সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল প্রসঙ্গে
- ওয়ালিউল হক
- ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:৩৯
ভারতের তাঁবেদার ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার উৎখাতে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সমন্বয়করা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে। এ নিয়ে মিডিয়ায় জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। ছাত্র সমন্বয়কদের কেউ কেউ গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই এ ধরনের আভাস-ইঙ্গিত দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে সারজিস আলমের একটি বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন গঠিত হয় তখন সমন্বয়ক নাহিদ আলম ও আসিফ মাহমুদের অন্তর্ভুক্তি বিষয়টিকে কেউ কেউ ভিন্নভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করলে সারজিস আলম বলেছিলেন, উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়ে তারা আসলে ত্যাগ স্বীকার করেছেন কারণ তারা পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। আকলমন্দকো লিয়ে ইশারা হি কাফি।
এবার দেখা যাক, ছাত্র সমন্বয়করা কি সত্যিই একটি দল গঠন করতে যাচ্ছেন? অনেকেই মনে করেন, নাগরিক কমিটি নামক একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের মাধ্যমে তারা বুঝতে চাইছেন দল গঠনের বিষয়ে ছাত্র-জনতার অভিমত কী? অর্থাৎ দল গঠনের উদ্যোগকে ছাত্র-জনতা কিভাবে গ্রহণ করবে? দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী হবে? সাংগঠনিক কাঠামো কী হবে? প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতে কী এমন বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে, যা কি না দেশের আপামর জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে?
কারো কারো মতে, সমন্বয়কদের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। কারণ তারা এমন একটি রাজনৈতিক অবস্থানে পৌঁছে গেছেন যে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অনেক কঠিন। যদি কোনো কারণে বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট সরকার বা তাদের মতো অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় আসে তাহলে প্রথমেই তাদেরকে পাকড়াও করা হবে এবং ফাঁসিতেও ঝোলানো হতে পারে যেভাবে বিচারের প্রহসন করে জামায়াত নেতাদেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। অতএব, নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার জন্য তাদের একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বা সংগঠন দরকার। সাধারণ মানুষের মধ্যে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। একদল মনে করছেন, দল গঠন করলে তারাও প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ক্ষমতালোভী হয়ে যাবেন এবং এক সময় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়বেন। তাদের মতে ছাত্ররা ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে থাকলেই ভালো।
কিন্তু যারা দল গঠনের পক্ষে, তারা মনে করেন, ছাত্রনেতারা বেশি দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবেন না। ফলে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে তাদের পক্ষে বেশি দিন থাকা বাস্তব কারণেই সম্ভব হবে না। যার ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। এ ছাড়া পড়ালেখা শেষ করে চাকরি কিংবা ব্যবসা বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়লে তাদের পক্ষে নতুনভাবে মানুষকে সংগঠিত করা সম্ভব নাও হতে পারে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মতো পুরনো দল ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোনো দলের তেমন কোনো বড় গণভিত্তি বা জনসমর্থন নেই। এবারই একটি সুযোগ এসেছে ব্যাপক গণভিত্তিক নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের। সেই সুযোগ হেলায় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
এ কথা অনস্বীকার্য অনির্বাচিত নিষ্ঠুর আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল চেষ্টা করলেও তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ তাদের আন্দোলনে কর্মী-সমর্থকরা যোগ দিলেও সমাজের সর্বস্তরের জনগণ তাতে যোগ দেয়নি। এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল তার ব্যতিক্রম। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ যোগ দেন, এমনকি গৃহবধূরাও রাস্তায় নেমে আসেন।
সমন্বয়কদের অনেকেই মনে করছেন, যেহেতু সাধারণ মানুষের সাথে তাদের একটি যোগাযোগ তৈরি হয়েছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে দেশে একটি নুতন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটানো সম্ভব। আমাদের দেশে যে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে তার বিপরীতে তৃতীয় শক্তির উত্থান অনেকেরই কাম্য। কারণ বিএনপি বা আওয়ামী লীগের শাসনের ব্যাপারে যারা সন্তুষ্ট নয়, আবার জামায়াতকে ক্ষমতায় দেখতে রাজি নয়, তারা এমন অন্য কোনো দল খুঁজে পায় না যাকে তারা ভোট দিতে পারেন। নতুন দলটি হয়তো তাদের মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। ছোট ছোট বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তৃতীয় শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করার চেষ্টা করলেও জনগণ তাদেরকে হিসাবে ধরে না। আবার ইসলামপন্থী দলগুলোও নিজেদের অনৈক্যের কারণে এত দিন নিজেদেরকে তৃতীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হচ্ছে এই যে, নতুন জেনারেশনকে এতদিন রাজনীতিবিমুখ মনে করা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে যে তারা রাজনীতি-বিমুখ নয়। তারা প্রচলিত ধারার রাজনীতির বিপক্ষে একটি নতুন ধারার রাজনীতি চায়। যেখানে অতীত চর্চার চেয়ে ভবিষ্যতের কথা থাকবে। সমাজ ও রাষ্ট্র হবে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক। মারামারি-হানাহানি থাকবে না। সবাই স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারবে। নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। মেধা ও যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। অপ্রিয় হলেও এ কথা সত্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি অতীতাশ্রয়ী। অতীতের জনপ্রিয় দু’জন নেতার ইমেজের ওপর ভিত্তি করে তারা রাজনীতি করে। নতুন জেনারেশনের কাছে ওই দুই নেতা হচ্ছেন অর্ধশতাব্দী আগের বিষয়।
ষাটের দশকে ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তার এক বইয়ে জেনারেশন গ্যাপের দিকে ইঙ্গিত করে লিখেছিলেন যে, তরুণরা যা চায় তার সাথে তিনি একমত নন। কারণ তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের আচরণ দেখছেন কিন্তু ব্রিটিশ আমলে হিন্দু জমিদাররা এ দেশের সাধারণ মানুষের সাথে কী আচরণ করেছে তারা তা দেখেনি। বলাবাহুল্য, আওয়ামী লীগের ওই সব তরুণ নেতাদের প্রেশারের কারণেই সিনিয়র নেতারা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রগঠনের দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হন।
একটি কথা মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের প্রায় ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৪ কোটিই তরুণ যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, সিপাহি-জনতার বিপ্লব দেখেনি এমনকি এরশাদবিরোধী আন্দোলনও দেখেনি। তারা দেখেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। তাদের দেখার সাথে প্রবীণদের দেখার যেমন অনেক পার্থক্য আছে তেমনি তাদের চিন্তাচেতনারও অনেক পার্থক্য আছে। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ এ ধরনের ঐক্যবিনাশী চিন্তাভাবনা পেছনে ফেলে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং দেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নতুন জেনারেশনের পক্ষেই সম্ভব।
কারো কারো ধারণা, এত অল্প বয়সে সমন্বয়কদের রাজনীতির মাঠে আসা ঠিক হবে না। যারা এ ধারণা পোষণ করেন তাদের অবগতির জন্য বলা যেতে পারে, ১৯৪৯ সালে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় তখন আসাম থেকে আসা মুসলিম লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করা হলেও দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ৩১ বছর বয়স্ক জনাব শামসুল হক। আর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ২৯ বছর বয়স্ক শেখ মুজিবুর রহমান ও ৩০ বছর বয়স্ক খন্দকার মুশতাক আহমদ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা