২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

সঙ্কট উত্তরণে সামরিক সদস্যদের কাজে লাগানো

- প্রতীকী ছবি

১. গত ৫৩ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক বড় বড় প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঘটনা আমরা দেখেছি। ইতিহাস সাক্ষী দেয় ষড়যন্ত্র যেখানে তার তীক্ষ্ম দাঁত নখ থাবা উঁচিয়ে আগ্রাসী চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসে ঐতিহাসিক কারণে প্রতিরোধ শক্তিও তার পাশাপাশি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। বরং না দাঁড়ানোটায় হলো ব্যতিক্রম। আর ইতিহাস সাধারণভাবে ব্যতিক্রমকে মেনে নিতে পারে না, ভবিষ্যতেও পারবে না। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানও ইতিহাসের একটি অধ্যায়।

২০২৪ এর আন্দোলনে নিজ দেশে নিজেদের মানুষের হাতে সম্ভাবনাময় শিশু, কিশোর, তরুণসহ সাধারণ মানুষ যেভাবে প্রাণ দিয়েছেন, নিজেদের অঙ্গহানি করে নতুন রাষ্ট্রগঠনের যে সুযোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তৈরি করে দিলেন তার যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত। দেশের সার্বিক দিক বিবেচনায় এ মুহূর্তে আমরা এক সঙ্কটময় অবস্থায় আছি, যেখানে রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্বে যদি পুনরায় কোনো ভুল মানুষকে ভুল জায়গায় যুক্ত করা হয়; তাহলে এ দেশের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না বরং পুনরায় নতুন এক মহাসঙ্কটের সৃষ্টি হবে, যার ভয়াবহতা পূর্ববর্তী সব অবস্থাকে ছাড়িয়ে যাবে যেটি আমাদের সবার জানা। যা পরোক্ষভাবে প্রতিটি শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানির শামিল।

২. একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নে বা সংস্করণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন; যদি তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে অভিজ্ঞ, দক্ষ, সর্বোপরি নৈতিক জনবল নিয়োগ করতে পারেন। পূর্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রপ্রধানরা যেসব ভুল করেছেন তার তীব্রতা আমরা সবাই দেখেছি। এখন আর পুনরায় ভুল করার সময় নয় বরং সব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সময়।

এ মহাসঙ্কট থেকে উত্তরণে যেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের বিবেকের, অভিজ্ঞতার, দক্ষতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা উচিত সেখানে বাস্তব চিত্রে আমরা কী দেখছি? আমরা জানি দুর্নীতির বিস্তার ও অদক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জনগণকে সেবা প্রদানে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

৩. সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা দেখেছি প্রশাসনের উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে ৪৭৯ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সচিবরা মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান। তাদের ওপর মন্ত্রণালয়ের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। মাত্র এক সপ্তাহে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন, এমন নজিরও আমরা দেখেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে পদোন্নতি পাওয়া কোনো কোনো কর্মকর্তার নামে অতীতে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে। এত বড় একটা বিপ্লবের পর প্রশাসনে (সামরিক ও বেসামরিক) যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল সেটা কি এখন পর্যন্ত নেয়া হয়েছে?

৪. ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল’। আমরা তো পুনরায় দেখতে পাচ্ছি স্বৈরাচার সরকারের প্রশাসন দিয়ে দেশ চালানো হচ্ছে। পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। একইভাবে ক্ষমতার পালাবদলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় প্রশাসনের অন্যান্য সেক্টরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তাই তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন না। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সরকারের সাম্প্রতিক এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত কেমন তা ২৪ সেপ্টেম্বর লেফটেন্যান্ট তানজিম দুর্বৃত্তদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার ঘটনা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।

৫. আর কত দিন আমাদের সাহসী ছেলেরা এ জাতির জন্য জীবন দিতে থাকবে? এরকম নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের শাস্তি আমরা কত বছরে নিশ্চিত করতে পেরেছি? ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে আমাদের কী জবাব আছে? আমরা কি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো উত্তর পেতে পারি?

বর্তমানে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভ‚-রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দেশের এ সঙ্কটে সশস্ত্রবাহিনীকে আরাকান থেকে আসা হুমকি মোকাবেলাসহ যেকোনো ধরনের সঙ্কটেও সজাগ থাকতে হবে। অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে লে. তানজিমের মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত, এমন মৃত্যু সমগ্র সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষে মেনে নেয়া, সহ্য করা কঠিন। তাই আমরা মনে করি, জরুরি ভিত্তিতে ছাত্রদের মধ্য থেকে পুলিশ নিয়োগের দ্রুত ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং প্রশিক্ষকের ঘাটতি কমাতে অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী মেরিটাইম পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। আমাদের মনে হয় পুলিশ হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ছাত্ররা পুলিশের থেকে সামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা প্রশিক্ষিত হতে বেশি পছন্দ করবে। যেকোনো মূল্যে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রয়োজন মেটাতে স্বল্প প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার মাধ্যমে পুলিশের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে।

৬. আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধের সময়, জর্জ ওয়াশিংটন তার জয়ের চেয়ে অনেক বেশি যুদ্ধে হেরেছেন, তবু তিনি সবসময় তার সৈন্যদের সংখ্যা দ্রুত সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেসামরিক লোকদের নিয়োগের মাধ্যমে পরিপূর্ণ রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। লজিস্টিক সাপোর্ট ও ফান্ডের অভাবে ব্রিটিশদের মতো সাঁজোয়া যুদ্ধবহর সেনা তার ছিল না। ওয়াশিংটন বুঝতে পেরেছিলেন যেসব শহর বাঁচানো জরুরি নয়, তবে তার সেনাবাহিনীকে রক্ষা করা এবং বিপ্লবী চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখা আরো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্য দ্রুত নিয়োগের মাধ্যমে ব্রিটিশ ফিল্ড আর্মিদের মুখোমুখি হয়ে তিনি একটি যুদ্ধবাহিনী বজায় রেখেছিলেন। প্রায় আড়াই লাখ আমেরিকান সৈন্য নিয়মিত বা মিলিশিয়া হিসাবে বিপ্লবী কারণে যুদ্ধের সময় আট বছর ধরে কাজ করেছিলেন, কিন্তু কোনো সময় নব্বই হাজারের বেশি সৈন্য ছিল না। তবে, ১৭৭৮ সালের পরে, ওয়াশিংটনের সেনাবাহিনী আরো সুশৃঙ্খল এবং কার্যকরী বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রয়োজনীয় শক্তি ও মনোবল ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমরাও পুলিশে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং স্বল্পতার কারণে স্বল্প সময়ে পুলিশ প্রশিক্ষণে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এরকম নিয়োগের পদক্ষেপ নিতে পারি। আর কোনো তানজিমকে যেন প্রাণ দিতে না হয় এজন্য অপরাধীদের দ্রæত সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যাতে এরকমের কোনো ঘটনা ঘটানোর সাহস কোনো দুর্বৃত্ত না দেখাতে পারে।

সামরিক বাহিনীর সাবেক একজন কর্মকর্তা হিসেবে এবং সিভিল প্রশাসনে নিজের চাকরির অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা থেকে মনে করি এ অবস্থায় বেসামরিক প্রশাসনে এবং পুলিশিং কাজ সম্পাদনে সামরিক কর্মীদের দ্বারা অনেক কঠিন হবে। এ মুহূর্তে সময় নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই আমাদের। তাই দ্রুততম সময়ে প্রশাসনিক বিভাগ থেকে ফ্যাসিবাদী প্রশাসনকে শুদ্ধ করা অন্তর্বর্তী সরকারের জরুরি।

৭. দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো বেশি অবনতি হওয়ার আগে দেশের এ পরিস্থিতিতে আমাদের প্রস্তাবিত পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে সব থানার ওসিদের যাচাই বাছাই করে তাৎক্ষণিক বদলির পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন ভূমিকায় দ্রুত সিদ্ধান্ত ও যথাযুক্ত পদক্ষেপ নিতে, সামরিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা একটি বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ হবে বলে মনে করি। যেকোনো কর্মসংস্থানে নেতৃত্ব হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। বোয়িংয়ের এমপ্লয়ি লিসেনিং অ্যান্ড ট্যালেন্ট স্ট্র্যাটেজির সিনিয়র ম্যানেজার ক্রিটিন সাবো বলেছেন, ‘নেতৃত্ব এবং সততা, সামরিক প্রতিভার মধ্যে সাধারণ সমালোচনামূলক দক্ষতা যা সশস্ত্র বাহিনীতে অনুশীলন করা হয়। প্রমাণিত নেতৃত্ব, উদ্দেশ্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি, সৌহার্দ্য এবং নিঃস্বার্থতা যা একজন ভেটেরান্স তার কর্মজীবনে প্রদর্শন করে তা অনেক মূল্যবান সম্পদ যাতে যেকোনো নিয়োগকর্তা উপকৃত হন।’ যুক্তরাষ্ট্র ট্যালেন্ট ডেলিভারি প্রোগ্রামারের নির্বাহী পরিচালক জন ম্যাকগ্যারিটি বলেছেন, ‘সামরিক সদস্যরা দৈনন্দিন জীবনে নেতৃত্বের দক্ষতা ব্যবহার করে, তাদের নিজস্ব কর্মজীবন ছাড়াও তারা অন্যান্য কারণে চাপযুক্ত জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।’ একজন সামরিক অভিজ্ঞ ব্যক্তি দক্ষতার সাথে প্রথম দিনে অফিসে আসে। এ স্বল্পসময়ে সঙ্কটময় মুহূর্তে আমাদের পক্ষে নতুন করে দক্ষ জনবল তৈরি করে বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগ দেয়ার যথেষ্ট সময় নেই। কিন্তু আমাদের আছে যথেষ্ট পরিমাণে কঠোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সৎ, দক্ষ, অভিজ্ঞ, অভিযোজনযোগ্য, নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে আমরা এসব মেধার যথাযথ ব্যবহার করতে পারি।

প্রয়োজনে সরকার বিদেশ থেকেও স্বনামধন্য দক্ষ বাংলাদেশীদের নিয়োগ করতে পারে। এ স্বল্প সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দেশ এবং দেশের মানুষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনাসাপেক্ষে দেশের উপকারে সামরিক সংস্থার বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গকেও অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করা যেতে পারে; যাতে তারা ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের যথোপযুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্য স্থানে নিযুক্ত করার মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আশা ব্যক্ত করছি।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী
প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি


আরো সংবাদ



premium cement