশাসনকে ভেঙে নতুন ৬৪টি জেলা এবং থানাগুলো উপজেলায় রূপান্তরিত করেন। তিনি উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত নেতৃত্বের বিধান করেন। তার আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হয়েছিল, যা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কোনো সংসদই তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় সংসদ ভেঙে দিতে হয়েছিল। জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকার জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী উন্নয়ন হয়েছিল। উপজেলা ব্যবস্থা তৃণমূল মানুষের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনলেও পরবর্তীতে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ সরকার উপজেলা ব্যবস্থাকে আন্তরিকভাবে নেয়নি; ফলে ব্যবস্থাটির উন্নয়নে কোনো কাজ করতে আগ্রহী হয়নি।

প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতায় থেকে জাতীয় পার্টি নামে একট নতুন দল গঠন করেন। বিরোধী দলগুলোর অনেক নেতাকে নিজের দলে ভেড়াতে সক্ষম হন। তিনি বিরোধী দলগুলোর প্রতি সহনশীল ছিলেন না। সামরিক শাসন ও স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে দীর্ঘ ৯টি বছর দেশ শাসন করেন। তার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলন গড়ে তোলে। রাজনৈতিক দলগুলোর তিনটি জোট ও জামায়াতে ইসলামী যুগপথ আন্দোলন করে তাকে ১৯৯০ সালে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে।

১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এসে এরশাদকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় এবং তিনি দীর্ঘদিন কারা ভোগ করেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথে সমঝোতা করে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। আওয়ামী লীগ এরশাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো ঝুলিয়ে রেখে তাকে বাগে রাখে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসে আবার জাতীয় পার্টি ও এরশাদকে মামলার ঝুঁকি, প্রলোভন ও ভারতের দ্বারা চাপের মধ্যে রেখে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আসতে বাধ্য করে। দলটি ক্রমান্বয়ে তার স্বকীয়তা হারাতে থাকে। দলটি জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলেও আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে বারবার হেরে যায়। ক্রমান্বয়ে দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
e-mail: ayubmiah@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement